ঘুরে দাঁড়ানোর সময় দরকার কল্যাণকামী উন্নয়ন
।। ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ ।।
মহামারিতে বাংলাদেশের অর্থনীতির ঘুরে দাঁড়ানোর কথা বলা হচ্ছে। কিন্তু এর সুফলটা কি সাধারণ মানুষকে স্পর্শ করছে? এর খুব ভালো জবাব পাওয়ার কথা নয়। তাই এই ঘুরে দাঁড়ানোর পদক্ষেপ গ্রহণে সতর্কতা অবলম্বনের প্রয়োজন রয়েছে। এর পাশাপাশি উন্নয়নযাত্রায় দৃষ্টিভঙ্গির প্রসারতারও প্রয়োজন রয়েছে। সেটা হচ্ছে উন্নয়নকে সাধারণ মানুষের কাছে নিয়ে যাওয়া, কল্যাণকামী করা, টেকসই করা। এ জন্য জিডিপি, রিজার্ভ বৃদ্ধি, রেমিট্যান্সের রেকর্ড—এসব বড় তথ্য-উপাত্তের দিকে নজর দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সাধারণ মানুষের ওপর এগুলোর কেমন প্রভাব পড়ছে সেদিকে নজর দেওয়া জরুরি।
সাত-আট মাস ধরে চলা কভিড-১৯ মহামারির মধ্যে বাংলাদেশের বর্তমান অভ্যন্তরীণ ও বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জের পরিপ্রেক্ষিতে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বিবেচনা করা উচিত আমাদের অর্থনীতি কোন পর্যায়ে রয়েছে কিংবা কতটুকু এগিয়ে যাচ্ছে। উন্নয়নের ক্ষেত্রে বরাবরই বাংলাদেশের বড় অভ্যন্তরীণ চ্যালেঞ্জ হচ্ছে ভঙ্গুর স্বাস্থ্য খাত। এর মধ্যে যুক্ত হয়েছে কভিড, যা সব কিছু তছনছ করে দিয়েছে। এই কভিডের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে মৃত্যুহার কমেছে। এই পরিসংখ্যান নিয়ে প্রশ্ন থাকলেও মানুষের মধ্যে যে কভিডভীতি কমেছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। এরই মধ্যে লোকজন স্বাভাবিক জীবনযাত্রায় আসতে শুরু করেছে। এর সঙ্গে সঙ্গে মানুষের মধ্যে সচেতনতাও কমে গেছে, যার বড় প্রমাণ মাস্ক পরায় মানুষের আগ্রহ কমে যাওয়া। তবে এর একটা ভালো দিক হলো, লোকজন অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড শুরু করেছে নিজ উদ্যোগে, যা অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াতে সাহায্য করছে; যদিও কভিডের সংক্রমণ বাড়ার ঝুঁকিটা রয়ে যাচ্ছে এবং ভবিষ্যতে তা আরো ছড়াতে পারে—এ আশঙ্কা ব্যক্ত করা হচ্ছে।
এখন অর্থনীতি চাঙ্গা করার প্রচেষ্টার মধ্যে সরকারকে কভিড সংক্রমণ বৃদ্ধির আশঙ্কাটি ভুলে গেলে চলবে না। জীবিকার পথ খোলা রাখতে গিয়ে ঝুঁকিটা দীর্ঘ সময়ের জন্য নিচ্ছি কি না সেটা ভাবতে হবে। এই পরিস্থিতিতে শুধু কভিড চিকিত্সা নয়, পুরোপুরি চিকিত্সাব্যবস্থাকেই ঢেলে সাজাতে হবে। কারণ এর সঙ্গে কর্মসংস্থান, সামাজিক নিরাপত্তা, বাণিজ্য, শিল্প, কৃষি ও শিক্ষার মতো বিষয়গুলো জড়িত রয়েছে। এর মধ্যে রেমিট্যান্স বেড়েছে, পোশাক খাতে কিছুটা রপ্তানি বেড়েছে, কিছু মৌলিক নির্দেশক (বেসিক ইনডিকেটর) তথা সামষ্টিক সূচক বেড়েছে। সতর্কতার বিষয় হলো, এটা সাময়িকও হতে পারে। রেমিট্যান্সও যে বাড়তেই থাকবে, আমরা বলতে পারব না। করোনার যে বৈশ্বিক পরিস্থিতি, তাতে রপ্তানির ভবিষ্যত্ও বলতে পারব না। তবে সাম্প্রতিক সময়ে চামড়াজাত ও ওষুধ পণ্যের ব্যাপারে কিছুটা আশা জাগাচ্ছে। এসবের ওপর ভিত্তি করে অনেকে বলছেন, অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াচ্ছে বা ঘুরে দাঁড়িয়ে গেছে। সামষ্টিক অর্থনীতির সূচকে বলা যেতে পারে, দেশের অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াচ্ছে। আমরা সে স্পন্দনটা দেখতে পাচ্ছি, তবে আমাদের চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবেলা করতে হবে। এ জন্য ব্যাংকিং খাত ও পুঁজিবাজারে স্থিতিশীলতা বজায় রাখা এবং রপ্তানির সহায়তা দিয়ে যেতে হবে।
আমি মনে করি, আমাদের মোটাদাগে উন্নয়নের সংজ্ঞায় কতগুলো কল্যাণকামী পদক্ষেপ যুক্ত করতে হবে। কল্যাণমুখী রাষ্ট্রের জন্য দরকার মানবিক পদক্ষেপ। এখন অর্থনীতির ঘুরে দাঁড়ানোর সময় সাধারণ মানুষ তথা কৃষক, শ্রমিক এবং ছোট ছোট ব্যবসায়ী, যারা নিজেদের তাগিদে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে, তারা কতটা ভালো আছে সেটা দেখতে হবে। কিন্তু সামষ্টিক অর্থনীতির সূচকগুলো দিয়ে এই দেখা সম্ভব নয়। কারণ সামষ্টিক সূচকগুলোর অবস্থা কিন্তু সাধারণ মানুষের জীবনকে প্রতিফলিত করে না। এর আগেও করেনি। এখন আমরা ওই ফাঁদেই পড়ে গেছি যে সামষ্টিক অর্থনীতির সূচক নিয়ে স্বস্তিবোধ করা। কিন্তু মানুষের জীবনে এর সুফল কতটা পড়েছে সেটা ভাবছি না। তাই ম্যাক্রোলেভেল তথা ব্যষ্টিক পর্যায়ে, অর্থাত্ মানুষের জীবনযাত্রার মানে এসব সূচক প্রতিফলিত হচ্ছে কি না দেখতে হবে। কারণ জনকল্যাণ অর্থনীতির (ওয়েলফেয়ার ইকোনমিকসের) মূল কথা এটাই।
সামষ্টিক সূচকের দিকে বেশি দৃষ্টি দেওয়ার বড় ক্ষতির দিকটা হলো, মানুষের কোয়ালিটি অব লাইফের সূচক, যেমন—জনগণের সুরক্ষা, আইনের শাসন, যাতায়াতের ব্যবস্থা, পুষ্টি, মাতৃস্বাস্থ্য, চিকিত্সা—এসব বিষয় থেকে রাষ্ট্রের দৃষ্টি সরে যাওয়া। এই মুহূর্তে এসব মৌলিক চাহিদার নিশ্চয়তা কোথায়? এখন সেটা আমরা দেখছি না। কারণ কর্মসংস্থান বাড়েনি। পোশাক খাতে রপ্তানি আয় বেড়েছে ঠিক; কিন্তু এর বিপরীত চিত্র হচ্ছে ৭০ হাজার পোশাককর্মীর ছাঁটাইয়ের শিকার হওয়া। শ্রমিক সংগঠনগুলো বলছে, চাকরিহারা শ্রমিকের সংখ্যা আরো বেশি। ফলে সামষ্টিক অর্থনীতির সুবিধা কারা পাচ্ছে এটা কিন্তু স্পস্ট দেখা যাচ্ছে। তারা হলো সমাজের অপেক্ষাকৃত সচ্ছল মানুষ। তাই রপ্তানি বেড়ে যাওয়া নিয়ে গর্ব করার সময় এখনো আসেনি। দেশে কর্মসংস্থান বাড়েনি। দরিদ্র, নিম্নবিত্ত ও প্রান্তিক মানুষের আয় বাড়েনি। বরং অনেক জায়গায় আমি দেখেছি, লোকজনের মজুরি কমে গেছে, আয় কমে গেছে। কোনো রকমভাবে তারা টিকে আছে। লোকজন সঞ্চয় ভেঙে চলছে। তাদের ভবিষ্যত্ অনিশ্চিত অবস্থায় পড়ে গেছে। সবচেয়ে বড় বিষয়, দরিদ্র, নিম্নবিত্ত ও প্রান্তিক মানুষ আস্তে আস্তে উন্নয়নের সুফল থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। আর আমরা শুধু কতগুলো পরিসংখ্যান দিয়ে যাচ্ছি।
একদিকে কর্মসংস্থান বাড়েনি, অন্যদিকে বেকারের সংখ্যা আরো বাড়ছে। অর্থনীতি পুনরুদ্ধার প্যাকেজটা ঠিকমতো বাস্তবায়িত হচ্ছে না। বাস্তবায়নটা সঠিকভাবে হতে হবে। কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা না হলে অর্থনীতি পুনরুদ্ধার কঠিন হয়ে পড়বে। ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তা এবং কৃষকের কাছে এখনো ঋণ যাচ্ছে না। কয়েক দিন আগে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকেও এসব ঋণ বিতরণ না হওয়ায় সতর্কতা জারি করা হয়েছে। ছোট ব্যবসায়ীরা দ্বারে দ্বারে ঘুরে বেড়াচ্ছে, ঋণ পাচ্ছে না। অতএব কী করে বলা যায় যে অর্থনীতি টেকসই উন্নয়নের পথে ঘুরে দাঁড়াচ্ছে?
এই ঘুরে দাঁড়ানোটা হয়তো ঠিক আছে, বিশেষ করে প্রাথমিক অবস্থায় ঠিক আছে। কিন্তু এই ঘুরে দাঁড়ানো যদি টেকসই করতে হয়, ফলপ্রসূ করতে হয়, সাধারণ মানুষের উপকারের জন্য করা যায়, তাহলে কিন্তু দ্রুত সামষ্টিক সূচকের বাইরে তথাকথিত সূচক ও পরিসংখ্যানের বাইরে, বাংলাদেশ ব্যুরো অব স্ট্যাটিস্টিকসের তথ্যের বাইরে গিয়ে সাধারণ মানুষের আয় কমে যাওয়া, কর্মসংস্থান না বাড়া এবং ঋণ বিতরণ না হওয়ার মতো তথ্যগুলো বিবেচনা করতে হবে।
বিশ্বব্যাংক বলছে, আমাদের জিডিপি হবে ১.৬ শতাংশ। আবার তারা সেটা সংশোধন করে বলেছে ২ শতাংশ হবে। এডিবি বলছে, ৬.২ শতাংশ বাড়বে। আর বাংলাদেশ সরকার বলছে ৮.২ শতাংশ বাড়বে। সুতরাং প্রবৃদ্ধির নানা রকম তথ্য দেওয়া হচ্ছে। এগুলোর ওপর আমারও কিছু প্রশ্ন আছে। সূচকের বাইরে, পরিসংখ্যানের বাইরে গিয়ে আমি যে কতগুলো বিষয় বলেছি, মানুষের জীবনযাত্রার মান, সুশাসন, স্বাভাবিক জীবনের নিরাপত্তা—এগুলো নিয়ে ভাবতে হবে। সাম্প্রতিককালে দেখা যাচ্ছে, ধর্ষণ বেড়ে যাচ্ছে। এগুলো তো আগেও ছিল। এখন ব্যাপ্তিটা আগের চেয়ে বেড়ে গেছে। তরুণ ও কিশোরদের অপরাধও চিন্তার কারণ। এর সঙ্গে শিক্ষা, বিশেষ করে সুশিক্ষার প্রশ্ন জড়িত, যাতে টেকসই উন্নয়নের প্রশ্নটা আসে। বিশ্বমন্দা সত্ত্বেও আমরা বলছি, বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু আমাদের সতর্কতার বিষয়টা হলো, বাংলাদেশ তো বিশ্বব্যবস্থা থেকে বিচ্ছিন্ন কোনো দ্বীপ নয়। তবে আমি ব্যক্তিগতভাবে একেবারে নিরাশ নই। আমরা আসলে ঠিক জায়গা থেকে কিছুটা দূরে আছি। এখন সেটাকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে।
আমার বক্তব্য হলো, উন্নয়নের যে সংজ্ঞা, তাতে যদি শুধু সামষ্টিক অর্থনীতির সংজ্ঞাগুলোর দিকটি বিবেচনা করি, তাহলে হবে না। এখানে মানুষকে স্পর্শ করে যে জিনিসগুলো—জনগণের সুরক্ষা, আইনের শাসন এটা খুব গুরুত্বপূর্ণ এবং অন্য বিষয়গুলো যেটা আগেই উল্লেখ করা হয়েছে। বলা হচ্ছে, বর্তমান মূল্যস্ফীতির হার হচ্ছে ৬ শতাংশ। কিন্তু বাস্তবে কি মানুষ এতটা স্বস্তিতে আছে? প্রতিটি স্তরের প্রত্যেক মানুষকে জিজ্ঞেস করুন, তাদের জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়েছে কি না। সুতরাং বুঝতে হবে মূল্যস্ফীতির হার অনেক সময় পরিবার ও ব্যক্তি পর্যায়ের জীবনযাত্রাকে প্রতিফলিত করে না।
আমাদের মনে রাখতে হবে, ওয়েলফেয়ার সোসাইটি বা ওয়েলফেয়ার স্টেট বলতে আমরা যে স্ক্যানডিনেভিয়ান দেশগুলোকে বোঝাই, তারা ব্যষ্টিক অর্থনীতির সূচককে অনাবশ্যক গুরুত্ব দেয় না। জনগণের জীবনযাত্রা ও সুরক্ষাই তাদের কাছে আসল। সামাজিক নিরাপত্তা, মানুষের কোয়ালিটি অব লাইফ—এগুলো হলো সত্যিকার উন্নয়ন। যেটাকে আমরা বলি টেকসই উন্নয়ন।
মোদ্দা কথা, অতি আশাবাদ কিংবা তথাকথিত পরিসংখ্যানগুলো বাদ দিলেও বাংলাদেশের অর্থনীতি ক্রমান্বয়ে সচল হচ্ছে। তবে আমরা যে অর্থনীতি চাই, যে দেশ চাই, স্বাধীনতার যে সুফল পেতে চাই—সেখান থেকে আমরা খুব বেশি দূরে এমনটা নয়। দরকার শুধু একটি শঙ্কা দূর করা। সেটা হচ্ছে, উন্নয়নটা টেকসই হবে কি না। এ শঙ্কা দূর করতে হলে উন্নয়নের সংজ্ঞাকে আরো প্রসারিত করার প্রয়োজন রয়েছে। সেটাকে জনকল্যাণমুখী করাতে হবে।
লেখক : সাবেক গভর্নর, বাংলাদেশ ব্যাংক। অধ্যাপক, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়
অনুলিখন : আফছার আহমেদ