ঢাকায় ফরেন কমার্শিয়াল সার্ভিস অফিস খুলছে যুক্তরাষ্ট্র

Published: 7 October 2020

বিশেষ সংবাদদাতা , ঢাকা ।। বাংলাদেশের সঙ্গে বিদ্যমান অর্থনৈতিক সম্পর্ক আরও জোরদার করতে ঢাকায় ফরেন কমার্শিয়াল সার্ভিস অফিস খুলছে যুক্তরাষ্ট্র

এ নিয়ে বাংলাদেশ সরকারের নীতি নির্ধারণী পর্যায়ের প্রতিনিধিদের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র সরকারের নীতি নির্ধারকদের বিস্তৃত আলোচনা হয়েছে। ঢাকা ওয়াশিংটনের ওই প্রস্তাবকে স্বাগত জানিয়েছে। গত ৩০শে সেপ্টেম্বর সর্বশেষ যুক্তরাষ্ট্র ও বাংলাদেশের মধ্যকার অর্থনৈতিক অংশীদারিত্ব একটি ভাচ্যুয়াল বৈঠকে এ নিয়ে আলোচনা হয়। ওই বৈঠকে মার্কিন প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দেন দেশটির অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, জ্বালানি ও পরিবেশ বিষয়ক আন্ডার সেক্রেটারি, কিথ ক্র্যাখ এবং বাংলাদেশ প্রতিনিধি দলের নেতৃত্বে ছিলেন প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ বিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান এমপি। ওই বৈঠক বিষয়ে মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্টে মুখপাত্রের দপ্তর প্রচারিত যৌথ বিবৃতিতে বলা হয়, উচ্চ পর্যায়ের এই দুই বিশিষ্ট ব্যক্তি যৌথভাবে বৈঠকটির সভাপতিত্ব করেন। যুক্তরাষ্ট্র ও বাংলাদেশের মধ্যকার অর্থনৈতিক অংশীদারিত্ব এগিয়ে নেয়ার লক্ষ্য বিষয়ক যৌথ বিবৃতিতে মোটা দাগে মুক্ত ও অবাধ ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্যিক সম্পর্ক জোরদারে অঙ্গীকারের বিষয়টি ফোকাস করা হয়। এতে বলা হয়, নতুন অর্থনৈতিক কর্মকা- সৃষ্টিতে যুক্তরাষ্ট্রের ইউএসটিডিএ এবং দেশটির এক্সপোর্ট-ইমপোর্ট ব্যাংকের মাধ্যমে বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক বিনিয়োগ ও চুক্তির জন্য উপযোগী পরিবেশ তৈরি হতে পারে।

ঢাকায় প্রস্তাবিত যুক্তরাষ্ট্রের বৈদেশিক বাণিজ্যিক সেবা অফিস খোলার আগ্রহকে বাংলাদেশ স্বাগত জানিয়েছে বলেও বিবৃতিতে উল্লেখ করা হয়। বলা হয়, শুল্ক প্রশাসন, কৃষি এবং অন্যান্য বাণিজ্য খাতে ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা, আঞ্চলিক সংযোগ এবং বাণিজ্য নীতি ও কর্মপদ্ধতি বিষয়ে সচেতনতা ও স্বচ্ছতাসহ বাংলাদেশের ব্যবসায়িক পরিবেশকে আরো উন্নত করার ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখতে পারে এমন একটি ইউএসএআইডি প্রকল্প চলমান রাখায় যুক্তরাষ্ট্রকে সাধুবাদ জানায় ঢাকা। বিবৃতিতে শক্তিশালী অর্থনৈতিক অংশীদারিত্ব ও দৃঢ়তর বন্ধন বিষয়ে বলা হয়- ৩০ শে সেপ্টেম্বরের ভাচ্যুয়াল বৈঠকে অংশগ্রহণকারীরা বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র ও বাংলাদেশ উভয়েরই একটি মুক্ত, অবাধ, অন্তর্ভুক্তিমূলক, শান্তিপূর্ণ ও নিরাপদ ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলের স্বপ্ন রয়েছে। যেখানে সকলের সমৃদ্ধি নিশ্চিত হবে। অংশগ্রহণকারীরা আশাবাদ ব্যক্ত করেন যে, এই লক্ষ্য অর্জনে ঢাকা-ওয়াশিংটন একত্রে কাজ চালিয়ে যাবে। বৈঠকের সভাপতিদ্বয় কোভিড-১৯ মহামারীর ফলে সৃষ্ট বৈশ্বিক অর্থনৈতিক বাধা-বিঘœ অতিক্রম করার ক্ষেত্রে দ্বিপক্ষীয় সহযোগিতার প্রতি গুরুত্বারোপ করেন। তারা টেকসই সরবরাহ ব্যবস্থা তৈরি ও অধিক কর্মসংস্থান সৃষ্টির উদ্দেশ্যে যুক্তরাষ্ট্র এবং বাংলাদেশের মধ্যকার অর্থনৈতিক অংশীদারিত্বকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া এবং এর মাধ্যমে এই দুই বন্ধুভাবাপন্ন রাষ্ট্রের সম্পর্ক আরো জোরদার করার সদিচ্ছা প্রকাশ করেন। বিবৃতিতে নিরাপদ অর্থনীতির জন্য জনস্বাস্থ্য ক্ষেত্রে সহযোগিতা জোরদার করার তাগিদও দেয়া হয়। বলা হয়, দ্রুত অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারে নারী- শিশুসহ, জনশক্তি ও সাধারণ জনগণের জন্য অধিকতর সুরক্ষার প্রয়োজন হবে। আর এ জন্য দ্বিপক্ষীয় এবং বৈশ্বিক সহযোগিতাকে আরো জোরদার করতে হবে। জনস্বাস্থ্য বিষয়ক প্রস্তুতি নিশ্চিত করতে একটি যৌথ জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ সেবা দল গঠনের সুপারিশও করা হয়। বলা হয়, দলটি অনতিবিলম্বে এবং পরবর্তীতে নিয়মিতভাবে বৈঠক করবে; এবং চিকিৎসা শিক্ষা, দক্ষতা বৃদ্ধি, প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা, বয়ঃসন্ধিকালীন স্বাস্থ্য ইত্যাদি বিষয়ে দ্বিপক্ষীয়, আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক সহযোগিতা জোরদারের উপায় খুঁজবে। সেবা দলের তৈরি কৌশল পারস্পরিক আদান প্রদানের মাধ্যমে কোভিড-১৯ বিষয়ক তথ্য ঘাটতি কমিয়ে আনা সম্ভব হবে। চাহিদা বৃদ্ধি ও প্রবৃদ্ধি পুনরুদ্ধারে বিনিয়োগ- বিষয়ে বিবৃতিতে বলা হয়, কোভিড-১৯ পরবর্তী পুনরুদ্ধার কৌশল পর্যালোচনায় বাংলাদেশ পক্ষ জানিয়েছে, কৃষি প্রক্রিয়াজাতকরণ, কৃষি বাণিজ্য ও পাট সম্পদ খাতে যুক্তরাষ্ট্রের বিনিয়োগ ও প্রযুক্তির ব্যবহার সুফল বয়ে আনতে পারে। এর মাধ্যমে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা ছাড়াও পরিবেশের ক্ষতি কমানো সম্ভব হবে। উভয় পক্ষ মনে করে, এ ক্ষেত্রে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিগত বিষয়ে সহযোগিতার প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে যাতে, একুশ শতকের কৃষি চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করা যায় এবং গ্রাহকের চাহিদা পূরণ সম্ভব হয়। ট্রেড অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট কো-অপারেশন ফোরাম এগ্রিমেন্ট টিকফা কাউন্সিল সভায় বাংলাদেশ পক্ষ আগেই বলেছে, যে দেশের অর্থনৈতিক এলাকাগুলোতে মার্কিন কোম্পানির বিনিয়োগকে ঢাকা স্বাগত জানাবে। প্রতিযোগিতামূলক অর্থ পরিশোধের পদ্ধতি এবং বীমা বাজার উদারীকরণের মত চলমান সংস্কার প্রক্রিয়া বিষয়ে অংশীদারদের মধ্যে আলোচনার উদ্যোগ গ্রহণ, বর্তমানে সহজলভ্য সকল বিধিমালা ও বিলগুলোর ইংরেজি অনুবাদ প্রকাশ এবং উৎসে মুনাফা পাঠানোর ক্ষেত্রে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা নিরসনসহ যুক্তরাষ্ট্র ভিত্তিক বৈদেশিক সরাসরি বিনিয়োগের জন্য পরিবেশের অব্যাহত উন্নতির লক্ষ্যে সংস্কার প্রক্রিয়া বাস্তবায়নের গুরুত্ব তুলে ধরা ধরে বিবৃতিতে বলা হয়, সরকারী ক্রয় বিধিমালা অনুসরণ এবং ন্যায্য ক্রয় প্রক্রিয়া বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য ও বিনিয়োগ সম্প্রসারণের ভূমিকা রাখবে। বিবৃতি মতে, টেকসই অবকাঠামো উন্নয়ন, দায়িত্বশীল ও স্বচ্ছ অর্থায়ন চর্চা এবং সকলের জন্য আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সেরা চর্চাগুলো অনুসরণ গুরুত্বপূর্ণ। তাছাড়া ভোক্তাদের নকল বা লাইসেন্সবিহীন পণ্যের ঝুঁকি থেকে রক্ষা করার জন্য কার্যকর আমদানি ও রপ্তানি ব্যবস্থার গুরুত্বের বিষয়টি বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্র আলোচনায় উঠে এসেছে। আইএলও’র সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে বাংলাদেশ শ্রম আইন, বাংলাদেশ শ্রম বিধিমালা এবং রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল আইনসহ শ্রম খাতের সংস্কার প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখার তাগিদও দেয়া হয়েছে সাম্প্রতিক বৈঠকে।

বিবৃতি মতে, উভয় পক্ষই তুলা ও সংশ্লিষ্ট পণ্যের স্থিতিশীল দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যে তাঁদের পারস্পরিক আগ্রহ প্রকাশ করেন এবং উভয় সরকারকে এই বিষয়ে কাজ অব্যাহত রাখতে উৎসাহিত করেন। সর্বশেষ ঢাকা-ওয়াশিংটন বৈঠকে অংশগ্রহণকারীরা বাণিজ্য ও যোগাযোগ তরান্বিতকরণে নির্ভরযোগ্য ও নিরাপদ ইন্টারনেটের গুরুত্ব তুলে ধরেন। তথ্য ও উপাত্তের আন্তর্দেশীয় প্রবাহ সহজতর করতে একটি নিরাপদ ও নির্ভরযোগ্য নেটওয়ার্ক ভিত্তিক উদ্ভাবনী ডিজিটাল পরিবেশের ওপরও তাঁরা গুরুত্বারোপ করেন। ফোর-জি সংযোগের আরো সম্প্রসারণ এবং ফাইভ-জি নেটওয়ার্ক ও সেবা উন্নয়নের লক্ষ্যে উভয় দেশ যখন আরো অগ্রসর হচ্ছে এমন প্রেক্ষাপটে অংশগ্রহণকারীরা উভয় দেশের সরকারকে টেলিযোগাযোগ নিরাপত্তার জন্য তথ্য বিনিময় বিষয়ে একটি উচ্চপর্যায়ের সংলাপে উৎসাহিত করেন। বৈঠকে অংশগ্রহণকারীরা যুক্তরাষ্ট্রের ডিপার্টমেন্ট অফ কমার্সের কমার্শিয়াল ল ডেভেলপমেন্ট প্রোগ্রাম কর্তৃক এই বিষয়ক আইন ও নীতিমালা বিষয়ে বাংলাদেশকে দেয়া কারিগরি সহযোগিতার প্রশংসা করেন।

সমুদ্রভিত্তিক অর্থনীতিতে সহযোগিতা বৃদ্ধি

যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে ২০১৯ সালে তৃতীয় ইন্ডিয়ান ওশান রিম অ্যাসোসিয়েশন ব্লু ইকোনমি মিনিস্টেরিয়াল কনফারেন্স আয়োজনের জন্য বাংলাদেশের প্রশংসা করা হয়। উভয় পক্ষই ব্লু ইকোনমি বা সমুদ্রভিত্তিক অর্থনীতির জন্য সুসংহত বিজ্ঞান, উদ্ভাবনী ব্যবস্থাপনা, কার্যকর প্রয়োগ, অর্থপূর্ণ অংশীদারিত্ব এবং জনগণের সক্রিয় অংশগ্রহণের মতো প্রতিটি বিষয়কে সমুদ্রভিত্তিক অর্থনীতির ভবিষ্যত সম্ভাবনা বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসাবে তুলে ধরেন। বৈঠকে আশাবাদ ব্যক্ত করা হয় যে, উভয় সরকার জ্ঞান, উপাত্ত ও নতুন ধারণা, বৃহত্তর সক্ষমতা সৃষ্টি এবং পেশাগত সহযোগিতা জোরদারদারকরণের মাধ্যমে একটি সমন্বিত সমুদ্রভিত্তিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গঠনের লক্ষ্যে একত্রে কাজ করবে। বাংলাদেশ পক্ষ আশা প্রকাশ করে যে, যুক্তরাষ্ট্র সরকার বাংলাদেশ সরকারকে কৃত্রিম উপগ্রহ ভিত্তিক মৎস্য শনাক্তকরণ প্রযুক্তি এবং মৎস্য/সামুদ্রিক খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ প্রযুক্তি প্রদান করবে।

যুক্তরাষ্ট্রের তরফে এগ্রিমেন্ট অন পোর্ট স্টেট মেজারস শীর্ষক আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের একটি পক্ষ হিসাবে যোগদানের জন্য বাংলাদেশ সরকারের প্রশংসা করা হয়। এর মাধ্যমে বেআইনি, অজ্ঞাত ও অনিয়ন্ত্রিত মাছ ধরা প্রতিরোধে যুক্তরাষ্ট্র, বাংলাদেশ ও অন্যান্য পক্ষ উপকৃত হবে বলে জানানো হয়।

জ্বালানি ও বাংলাদেশের উজ্জ্বলতর ভবিষ্যৎ নিশ্চিতকরণ

বৈঠকে আঞ্চলিক সংযোগ উন্নয়নে জ্বালানি নিরাপত্তার গুরুত্ব ও বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে স্থিতিশীল বিদ্যুৎ ব্যবস্থার গুরুত্বের বিষয়টি তুলে ধরা হয়। বাংলাদেশের তরফে এই খাতে এশিয়া এজ শীর্ষক সম্পূর্ণ সরকারী উদ্যোগের আওতায় যুক্তরাষ্ট্রের ডিপার্টমেন্ট অফ স্টেট, এনার্জি, কমার্স এবং ইউএসএআইডির সহায়তাকে স্বাগত জানানো হয়। বাংলাদেশে জ্বালানি উৎপাদনের ক্ষেত্রে কার্যকর ও দূষণমুক্ত প্রাথমিক জ্বালানি হিসাবে এলএনজি’র ব্যবহার প্রসারের সম্ভাবনা যাচাইয়ে দুই রাষ্ট্রের সংশ্লিষ্ট অংশীদারদের একত্রে কাজ করার জন্য উৎসাহিত করা হয়। বৈঠকে বাংলাদেশে এলএনজি’র ব্যবহার প্রসারের প্রাথমিক পর্যায়ে এক্সেলারেট এনার্জি ও শেনিয়ার এনার্জির মত যুক্তরাষ্ট্রের কিছু কোম্পানির ভূমিকার প্রশংসা করা হয়। যুক্তরাষ্ট্রের তরফে এ ইস্যুতে দুই দেশের সহযোগিতা ক্রমান্বয়ে আরো বৃদ্ধি পাবে বলে দৃঢ় আশাবাদ ব্যক্ত করা হয়। জানানো হয়, যুক্তরাষ্ট্রে উৎপাদিত এলএনজি’র প্রথম চালান ইতোমধ্যে বাংলাদেশে রপ্তানি করা হয়েছে। একই সঙ্গে বলা হয় যে, বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলে মহেশখালী দ্বীপে ৩,৬০০ মেগাওয়াট শক্তিসম্পন্ন একটি কমবাইন্ড সাইকেল বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের জন্য ২০১৮ সালে সমঝোতা স্মারক সাক্ষরিত হয়েছে। উভয়ের তরফে কাজটি অব্যাহত রাখার আশাবাদও ব্যক্ত করা হয়। বৈঠকে যুক্তরাষ্ট্রের জ্বালানি কোম্পানিগুলোর সাথে বাণিজ্যিক সম্পর্ক স্থাপন; আরো সাশ্রয়ী, দক্ষ ও টেকসই জ্বালানি ব্যবস্থা ত্বরান্বিত করতে সম্ভাব্য ক্ষেত্রগুলোতে যুক্তরাষ্ট্রের পণ্য ও সেবার ব্যবহার বৃদ্ধি; এবং বাংলাদেশে নির্ভরযোগ্য ও সাশ্রয়ী জ্বালানী সরবরাহ প্রাপ্তির সুযোগ ত্বরান্বিত করতে জ্বালানি খাতে একটি স্থায়ী সংলাপ আয়োজনের সম্ভাব্যতা খুঁজে দেখার বিষয়ে আলোচনা করা হয়। বলা হয়, যুক্তরাষ্ট্র ও বাংলাদেশ পক্ষে এই সংলাপের নেতৃত্ব দিতে পারে যথাক্রমে যুক্তরাষ্ট্র সরকারের ডিপার্টমেন্ট অফ কমার্স এবং বাংলাদেশের বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়। আরো বলা হয়, যুক্তরাষ্ট্রের ডিপার্টমেন্ট অফ কমার্স বিভাগ এশিয়া এজ এনার্জি ইন্ডাস্ট্রি ওয়ার্কিং গ্রুপ নেটওয়ার্কের অংশ হিসাবে যুক্তরাষ্ট্র-বাংলাদেশ এনার্জি ইন্ডাস্ট্রি ওয়ার্কিং গ্রুপ গঠনের ঘোষণা দিয়েছে। এর ফলে একটি পূর্ণাঙ্গ সেবাকেন্দ্র বা ‘ওয়ান স্টপ শপ’ তৈরি হবে যার আওতায় যুক্তরাষ্ট্রের বেসরকারি খাত এশিয়া এজের আন্তঃসংস্থা কার্যক্রমে সক্রিয়ভাবে অংশ নিতে পারবে ও আঞ্চলিক বাজারগুলোর সাথে যুক্ত হওয়ার সুযোগ পাবে।নবায়নযোগ্য জ্বালানি প্রযুক্তির গুরুত্ব স্বীকারপূর্বক বাংলাদেশ পক্ষ উল্লেখ করেন যে, ন্যাশনাল রিনিউয়েবল এনার্জি ল্যাবের সাথে অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে ইউএসএআইডির বায়ু সম্পদ বিষয়ক গবেষণা সম্পন্ন করেছে। এই গবেষণার ফলে উন্নত জ্বালানি ব্যবস্থার প্রসার, জ্বালানি খাতে বেসরকারি বিনিয়োগ বৃদ্ধি এবং আঞ্চলিক বিদ্যুৎ বাণিজ্যের ক্ষেত্রে ইউএসএআইডি’র এশিয়া এজ কার্যক্রমের আওতায় ১৫ মিলিয়ন ডলার সমমূল্যের কর্মকাণ্ড বাস্তবায়নের পরিকল্পনা বাস্তবায়নসহ বাংলাদেশের মোট বিদ্যুৎ সরবরাহের দশ শতাংশ নবায়নযোগ্য উৎস থেকে উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা পূরণে সহায়ক হবে। বাংলাদেশ পক্ষ আরো উল্লেখ করেন যে, যুক্তরাষ্ট্রের ডিপার্টমেন্ট অফ স্টেট ব্যাটারি স্টোরেজ ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড এডপশন প্রোগ্রামের আওতায় বাংলাদেশের জাতীয় গ্রিডে বিদ্যুৎ ধারণক্ষমতা বৃদ্ধির গুরুত্ব নিরূপণে এবং সাউথ এশিয়া কার্বন ক্যাপচার প্রকল্পের আওতায় জীবাশ্ম জ্বালানির পরিবেশগত প্রভাব হ্রাসে বাংলাদেশকে সহায়তা প্রদানের ঘোষণা দিয়েছে।

সংযোগ জোরদারকরণ

বৈঠকে অংশগ্রহণকারীরা সাধুবাদের সাথে উল্লেখ করেন যে, যুক্তরাষ্ট্র ও বাংলাদেশ সরকার যুক্তরাষ্ট্র-বাংলাদেশ ওপেন স্কাইস এয়ার ট্রান্সপোর্ট চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছে। বাংলাদেশ পক্ষ আশা প্রকাশ করেছে যে, যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল এভিয়েশন অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (ঋঅঅ) এবং সিভিল এভিয়েশন অথরিটি অফ বাংলাদেশের মধ্যে অব্যাহত ইতিবাচক সম্পর্কের আন্তর্জাতিক বিমান পরিবহন নিরাপত্তা মূল্যায়ন কর্মসূচিতে ক্যাটাগরি-১’এ অবস্থান ফিরে পেতে বাংলাদেশের প্রচেষ্টাকে সহায়তা করবে। বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের জন্য যুক্তরাষ্ট্রে বিরতিহীন যাত্রীসেবা পুনরায় চালু করার ক্ষেত্রে এটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। এই যৌথ সম্পৃক্ততা ইন্টারন্যাশনাল সিভিল এভিয়েশন অর্গানাইজেশন কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত নিরাপত্তা মান অনুযায়ী বিমান চলাচল বিষয়ে একটি কার্যকর নিরাপত্তা তত্ত্বাবধান ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা ও বাস্তবায়নে ঈঅঅই’র প্রচেষ্টার জন্য সহায়ক হবে। বাংলাদেশ পক্ষ বলেছে যে, বাংলাদেশ সরকার হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরকে ট্রান্সপোর্টেশন সিকিউরিটি অ্যাডমিনিস্ট্রেশন কর্তৃক সর্বশেষ উড্ডয়ন বিমানবন্দর হিসাবে দেখতে আগ্রহী। সভায় আশাবাদ ব্যক্ত করা হয় যে, এসব লক্ষ্য অর্জনে উভয় দেশের সরকার অব্যাহতভাবে একত্রে কাজ করবে এবং এর ফলে দুই দেশের মধ্যে যোগাযোগ ব্যবস্থা আরো উন্নত হবে।

বৈঠকে বাংলাদেশের জাতীয় পতাকাবাহী বিমান সংস্থা বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স (বিমান) এবং বোয়িং-এর মধ্যে দীর্ঘকালীন অংশীদারিত্বের কথা উল্লেখ করা হয়। ২০০৮ সালের একটি চুক্তির পর বিমানের কাছে ১০টি বাণিজ্যিক বোয়িং বিমান সরবরাহের প্রশংসা করা হয়।

ডেল্টা প্লান এবং অন্যান্য প্রসঙ্গ
অর্থনৈতিক অংশীদারিত্ব বিষয়ক ভার্চ্যুয়াল বৈঠকে ডেল্টা প্লান এবং অন্যান্য প্রসঙ্গ নিয়েও কথা হয়। যৌথ বিবৃতি মতে, বৈঠকে বাংলাদেশ পক্ষ সরকারের ডেল্টা প্লান- ২১০০ তুলে ধরে দেশের অভ্যন্তরীণ জলপথ ব্যবস্থাপনায় উন্নতমানের ড্রেজার ক্রয় করবে বলে জানায়। বাংলাদেশের প্রচেষ্টাকে সাধুবাদ জানিয়ে ড্রেজিং বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সেরা চর্চা এবং সর্বাধুনিক প্রযুক্তি প্রত্যক্ষ করার জন্য ২০২১ সালে ঢাকার সরকারি ও বেসরকারি খাতের কর্মকর্তাদের একটি প্রতিনিধি দলকে যুক্তরাষ্ট্র সফরের প্রস্তাব করে। জবাবে বাংলাদেশ এ খাতে যুক্তরাষ্ট্রের স্বনামধন্য কোম্পানিগুলোর দরপত্র অংশগ্রহণ কামনা করে সরকার সবার জন্য সমান ক্ষেত্র নিশ্চিত করবে বলে জানায়। বাংলাদেশ পক্ষ চট্টগ্রাম বন্দরে যানজট কমাতে ও পদ্ধতিগত উন্নয়নে বাংলাদেশ সরকারের বিভিন্ন পদক্ষেপের বিবরণ দেয়। জানায়, বাংলাদেশ সরকার যুক্তরাষ্ট্র ভিত্তিক কন্টেইনার ব্যবস্থাপনা প্রতিষ্ঠান ঈগল-রেল কর্তৃক প্রযুক্তিগত-অর্থনৈতিক সম্ভাব্যতা যাচাই জরিপ বিষয়ে একটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করেছে। এর আওতায় চট্টগ্রাম বন্দরে স্বয়ংক্রিয় ওভারহেড কন্টেইনার ব্যবস্থাপনা প্রক্রিয়া উন্নয়নের মাধ্যমে জট কমানো, দূষণ হ্রাস এবং বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ এই বন্দরের ক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য একটি পরীক্ষামূলক প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হবে। বাংলাদেশ রেলওয়ের জন্য দেশের পূর্ব ও পশ্চিম উভয় অঞ্চলে মিটার গেজসম্পন্ন রেলপথে ব্যবহারের উদ্দেশ্যে ৭০টি লোকোমোটিভ বা ইঞ্জিন কিনতে অর্থ মন্ত্রণালয় কর্তৃক একটি অর্থায়ন চুক্তি সম্পন্ন করায় যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশ সরকারের ভূয়সী প্রশংসা করে। বাংলাদেশ ও ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলের প্রতিবেশী দেশগুলোর মধ্যে আঞ্চলিক যোগাযোগ বৃদ্ধির লক্ষ্যে ২৩৯ মিলিয়ন ডলার প্রকল্পের নকশা প্রণয়ন ও জটিল যন্ত্রাংশ সরবরাহ করবে প্রগ্রেস রেল নামে যুক্তরাষ্ট্রের একটি কোম্পানি। বৈঠকে বলা হয়, বাংলাদেশে নিরাপদ ও সুদক্ষ রেল ব্যবস্থা গড়ে তোলার প্রয়াসে যুক্তরাষ্ট্র নেতৃস্থানীয় বিশেষজ্ঞ ও সরঞ্জাম সরবরাহকারীদের সমন্বয়ে একটি প্রশিক্ষণ কর্মসূচী চালু করার পরিকল্পনা করছে। বৈঠকে কোভিড-১৯ পরিস্থিতি নিয়েও কথা হয়। বলা হয়, ভবিষ্যৎ অর্থনৈতিক ধাক্কা মোকাবেলায় বাংলাদেশের সক্ষমতা আরো বাড়ানো জরুরী। এক্ষেত্রে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে জনগণের বৃহত্তর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার জন্য আরো দৃঢ় অর্থনৈতিক ভিত্তি তৈরি করতে হবে। বৈঠকে বলা হয়, শ্রমিকদের অধিকার সুরক্ষা; রোহিঙ্গা সংকটে ক্ষতিগ্রস্ত নাজুক বাংলাদেশী সম্প্রদায়ের জন্য অব্যাহত সহায়তা প্রদান এবং পানি ও জ্বালানী নিরাপত্তা, টেকসই বাণিজ্য ও বিনিয়োগ, কৃষি, বনজ সম্পদ এবং মৎস্য আহরণ নিশ্চিত করতে প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবস্থাপনা উন্নয়নে সমন্বয় জোরদার করা। অংশগ্রহণকারীরা সাম্প্রতিক সময়ে উভয় দেশের সরকারের মধ্যে ও বাইরে উচ্চ পর্যায়ের এবং বিশেষত বাংলাদেশের জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী ‘মুজিব বর্ষে’ (১৭ মার্চ ২০২০ থেকে ২৬ মার্চ ২০২১) যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড জে ট্রাম্প এবং বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মধ্যে ক্রমবর্ধমান উষ্ণ আদান-প্রদানের প্রশংসা করেছেন। অংশগ্রহণকারীরা আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন যে, এই দুই বন্ধুত্বপূর্ণ সরকার রাজনৈতিক এবং উর্ধ্বতন সরকারী পর্যায়ে সহযোগিতা আরো গভীর ও মজবুত করবে। কোভিড-১৯’র চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করার উপায় এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার পুনরুদ্ধার বিষয়েও তারা একসাথে কাজ করবে বলে সভায় আশা প্রকাশ করা হয়।

ভার্চুয়াল বৈঠকটি বন্ধুত্বপূর্ণ এবং সৌহার্দ্যপূর্ণ পরিবেশে অনুষ্ঠিত হয় জানিয়ে যৌথ বিবৃতিতে বলা হয়, অংশগ্রহণকারীরা এই আশাবাদ ব্যক্ত করে সভার উপসংহার টানেন যে, উভয় সরকার আগামী দিনগুলোতে যুক্তরাষ্ট্র-বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অংশীদারিত্বকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার লক্ষ্যে সুদৃঢ় পদক্ষেপ নেবে এবং বিভিন্ন প্রাতিষ্ঠানিক ও অন্যান্য পদ্ধতির মাধ্যমে অর্থবহ সহযোগিতায় নিয়োজিত থাকবে।