স্বামী-স্ত্রী সেজে যেভাবে নারী পাচার

Published: 4 October 2020

বিশেষ সংবাদদাতা, ঢাকা : স্টুডেন্ট ভিসায় মালয়েশিয়া গিয়েই পরিচয় হয় জান্নাতুল জেরিনের সঙ্গে প্রতীকের। কুয়ালালামপুরের বিভিন্ন ক্লাবে নাচ করে জেরিন। লেখাপড়ার পাঠ চুকিয়ে জেরিনের সঙ্গে এক ভিন্ন জগতে পা দেয় মাহেমুনুজ্জামান প্রতীক খন্দকার ওরফে বাবু। টাকার নেশায় দু’জনেই বেপরোয়া হয়ে ওঠে। কুয়ালালামপুর থেকেই সম্পর্ক গড়ে ওঠে ভারত, দুবাই, কাতারসহ বিভিন্ন দেশের নারী পাচারকারী সিন্ডিকেটের সঙ্গে। নারী পাচারের জন্য বাংলাদেশকে বেছে নেয় তারা। এখানে দরিদ্র নারীদের নানা প্রলোভন দিয়ে সহজেই ফাঁদে ফেলতে পারবে বলেই পরিকল্পনা অনুসারে দু’জনেই ফিরে আসে ঢাকায়। তারপরই শুরু হয় নারী পাচারের মিশন।

টার্গেট করা হয় পারিবারিক, আর্থিক সমস্যায় জর্জরিত কম বয়সী সুন্দরীদের। নারী পাচারের উদ্দেশ্যেই ঘন ঘন দেশের বাইরে যেতো তারা। দেশে বসেই অন্যের জীবন বিপন্ন করে উপার্জন করছিল বিপুল টাকা। এই চক্রের সদস্যদের গ্রেপ্তারের পর বেরিয়ে আসছে চাঞ্চল্যকর নানান তথ্য।

সূত্রেমতে, কুয়ালালামপুরের গ্র্যান্ড সিজন হোটেলের ১১ তলায় বোম্বে প্যালেস নাইট ক্লাব, পাকিজা লাইফ ড্যান্স, আশিকী মুজরা (নাইট ক্লাব), দেবদাস মুজরা, সাঙ্গাম মুজরাসহ বিভিন্ন ক্লাবে আসা-যাওয়া ছিল প্রতীক ও জেরিনের। প্রতিরাতে মাদকের নেশায় বুঁদ হয়ে থাকতো তারা। ক্লাবে গিয়েই পরিচয় হয় জেরিনের সঙ্গে। তারপর বন্ধুত্ব। কুয়ালালামপুরে একই বাসায় থাকতো তারা। একইভাবে ঢাকায় আসার পর ২০১৯ সাল থেকে মাদারটেক এলাকায় স্বামী-স্ত্রী পরিচয়ে একই বাসায় বসবাস করছিল। ওই বাসারই এক কিশোরীকে পাচার করছিল এই চক্র। তার আগে আরও এক কিশোরীসহ অন্তত ২০ নারীকে পাচার করেছে এই চক্র। মাদারটেকের ওই ফ্ল্যাটের মালিক একজন নারী। স্বামীর সঙ্গে বিচ্ছেদ হয়ে গেছে। সপ্তম শ্রেণি পড়ুয়া তার এক মেয়ে। ওই নারী জানান, স্বামী-স্ত্রী পরিচয়ে বাসা সাবলেট নিয়েছিল প্রতীক ও জেরিন। বাবা-মায়ের ডিভোর্স হয়ে গেছে। ওই মেয়েটির দিকেই নজর পড়ে প্রতীক ও জেরিনের। তাকে মালয়েশিয়ায় উন্নত জীবন-যাপনের স্বপ্ন দেখায় তারা। এভাবেই প্রলোভন দেখিয়ে গত বছরের ২৩শে নভেম্বর ওই কিশোরীকে যশোর সীমান্ত এলাকা দিয়ে ভারতে পাচার করার চেষ্টা করছিল এই চক্র। ওই কিশোরীকে পাচারের আগেই ভারতে চলে যায় প্রতীক। ভারতে বসেই পুরো প্রক্রিয়া নিয়ন্ত্রণ করছিল প্রতীক। গ্রেপ্তারের পর সিআইডিকে এসব তথ্য জানিয়েছে প্রতীক নিজেই। জেরিন ও পাচারকারী চক্রের রিফাত, শাহীনসহ অন্য সদস্যদের মাধ্যমে বেনাপোল সীমান্তের একটি বাড়িতে নিয়ে যায় কিশোরীকে। তার আগেই চেতনাশক দিয়ে অবচেতন করা হয় তাকে। সেখানে ভুক্তভোগী ওই কিশোরীকে রফিক নামে চক্রের সদস্যের বাড়িতে আটকে রাখে। স্থানীয়রা বিষয়টি সন্দেহের দৃষ্টিতে দেখলে কিশোরীকে নিয়ে যাওয়া হয় আক্তার নামে চক্রের এক সদস্যের বাড়িতে। সেখানে ওই কিশোরীকে ধর্ষণের চেষ্টা করে। এক পর্যায়ে তাকে অজ্ঞান করা হয়। ভুক্তভোগী পরিবার দাবি করছে, ওই সময়ে ধর্ষণের শিকার হয়েছে কিশোরী।

সীমান্ত এলাকাতেই ভারতে একটি দালাল চক্রের কাছে ওই কিশোরীকে হস্তান্তর করার প্রক্রিয়া চলছিল। এরমধ্যেই অভিযান চালিয়ে পুলিশ ওই মেয়েটিকে উদ্ধার করে। পাচারকারী চক্রের অন্য এক সদস্যকে আটক করে। এ ঘটনায় কিশোরীর মা বাদী হয়ে সবুজবাগ থানায় মামলা দায়ের করলে জেরিনকে গ্রেপ্তার করা হয়। কিন্তু আত্মগোপনে ছিল প্রতীক খন্দকার ওরফে বাবু। অবশেষে প্রায় এক বছর পর পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)’র একটি টিম চট্টগ্রাম থেকে গ্রেপ্তার করে প্রতীককে। প্রতীক খন্দকারের বিরুদ্ধে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন এবং পর্ণোগ্রাফি আইনে পৃথক আরও দু’টি মামলা আদালতে বিচারাধীন রয়েছে। সিআইডি’র বিশেষ পুলিশ সুপার কানিজ ফাতেমা জানান, ভারত, দুবাই, মালয়েশিয়াসহ বিভিন্ন দেশে নারী পাচারকারী চক্রের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত প্রতীক, মো. শাহীন, মো. রফিকুল ইসলাম, বিপ্লব ঘোষ, আক্তারুল ও মো. বাবলুসহ এই চক্রের মোট নয়জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। ইতিমধ্যে মানবপাচারের কথা স্বীকার করে চক্রের প্রতীক আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিয়েছে।

ওই কিশোরীকে পাচারের আগে নীলা নামে এক নারীকে চাকরির প্রলোভন দিয়ে ভারত পাচার করেছিল প্রতীক, জেরিন চক্র। সেখানে তাকে জোর করে ধর্ষণ করা হয়। ভয় দেখিয়ে, মারধর করে রাজি করানো হয় অনৈতিক কাজে। শেষ পর্যন্ত নীলা পালিয়ে এলে সীমান্ত এলাকা থেকে পুলিশ তাকে উদ্ধার করে। নীলাকে ভারত থেকে সৌদি আরবে পাঠাতে চেয়েছিল চক্রটি। উদ্ধারের পর আদালতে এ বিষয়ে ১৬৪ ধারায় ঘটনার বর্ণনা দেয় নীলা। নীলার বর্ণনায় বেরিয়ে আসে এই চক্রের পাপের খতিয়ান। তারপরই জোরালো তদন্ত শুরু করে সিআইডি।