ট্রাম্পের অতি তৎপরতা স্তম্ভিত পুরো যুক্তরাষ্ট্র
পোস্ট ডেস্ক : চমকের পর চমক দেখিয়ে চলেছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। প্রথমে তিনি করোনাভাইরাসের অস্তিত্বই মানতে চাননি। নিরুপায় হয়ে সে অংশটি মেনে নিলেও ভাইরাস এড়াতে বিধি-নিষেধের বেড়াজালে নিজেকে আটকে রাখেননি কখনোই। আর করোনা নাটকের ট্রাম্পীয় সংস্করণের সবচেয়ে স্নায়ু টান টান পর্বগুলো ‘অভিনীত’ হয়ে চলেছে গত চার দিন ধরে। প্রথমে তিনি করোনা পজিটিভ হলেন, তারপর হাসপাতালে গেলেন, এরপর সমর্থকদের শুভেচ্ছা জানাতে গাড়ি নিয়ে বের হয়ে পড়লেন পথে। এ নাটকের সর্বশেষ প্রচারিত পর্বটি আরো চমকপ্রদ। করোনা পজিটিভ হওয়ার মাত্র চার দিনের মাথায় হাসপাতাল ছেড়ে হোয়াইট হাউসে গিয়ে উঠেছেন তিনি। মুখের মাস্ক সরিয়ে পোজ দিয়ে ছবি তুলেছেন। সিনেমাটিক ভঙ্গিতে হাসপাতাল থেকে হেলিকপ্টারে ওঠা, হোয়াইট হাউসে নামা, বেলকনিতে দাঁড়িয়ে সামরিক কায়দায় হেলিকপ্টারকে স্যালুট করার ‘শুটিং’ করে টুইটারে ছেড়েছেন। ঘোষণা দিয়েছেন, শিগগিরই নামবেন নির্বাচনী প্রচারে।
ট্রাম্পের এই অতি তৎপরতা পুরো যুক্তরাষ্ট্রকে স্তম্ভিত করেছে। নিরন্তর আলোচনা-সমালোচনা চলছে গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। ট্রাম্পের দাবি, তিনি ভালো আছেন। বাকিদের বার্তা দিয়েছেন, করোনার কাছে তারা যেন নতি স্বীকার না করে। ট্রাম্পের চিকিৎসকের দাবি, সুস্থতার সব শর্ত পূরণ করেই হাসপাতাল ছেড়েছেন প্রেসিডেন্ট। তবে ট্রাম্পের সর্বশেষ করোনা পরীক্ষা কবে করা হয়েছে এবং তার ফলাফল নেগেটিভ এসেছে কি না সে প্রশ্নের জবাব দেননি তিনি। সাংবাদিকদের ক্যামেরায় বিভিন্ন ভঙ্গিতে ছবি তুলতে অতি আগ্রহী ট্রাম্পও কিন্তু এ পেশার লোকজনের কোনো প্রশ্নের জবাব দেননি। তিনি হোয়াইট হাউসে ‘সুপার স্প্রেডার’ হতে যাচ্ছেন কি না সে প্রশ্নের জবাবও এড়িয়ে গেছেন।
ট্রাম্প গত সোমবার স্থানীয় সময় বিকেলে নাটকীয়ভাবে হোয়াট হাউসে ফেরেন। জানা গেছে, এখন এখানে থেকেই তাঁর চিকিৎসা চলবে। মোট তিন রাত হাসপাতালে ছিলেন তিনি। এর মধ্যে দুইবার অক্সিজেনের মাত্রা অনেকটাই নেমে গিয়েছিল তাঁর। প্রথমবার অক্সিজেন সাপোর্ট দিতে হয়েছিল। অ্যান্টি-ভাইরাল ওষুধ রেমডেসিভিরের পাঁচটি ডোজের পাশাপাশি একটি পরীক্ষামূলক অ্যান্টিজেন ককটেল দেওয়া হয়েছে ট্রাম্পকে। বাধ্য হয়েই শুরু হয়েছে স্টেরয়েড চিকিৎসা। নিয়মমাফিক চালু রয়েছে ভিটামিন ডি, জিঙ্ক, ফ্যামোটিডিন, অ্যাসপিরিনও। ওষুধের বহর দেখে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা প্রেসিডেন্টের স্বাস্থ্য নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। তাঁর রবিবারের ‘অ্যাডভেঞ্চার’ নিয়ে সরাসরি বিরক্তি প্রকাশ করেছেন অনেকেই।
গত সোমবার অবশ্য মার্কিন প্রেসিডেন্টের বিনোদনের মাত্রা আরো বেশি ছিল। তিনি প্রেসিডেনশিয়াল হেলিকপ্টার মেরিন ওয়ান থেকে হোয়াইট হাউসের দক্ষিণ লনে অবতরণ করেন। এ সময় হাত নেড়ে, বুড়ো আঙুল দেখিয়ে তিনি বোঝানোর চেষ্টা করেন, ভালো আছেন। কাছে থাকা একজন ফটোগ্রাফারের ভিডিওতে দেখা যায়, এ সময় জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছিলেন প্রেসিডেন্ট। এর কিছুক্ষণের মধ্যেই তাঁকে আবার বেলকনিতে দেখা যায়। মাস্ক খুলে, নেভি ব্লু রঙের স্যুট ঠিকঠাক করে, চিবুক উঁচিয়ে ছবির জন্য পোজ দেন তিনি। এরপর সামরিক কায়দায় হেলিকপ্টারের প্রতি স্যালুট ঠোকেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই স্পষ্ট হয়ে যায়, ট্রাম্প পরিচালিত, সুশৃঙ্খল কোরিওগ্রাফির অংশ হিসেবেই এ দৃশ্যগুলো ধারণ করা হয়েছে।
এরপর ভেতরে চলে যান মাস্কহীন ট্রাম্প। ফেরেন একজন ক্যামেরাম্যানকে সঙ্গে নিয়ে। এ সময়ও তাঁর মুখে মাস্ক ছিল না। পরে টুইটার ভিডিওতে ট্রাম্পকে বলতে শোনা যায়, ‘করোনাকে আপনাদের জীবনের রাশ হাতে নিতে দেবেন না! একে ভয় পাবেন না। আপনি একে পরাজিত করবেন। আমাদের সেরা মেডিক্যাল সরঞ্জাম রয়েছে। সম্প্রতি সেরা ওষুধও তৈরি করেছি আমরা।’ যদিও করোনা আক্রান্তদের জন্য সাধারণ যে নির্দেশনা রয়েছে তার ছিটেফোঁটাও তিনি নিজেই মানেননি। যুক্তরাষ্ট্রের দুই লাখ ১০ হাজার মানুষ করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন। অভিযোগ রয়েছে, ট্রাম্পের ব্যবস্থাপনা ত্রুটির কারণেই এই দুরবস্থা বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী হিসেবে পরিচিত দেশটি। ওই টুইটে ট্রাম্প আরো বলেন, ‘আমি যা করছি বিশ্বের কোনো নেতাই তা করতে পারবেন না। জানি, ঝুঁকি আছে। ভয় আছে। তবে আমি এখন অনেক ভালো আছি। আমার রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা হয়তো ভালো। আমি জানি না। তবে আপনাদের জীবনের রাশ এর হাতে তুলে দেওয়া যাবে না। বাইরে বের হন। সাবধানে থাকুন।’ তিনি আরো বলেন, ২০ বছর আগের চেয়েও এখন তিনি টগবগে বোধ করছেন।
ভোটের মাসখানেক আগের এই ঘটনাকে ট্রাম্প-শিবির ‘অক্টোবর সারপ্রাইজ’ বলে চালাতে চাইলেও, চিকিৎসকদের একাংশ কিন্তু ট্রাম্পের এই আচরণে বিরক্ত। প্রেসিডেন্ট নিজেই কভিড-প্রটোকল ভেঙেছেন বলে অভিযোগও আনলেন অনেকে। হাসপাতালে ট্রাম্পের চিকিৎসায় নিযুক্ত চিকিৎসক জেমস পি ফিলিপস বলেছেন, ‘পুরোটাই রাজনীতির নাটক। নেহাতই পাগলামি। তাঁর সংস্পর্শে আসা গোয়েন্দা সংস্থার সবাইকে ১৪ দিনের কোয়ারেন্টিনে যেতে হবে। তাঁরা অসুস্থ হতে পারেন, মৃত্যুও হতে পারে। কে দায় নেবে!’ গবেষণা প্রতিষ্ঠান আমেরিকান থিংক ট্যাংকের সভাপতি নীরা ট্যান্ডন বলেন, ‘কোনো সাধারণ মানুষ এতটা স্বার্থপর হবে, আমি সেটাই কল্পনা করতে পারি না। আর তিনি যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট। আমাদের রক্ষার দায়িত্ব তাঁর।’
ডেমোক্রেটিক পার্টির প্রার্থী জো বাইডেন প্রেসিডেন্ট সুস্থ হয়ে ওঠায় সন্তুষ্টি প্রকাশ করলেও বিস্মিত হয়েছেন তাঁর টুইট দেখে। বাইডেন বলেন, ‘মাস্ককে তিনি গোনার মধ্যেই ধরেন না। কিন্তু মাস্ক একটি বিষয়। এটি জীবন বাঁচায়।’
তবে সবাই যে ট্রাম্পের সমালোচনা করছে, তেমন নয়। যুক্তরাষ্ট্রের সংক্রামক রোগ বিষয়ক সর্বোচ্চ কর্মকর্তা অ্যান্থনি ফাউচি প্রেসিডেন্টের স্বাস্থ্য নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, ‘প্রেসিডেন্টের শারীরিক অবস্থার উন্নতি স্বস্তিকর। তবে রোগের যে পর্যায়ে তিনি রয়েছেন তা যেকোনো সময় বিপর্যয়কর হয়ে উঠতে পারে।’
এসব কি শুধুই ভোটের টানে! জনপ্রিয়তার নিরিখে বাইডেনের থেকে অনেকটাই পিছিয়ে ট্রাম্প। তার ওপর করোনা আক্রান্ত হওয়ার কারণে প্রচারও মাথায় উঠেছে। অনেকে বলছেন, সব মিলিয়ে ভোটের মুখে তৈরি হওয়া হতাশার জন্যই এমন দায়িত্বজ্ঞানহীনের মতো আচরণ করলেন প্রেসিডেন্ট। সূত্র : বিবিসি, গার্ডিয়ান, এএফপি, সিএনএন।