আল্লামা শফীর চেয়ারে মাওলানা মাহমুদুল হাসান বসার নেপথ্যে

Published: 3 October 2020

বিশেষ সংবাদদাতা, ঢাকা : অবশেষে আল্লামা আহমদ শফীর চেয়ারে বসলেন আল্লামা মাহমুদুল হাসান। শনিবার দুপুরে মজলিসে আমেলার দায়িত্বশীলদের প্রত্যক্ষ ভোটে তিনি কওমি মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড বেফাকের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি নির্বাচিত হয়েছেন।


এদিন সকাল ১০টা থেকে শুরু হওয়া বেফাকের মজলিসে আমেলার বৈঠকে সবার ঐকমত্যের ভিত্তিতে সভাপতি মনোনয়নের কথা থাকলেও পারস্পরিক অনৈক্য ও বিভেদের কারণে তা সম্ভব হয়ে উঠেনি।

পরবর্তী মজলিসে আমেলার অধিকাংশ সদস্য গোপন ব্যালেটে তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগের পক্ষে রায় দিলে বেফাকের সহসভাপতি মুফতি মুহাম্মদ ওয়াক্কাসের নেতৃত্বে ৩ সদস্যের নির্বাচন পরিচালনা কমিটিম গঠন করা হয়।
এ কমিটির তত্ত্বাবধানে কার্যত বেলা ২টার পর থেকেই নির্বাচন প্রক্রিয়া শুরু হয়।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, মজলিসে আমেলার সদস্যদের মোট ভোটার ছিলেন ১২৫ জন। সভাপতি পদে দুই প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী মাওলানা নূর হোসাইন কাসেমী ও মাওলানা মাহমুদুল হাসানের মধ্যে প্রাপ্ত ভোটের ব্যবধান হয়েছে প্রায় ১৬টি।

মাওলানা মাহমুদুল হাসান ৬৬ ভোট পেয়ে বিজয়ী হয়েছেন। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী মাওলানা নূর হোসাইন কাসেমী পেয়েছেন ৫০ ভোট। আর হেফাজত মহাসচিব মাওলানা জুনায়েদ বাবুনগরী পেয়েছেন ৩ ভোট।

একই সভার দ্বিতীয় অধিবেশনে উপস্থিত আমেলা সদস্যদের সর্বসম্মত সিদ্ধান্তক্রমে আল্লামা নূর হোসাইন কাসেমীকে সিনিয়র সহ-সভাপতি মনোনীত করা হয়।

তৃতীয় অধিবেশনে সাবেক মহাসচিব মাওলানা আব্দুল কুদ্দুস পদত্যাগ করেন। অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের জেরে গত ২২ সেপ্টেম্বর মজলিসে খাসের এক বৈঠকে মহাসচিব পদ থেকে সরে দাঁড়ানোর ঘোষণা দিয়েছিলেন মাওলানা আবদুল কুদ্দুস।

কথা অনুযায়ী আজ মজলিসে আমেলার মিটিংয়ে মহাসচিব ও সহ-সভাপতি পদ থেকে তিনি অব্যাহতি নিলেই কণ্ঠ ভোটে তার শূন্য পদ পূরণের চেষ্টা করেন বেফাক কর্তৃপক্ষ। কিন্তু একাধিক প্রার্থী ও ঐকমত্যের ভিত্তিতে কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছতে না পারায় আবার ভোট গ্রহণ অনুষ্ঠিত হয়।

জামিয়া রাহমানিয়ার প্রিন্সিপাল মাওলানা মাহফুজুল হক সর্বমোট ৭৩ ভোট পেয়ে মহাসচিব নির্বাচিত হন। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী মাওলানা মুসলেহ উদ্দীন রাজু ভোট পেয়েছেন ৪০টি।

মাওলানা আবদুল কুদ্দুস আল্লামা আহমদ শফীর ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত। কয়েক মাস আগে বেফাকের বহিষ্কৃত পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক মাওলানা আবু ইউসুফের সঙ্গে তার ফোনালাপ ফাঁস হওয়ায় কিছু অনিয়মের বিষয় প্রকাশ পায়। তখন থেকেই তার পদত্যাগের দাবি জোরালো হতে থাকে।

২০১৬ সালের বেফাকের দীর্ঘ সময়ের মহাসচিব মাওলানা আবদুল জব্বার জাহানাবাদীর ইন্তেকালের পর প্রথমে ভারপ্রাপ্ত পরে কাউন্সিলে মহাসচিব নির্বাচিত হন মাওলানা আবদুল কুদ্দুস।

তার সময়ের মৌলিক অর্জন বাংলাদেশ কওমি মাদ্রাসা শিক্ষা সনদের সরকারি স্বীকৃতি। স্বীকৃতি ঘিরেই ঘটিত হয় আল হাইয়াতুল উলইয়া। তার সম্পূর্ণ তত্ত্বাবধানেই কওমি শিক্ষা সনদের স্বীকৃতি ঘোষণা করায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে শুভেচ্ছা জানাতে আয়োজন করা হয় শুকরানা মাহফিলের।

মরহুম আল্লামা আশরাফ আলী ছিলেন বেফাকের সিনিয়র সহ-সভাপতি এবং হাইয়াতুল উলইয়ার প্রতিষ্ঠাতা কো-চেয়ারম্যান ।

গত বছরের ডিসেম্বরে তিনি ইন্তেকাল করলে শূন্য হয় গুরুত্বপূর্ণ দুটি পদ- বেফাকের সিনিয়র সহসভাপতি ও আল হাইয়াতুল উলইয়ার কো-চেয়ারম্যান।

এ সময় মাওলানা আব্দুল কুদ্দুস একসঙ্গে তিন পদের (মহাসচিব, সিনিয়র সহ-সভাপতি, কো-চেয়ারম্যান) অধিকারী হন।

উল্লেখ্য, গত ১৮ সেপ্টেম্বর আল্লামা আহমদ শফীর ইন্তেকালের পর থেকেই হেফাজতে ইসলামের আমীর, হাটহাজারী মাদ্রাসার মুহতামিম ও বাংলাদেশ কওমি মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডের সভাপতি কে হবেন- সারা দেশের কওমি অঙ্গনে এ নিয়ে চলছিল নানা রকমের আলোচনা সমালোচনা।

১৯ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যায় মজলিসে শূরা হাটহাজারী মাদ্রাসা পরিচালনা কমিটি গঠন করে দিলেও বেফাকের সভাপতি পদের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়েছে আজ।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আরও অল্প কিছু দিনের মধ্যেই হেফাজতে ইসলামের আমীরের বিষয়েও একটি সুরাহা হবে।

জানা যায়, বেফাকে আল্লামা আহমদ শফীর উত্তরসুরি কে হবেন? এ নিয়ে গত বেশ কিছু দিন থেকেই আলেমদের মধ্যে চলছিল বিবাদ ও বিতর্ক।

ঢাকার যাত্রাবাড়ী মাদ্রাসার মুহতামি আল্লামা মাহমুদুল হাসানের মতো জনপ্রিয় ও আস্থাশীল আলেমকে আহমদ শফীর এ পদে বসাতে দেশের কওমি ছাত্র-শিক্ষদের বৃহৎ অংশ আগে থেকেই প্রস্তুত ছিলেন।

বেফাকের দায়িত্বশীলদের অনেকে বলছেন, নূর হোসাইন কাসেমী ২০ দলীয় জোটের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত থাকায় অনেকেই তাকে সভাপতির পদে দেখতে চাননি।

তাছাড়া বেফাকের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সরাসরি সংশ্লিষ্ট কেউ বেফাকের এই শীর্ষপদগুলোতে আসতে পারবে না- এমন ধারার কারণেই আল্লামা কাসেমীর এ পদে আসার সুযোগ আগে থেকেই সংকুচিত ছিল।
অবশ্য নূর হোসাইন কাসেমী সব রকমের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড থেকে অব্যাহতি নেয়ার শর্তেই আজকে বেফাকের সভাপতি প্রার্থী হয়েছিলেন।

২০০৫ সালে বেফাকের সভাপতি মাওলানা নুরুদ্দীন আহমাদ গহরপুরীর ইন্তেকালের পর একই বছর বেফাকের সভাপতি হিসেবে নির্বাচিত হন আহমদ শফী। আমৃত্যু তিনি বেফাকের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন।

একই সঙ্গে গঠনতান্ত্রিকভাবে বেফাকের সভাপতি হিসেবে ২০১৭ সালে সরকার স্বীকৃত আল-হাইআতুল উলয়া লিল-জামি‘আতিল কওমিয়া’র চেয়ারম্যান নিযুক্ত হন।

২০১৭ সালের ১১ এপ্রিল রাতে গণভবনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশের উল্লেখযোগ্য আলেমদের উপস্থিতিতে কওমি মাদ্রাসার দাওরায়ে হাদিসকে মাস্টার্সের সমমান দেয়ার ঘোষণা দেন।

১৩ এপ্রিল শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগ (সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, শাখা-১) থেকে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়। বর্তমানে ৬টি বোর্ডের অন্তর্ভুক্ত বাংলাদেশের সব দাওরায়ে হাদিস কওমি মাদ্রাসা আল-হাইয়াতুল উলয়া লিল-জামি‘আতিল কওমিয়ার অধীনে পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে।

জানা গেছে, ‘আল-হাইয়াতুল উলইয়া লিল জামিয়াতিল কওমিয়া বাংলাদেশ’ এর গঠনতন্ত্র মোতাবেক বেফাকের সভাপতি যিনি হবেন তিনিই হবেন আল-হাইয়াতুল উলইয়ার সভাপতি। একইভাবে বেফাকের সিনিয়র সহসভাপতি যিনি হবেন তিনিই আল হাইয়াতুল উলইয়ার কো-চেয়ারম্যান।

সেই হিসেবে মাওলানা মাহমুদুল হাসানই হচ্ছেন আল হাইয়াতুল উলইয়ার পরবর্তী চেয়ারম্যান ও নূর হোসাইন কাসেমী হচ্ছেন কো-চেয়ারম্যান।