একজন জামাল খাসোগি

Published: 5 October 2020

।। হাসান আল কোন্তার ।। ২ অক্টোবর সৌদি সাংবাদিক জামাল খাসোগিকে হত্যা করার দ্বিতীয় বার্ষিকী গেল। একজন সাংবাদিক হিসেবে তিনি কীভাবে সৌদি সরকারের অন্যায়–অবিচারের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিলেন, কীভাবে তিনি নৃশংস হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছিলেন, তা নিয়ে বিশ্বের বহু সাংবাদিক ও কলাম লেখক তাঁদের অভিমত দিয়েছেন। কিন্তু তাঁর দ্বিতীয় মৃত্যুবার্ষিকীতে আমি তাঁকে শুধু মানুষ জামাল হিসেবে স্মরণ করতে চাই।

জামালের সঙ্গে আমার প্রথম যোগাযোগ হয় ২০১৮ সালে। ওই সময় আমি নিজেই বিশ্ব গণমাধ্যমের স্পটলাইটে। আপনাদের হয়তো স্মরণে আছে, ওই বছরের এপ্রিলে ‘মালয়েশিয়ার বিমানবন্দরে আটকা পড়ে আছেন সিরিয়ার শরণার্থী’ শিরোনামে পত্রিকায় একটি খবর ছাপা হয়েছিল। আটকা পড়া লোকটি ছিলাম আমি।

প্রথমে আমি সেখানে আটকা পড়েছিলাম কীভাবে সেটা বলে নিই।

আসলে ২০১১ সালে আমার দেশ সিরিয়ায় যুদ্ধ লেগে যাওয়ার সময়ই আমার কপাল পোড়ে। আমি তখন সিরিয়ার সেনাসদস্য হিসেবে সংযুক্ত আরব আমিরাতে কাজ করছিলাম। আমি যুদ্ধে নিজেকে জড়াব না বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। আমি ঠিক করেছিলাম, আমি বাশার সরকারের কিলিং মেশিন হয়ে নিজের ভাইদের মারব না।

কিছুদিনের মধ্যে আমি সংযুক্ত আরব আমিরাতে আমার ওয়ার্ক পারমিট হারালাম এবং অবৈধ হয়ে গেলাম। ওই সময় মালয়েশিয়াসহ হাতে গোনা কয়েকটি দেশ সিরিয়ার নাগরিকদের অন অ্যারাইভাল ভিসা দিচ্ছিল। সেই সুবাদে আমাকে ২০১৭ সালের অক্টোবরে মালয়েশিয়ায় পাঠিয়ে দেওয়া হলো।

মালয়েশিয়ায় আমি শরণার্থী হিসেবে থাকার আবেদনও করতে পারছিলাম না, কোনো ওয়ার্ক পারমিটও পাচ্ছিলাম না। ফলে সেখানে কয়েক মাস থাকার পর আমি মালয়েশিয়া থেকে অন্য কোনো দেশে যাওয়ার চেষ্টা করলাম। আমি ইকুয়েডরে এবং কম্বোডিয়ায় যেতে চাইলাম কিন্তু তারা সেখানে থাকতে দিল না। আমাকে আবার মালয়েশিয়ায় ফেরত পাঠিয়ে দিল। কিন্তু কুয়ালালামপুর বিমানবন্দরে নামার পর তারা আমাকে বের হতে দিল না। আমি কয়েক মাস সেই বিমানবন্দরে আটকা পড়ে থাকলাম। বিমানবন্দরের কর্মীরা আমাকে খাবার দিয়ে যেত। আমি যাত্রীদের অপেক্ষা করার জায়গায় মেঝেতে ঘুমাতাম।

আমি সেখান থেকে প্রতিদিন টুইটারে আমার দুর্দশার কথা লিখতাম। আমার আটকা পড়ার কথা প্রথম একটি আরবি ভাষার পত্রিকায় ছাপা হয়। কিন্তু দেখলাম জনসাধারণ সেই খবর পড়ে যা প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করল তা হতাশাজনক। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অনেকেই আমাকে ভীরু, কাপুরুষ বলে গালিগালাজ করতে লাগল। আমি মানসিকভাবে ভেঙে পড়ছিলাম। আমি যে কী মানবেতর অবস্থায় একটি বিমানবন্দরে আটকে আছি, সে বিষয়ে বেশির ভাগ লোকই সমবেদনা জানাল না।

একদিন ভোরে অন্য দিনের মতোই আমি বিমানবন্দরে বসে উড়োজাহাজের ওঠানামা দেখছিলাম। কোন ফ্লাইট কখন ছাড়বে, সেই ঘোষণা কানে আসছিল। কোনো নতুন তথ্য আছে কি না, তা দেখতে বারবার আমার সস্তা দামের স্মার্টফোনে চোখ রাখছিলাম। ফোনসেটটিই ছিল আমার একমাত্র ভরসা। এর মাধ্যমেই আমি খবরাখবর পাচ্ছিলাম।

হঠাৎ দেখলাম, আমার টুইটার অ্যাকাউন্টে অস্বাভাবিক অ্যাকটিভিটি দেখা যাচ্ছে। বহু লোক আমার লেখা শেয়ার দিচ্ছে। কারণ ঘাঁটতে গিয়ে দেখলাম, জামাল খাসোগি নামের একজন সাংবাদিক আমার টুইট শেয়ার দিয়েছেন, আর তাতেই বহু মানুষের কাছে আমার বার্তা পৌঁছে গেছে।

আমরা অনেকে প্রথম দিকে খাসোগিকে সৌদিরাজের একজন প্রবল ক্ষমতাধর পরামর্শক হিসেবে জানতাম। কিন্তু পরবর্তীকালে সৌদি নেতাদের কথামতো না চলায় তাঁদের বিরাগভাজন হয়ে পড়েন। এরপর তিনি দেশ ছেড়ে সৌদি সরকারের, বিশেষ করে ক্ষমতাসীন যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের কড়া সমালোচনা করেন। একজন সৌদি নাগরিক হিসেবে তিনি প্রথম সৌদি সরকারকে সরাসরি ‘না’ বলা শুরু করেন।

আমার মতো অখ্যাত ও অপরিচিত একজন মানুষের পাশে তিনি দাঁড়ানোয় আমি যেন প্রাণ ফিরে পেয়েছিলাম।

আমি তাঁকে দ্রুত এসএমএস করে ধন্যবাদ জানালাম। তার পরের দিন তিনি আমাকে ফিরতি মেসেজে বললেন, ‘আপনি আপনার টুইটগুলোতে সব সময়ই নিজের সম্পর্কে কিছু না–কিছু বলতে থাকুন। এয়ারপোর্টে আপনার সর্বশেষ অবস্থা সম্পর্কে জানান।’ তিনি আমাকে লিখলেন, ‘আমি আমার এক আমেরিকান বন্ধুর মাধ্যমে আপনাকে সহায়তা করার চেষ্টা করছি। কিন্তু আমি কথা দিতে পারছি না। আপনি হতাশ হবেন না। প্রতিদিন আপনার জন্য অগণিত লোক দোয়া করছে।’

খাসোগি মিথ্যা বলেননি। ডোনাল্ড ট্রাম্প যে মুহূর্তে সিরিয়ার নাগরিকদের তাঁর দেশে নিষিদ্ধ করেছিলেন, সেই মুহূর্তে আমার মতো লোকের পক্ষে যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়া প্রায় অসম্ভব ছিল। কিন্তু সেই সুযোগও তিনি আমার জন্য করে গিয়েছিলেন।

খাসোগির মেসেজ পাওয়ার কিছুদিন পর ১ অক্টোবর আমাকে কুয়ালালামপুর বিমানবন্দর থেকে গ্রেপ্তার করে আটককেন্দ্রে নিয়ে যাওয়া হলো। এটি আমাকে সিরিয়ায় ফেরত পাঠানোর প্রক্রিয়াকে প্রায় অবধারিত করে ফেলেছিল। এর পরের দিন ২ অক্টোবর ইস্তাম্বুলে সৌদি কনস্যুলেটে জামাল খাসোগিকে হত্যা করা হয়।

আটক থাকার কারণে আমি দুনিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন ছিলাম। এ কারণে আমি কিছুই জানতাম না। খাসোগি নিহত হওয়ার ২৫ দিন পর আমার কানাডীয় আইনজীবী আমার সঙ্গে দেখা করতে এলেন। আমি তাঁকে বললাম, ‘বিশ্বে এখন গরম খবর কোনটি? সিরিয়ার কী খবর?’ তিনি আমাকে বললেন, ‘দুনিয়া এখন সৌদি সাংবাদিক নিহত হওয়ার খবর নিয়ে ব্যস্ত।’ আমি বললাম, ‘কোন সাংবাদিক? কে?’ তিনি বললেন, ‘জামাল খাসোগি।’ পরের কয়েক মিনিট আমি কথা বলতে পারলাম না। একটা শীতল স্রোত আমার শিরদাঁড়া বেয়ে নামতে লাগল। আমার হাত পা অবশ হয়ে এল।

এখন আমি কানাডায় নিরাপদ জীবন যাপন করছি। এর পেছনে যে খাসোগির অবদান সবচেয়ে বেশি, তাঁর সঙ্গে আমার মুখোমুখি দেখা হয়নি। কিন্তু তিনি আমার আত্মার অবিচ্ছেদ্য আত্মীয় হয়ে আছেন।

আল–জাজিরা থেকে নেওয়া, অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ

হাসান আল কোন্তার সিরীয় বংশোদ্ভূত শরণার্থী অধিকারকর্মী, যিনি কানাডার ভ্যাঙ্কুভারে বসবাস করছেন