বিগানের সফর কূটনৈতিক দিক থেকে তাৎপর্যপূর্ণ
।। জয়ন্ত ঘোষাল।।
ভারত ও চীনের সীমান্ত এখনো এক দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার মধ্যে। এখনো সীমান্তে উত্তেজনা কমেনি। ভারত ও চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর মধ্যে আলাপ-আলোচনা হয়েছে বটে; কিন্তু চীনা সেনা তাদের আগের অবস্থান থেকে যে সরে এসেছে এমনটা বলা যায় না। এ রকম অবস্থায় ভারতের পররাষ্ট্রনীতি যখন বেশ একটা চ্যালেঞ্জের মুখে, ঠিক সেই সময় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ডেপুটি সেক্রেটারি স্টিভেন বিগান ভারত ও বাংলাদেশ সফর সেরে গেলেন। তিনি ভারতে পররাষ্ট্রসচিব ও পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করেছেন। ভারতে বৈঠকের যে আলোচনা; সেই আলোচনা মূলত একটা কোয়াড্রিলেটারাল সিকিউরিটি ডায়ালগ। কোয়াড্রিলেটারাল সিকিউরিটি ডায়ালগ কী? কাকে বলে কোয়াড্রা? সেটা হলো—ভারত, জাপান, অস্ট্রেলিয়া আর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। এই চারটি দেশ নিজেদের মধ্যে ঘরোয়াভাবে একটা গোষ্ঠী তৈরি করেছে এবং সে গোষ্ঠীর মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে চীনের যে আগ্রাসন, বিশেষ করে দক্ষিণ চীন সমুদ্র ও পূর্ব চীন সমুদ্র এই দুটি এলাকায়ই চীনের যে মনোভাব তাতে এই এলাকার নিরাপত্তা বিঘ্নিত হচ্ছে। তার মোকাবেলায় চারটি দেশ একত্র হয়ে একটি গোষ্ঠী তৈরি করেছে এবং সেই গোষ্ঠী এখনো ইনফরমাল। সেটাকে ফরমাল করার চেষ্টা চলছে। ভারতে এই আলাপ-আলোচনাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্যই তিনি এসেছিলেন। তারপর তিনি বাংলাদেশে যান।
বাংলাদেশে যাওয়া শুধু নয়, তিনি ঢাকায় রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন পদ্মায় সাংবাদিকদের সঙ্গেও কথা বলেছেন। বাংলাদেশের সঙ্গে আমেরিকার এই আলোচনায় রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে আলোচনা হয়েছে। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও উপপররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে তাঁর কথা হয়েছে। ঢাকায় প্রথমে প্রতিমন্ত্রী শাহিরয়ার আলমের সঙ্গে, তারপর বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে স্টিভেন বিগানের বৈঠক হয়। এরপর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গেও দেখা করেন তিনি। সেখানে বিগান রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের একটা জোরালো ভূমিকা চেয়েছেন। সেটা যেমন একটা দিক। ঢাকা-ওয়াশিংটন মুক্ত বাণিজ্য চুক্তির আলোচনাও তিনি শুরু করেছেন। সেখানে স্টিভেন বিগান বলেছেন, এই দুই দেশের মধ্যে যে বাণিজ্য চুক্তি তার মেয়াদ শেষ হওয়ার সময় হয়ে এসেছে। কিন্তু আবার নতুন করে এই চুক্তির পথে আমেরিকা যাবে। এফটিএ অর্থাৎ ট্রেড অ্যাগ্রিমেন্ট, সেটার ব্যাপারে যে ছাড় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে বাণিজ্যিকভাবে দেওয়া হয়, যাকে জিএসপি বলা হয়, সেটা আমেরিকা আবার করবে। আবার সেই বিষয়ে যাবে। এর পাশাপাশি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেও সম্প্রতি জাপান সফর করে গেছেন। তাঁর দক্ষিণ কোরিয়া আর মঙ্গোলিয়ায় যাওয়ার কথা ছিল। সেটা এই সফরে হয়নি। কিন্তু তিনি এই সফরগুলোয় আসবেন বলে জানিয়ে গেছেন। এই সফরেই কিন্তু চীনের যে বর্তমান পররাষ্ট্রনীতি ও সম্প্রসারণ বা তার পরিপ্রেক্ষিতে এই এলাকায় বিদেশনীতির ভারসাম্য রক্ষা করার যে প্রয়োজনীয়তা, সেটা নিয়েই মাইক পম্পেও আলোচনা করেছেন বলে জানা গেছে। সেখানে তারই ফলোআপ হিসেবে এই Quat কূটনীতি। আরেক দিকে ভারত ও বাংলাদেশ। এই দুটি দেশের সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সখ্য, এটা কিন্তু কূটনীতিতে একটা নতুন দিগন্ত উন্মোচন করছে।
বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফের সাম্প্রতিক সময়ের রিপোর্ট থেকে দেখা যায়, বাংলাদেশের যে আর্থিক প্রবৃদ্ধির হার সেটা এই সংকটের মধ্যেও বেশ ইতিবাচক। এমনকি ভারতের যে মাথাপিছু জিডিপি, সে তুলনায় বাংলাদেশের মাথাপিছু জিডিপি উন্নততর। বাংলাদেশের যে ভৌগোলিক কৌশলগত আন্তর্জাতিক অবস্থান, চিরকালই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সেটাকে গুরুত্ব দেয়। চীন ও পাকিস্তানের যে কূটনৈতিক অক্ষ, তার পরিপ্রেক্ষিতে ভারত-বাংলাদেশের যে অক্ষ, তার সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কূটনৈতিক সখ্য বজায় রাখতে চায়। একটা জিনিস দেখা গেছে, অধুনা বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁর পররাষ্ট্রনীতিতে একটা সাবালকত্ব প্রদর্শন করছেন। অর্থাৎ একই সঙ্গে চীন, রাশিয়া ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশ কোনো রকম তিক্ততা তৈরি করছে না। ভারত ও বাংলাদেশের সম্পর্কের কথা না হয় ছেড়েই দিলাম, তার একটা ঐতিহাসিক পটভূমি আছে। ভারত যথেষ্ট মর্যাদাসহকারে সেই সম্পর্ককে এগিয়ে নিয়ে যেতে চাইছে নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বে। কিন্তু সবচেয়ে বড় জিনিস হলো বাংলাদেশ কিন্তু ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের ঐতিহাসিক ভূমিকাকে অবিচল রেখে আন্তর্জাতিক দুনিয়ায় সবার সঙ্গে সম্পর্ক ভালো রাখার চেষ্টা করছে। সেখানে বাংলাদেশের একটা অগ্রাধিকার হচ্ছে, যে ইস্যুগুলো বাংলাদেশের কাছে সবচেয়ে প্রয়োজনীয়, সেগুলো কিভাবে, কতটা বাস্তবে রূপ দেওয়া যায়। তার ভিত্তিতে আন্তর্জাতিক সম্পর্কগুলোকে নিরূপণ করাই হচ্ছে আপাতত বাংলাদেশের বিদেশনীতির সব থেকে বড় অগ্রাধিকার। দেশের অভ্যন্তরীণ জ্বলন্ত সব বিষয়ের সঙ্গে অনেক সময় পররাষ্ট্রনীতির গভীর সম্পর্ক থাকে। যে রকম রোহিঙ্গা সমস্যা। রোহিঙ্গারা মিয়ানমার থেকে চলে আসা একটি সম্প্রদায়। এই রোহিঙ্গা সংকট একটা আন্তর্জাতিক বিষয়ে পরিণত হয়েছে। সেখানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সক্রিয় ভূমিকা হতে পারে রাজনৈতিক ও কূটনৈতিকভাবে চাপ সৃষ্টি করা। সেটা বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতিরই একটা অঙ্গ। এই সফর সেই দিক থেকেও তাৎপর্যপূর্ণ। ভারতের পররাষ্ট্রসচিব হর্ষ বর্ধন শ্রিংলাও ঢাকায় গিয়ে কথা দিয়েছেন, রোহিঙ্গাদের চলে যাওয়া অর্থাৎ ফেরত যাওয়ার ব্যাপারে, একটা সেফ করিডর তৈরির ব্যাপারে ভারত মিয়ানমারের সঙ্গে কথা বলবে। ভারত, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও বাংলাদেশ—এই যে একটি ত্রিভুজ কূটনৈতিক ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে, তা কিন্তু রোহিঙ্গা সংকটের মতো আন্তর্জাতিক সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখতে পারে। সেটা ঢাকায় রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন পদ্মায় আলোচনায় উঠে এসেছে। এখানে আরেকটি বিষয় খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। সেটা হলো বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের খুনিকে ফেরত দেওয়া। এই বিষয়টি অত্যন্ত সংবেদনশীল বলে জানিয়েছেন বিগান। তিনি বলেছেন, এ বিষয়ে এখনই প্রকাশ্যে বলতে পারছি না। কিন্তু এ বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। এ ব্যাপারে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তৎপর। বাংলাদেশের শেখ মুজিবুর রহমানের ঘাতককে ফিরিয়ে আনা এবং বাংলাদেশের মাটিতে শাস্তি দেওয়ার ব্যাপারে ভারত ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তৎপর। এটা এই মুহূর্তে অত্যন্ত জরুরি রাজনৈতিক দাবি। বিশেষ করে এমন একটা সময় বাংলাদেশ অতিবাহিত করছে, যখন সামনের বছরে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তির উৎসব। বাংলাদেশ ও ভারত সেখানে সক্রিয় ভূমিকা নেবে। সে রকম একটা পরিস্থিতিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছে বঙ্গবন্ধুর ঘাতককে ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য যে কূটনৈতিক দৌত্য, সেটাও অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ।
১৯৪৭ সালে ভারত যখন স্বাধীন হলো, তখন বাংলা খণ্ডিত হয়। একটা বাংলা চলে যায় পাকিস্তানে। যাকে বলা হতো পূর্ব পাকিস্তান। প্রথম দিকে সেখানে ছিল সংসদীয় সরকার। মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ, লিয়াকত আলী খান, সোহরাওয়ার্দীর মতো শাসকরা রাওয়ালপিন্ডি থেকে দেশ শাসন করতেন। তারপর সব উল্টে গেল। এলো জঙ্গি শাসক। পূর্ব পাকিস্তানের পাট আর অন্যান্য সম্পদের ওপর লোভ ছিল পাকিস্তানি শাসকদের। পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিদের স্বাতন্ত্র্য মানতেও তাঁরা রাজি ছিলেন না। বাংলা ভাষার জন্য পূর্ব পাকিস্তানজুড়ে রক্তগঙ্গা বয়ে গিয়েছিল। আর এর মধ্যে সূক্ষ্মভাবে নিহিত ছিল আগামী দিনের স্বাধীন বাংলাদেশের বীজ। আইয়ুব খান, ইয়াহিয়া খানের আমলে বাংলাদেশের মানুষ স্বাধীনতার জন্য লড়াই শুরু করে। প্রত্যক্ষ সংগ্রামের সূচনা ইয়াহিয়া খানের আমলে ভোটের পর। গরিষ্ঠসংখ্যক সংসদ সদস্যের নেতা হওয়া সত্ত্বেও মানা হলো না শেখ মুজিবুর রহমানকে। শুরু হয়ে যায় মুক্তিযুদ্ধ। এই সময়কার কাহিনি নিয়ে লেখা একটা ছোট্ট বই ‘মুক্তিযুদ্ধের ২৫ বছর’। লেখক প্রয়াত সাংবাদিক রণেন মুখোপাধ্যায়। এই বইটা পড়ছিলাম। কলকাতা থেকে প্রকাশিত এই ছোট্ট বইটাতে আছে, কিভাবে ইয়াহিয়া খান চমকে উঠলেন। সামনে দাঁড়িয়ে টিক্কা খান তাঁর সামরিক পোশাক খুলে ফেললেন। বেল্টসহ রিভলবারটি রাখলেন ইয়াহিয়া খানের পায়ের কাছে। তারপর দুই পা পিছিয়ে স্যালুট করে বললেন, শেখ মুজিব আর তাঁর দলের লোকরা তাঁকে ও তাঁর বাহিনীকে যেভাবে অপমান করেছে তার প্রতিশোধ যদি তাঁকে নিতে দেওয়া না হয়, তবে তিনি আর সামরিক পোশাক পরবেন না। কিন্তু না, টিক্কা খান মাটি থেকে তাঁর পোশাক তুলে নিয়ে আবার পরলেন। রিভলবারসহ বেল্টটি বাঁধলেন কোমরে। স্যালুট করলেন আরেকবার। এই ঘটনাটি ১৯৭১ সালের ২৩ মার্চ সকালে। এদিন টিক্কা খান চলে যাওয়ার পর ইয়াহিয়া খান অনেক সময় কথা বলেন ইসলামাবাদ আর করাচির অনেকের সঙ্গে। তারপর সকাল ১১টায় প্রেসিডেন্ট ভবন থেকে বেরিয়ে এলেন কুর্মিটোলা ক্যান্টনমেন্টে। পাঁচ ঘণ্টা ছিলেন কুর্মিটোলা ক্যান্টনমেন্টে টিক্কা খানের সঙ্গে। পাঁচ ঘণ্টায় তৈরি হলো বাংলাদেশে গণহত্যার ব্লু প্রিন্ট। আর তাঁর রক্ততৃষ্ণা দেখে ইয়াহিয়া খানের মতো লোকও চমকে উঠেছিলেন। কিন্তু মুখে বলেছিলেন, শাবাশ! রণেন মুখোপাধ্যায়ের এই লেখা থেকে জানা যায় টিক্কার ব্লু প্রিন্টের মূল পরিকল্পনার মাত্র ৭২ ঘণ্টার মধ্যে পূর্ব পাকিস্তানে শেখ মুজিব আর তাঁর অনুগামী সব বাঙালিকে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া হবে এমনটাই ঠিক হয়েছিল। তৈরি হয়েছিল মানব ইতিহাসে ঘৃণ্যতম গণহত্যার এক পরিকল্পনা এবং কথা ছিল ২৪ মার্চের মাঝরাত থেকেই শুরু হবে গণহত্যা। কিন্তু বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের কাহিনি শুরু হয় ২৫শে মার্চ রাতে। বঙ্গবন্ধু ২৫শে মার্চ সন্ধ্যায় সবাইকে ডেকে পাঠান। কী হতে যাচ্ছে, কী হতে পারে—সব কথা খুলে বলেন। সবাইকে আত্মগোপনের পরামর্শ দেন। শুরু হয়ে যায় লড়াই। সারা পূর্ব পাকিস্তানে চলেছিল হত্যাযজ্ঞ। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের নেতৃত্বে সে লড়াই করেছিল বাংলাদেশের মানুষ।
আজ এত বছর পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ভারত ও বাংলাদেশের ত্রিভুজ রচনা হচ্ছে। তাই আজ যখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একজন গুরুত্বপূর্ণ প্রতিনিধি ভারত ও বাংলাদেশ দুটি দেশই সফর করেন এবং তার তাৎপর্য আমরা আলোচনা করি, তখন মনে রাখতে হয় এই ইতিহাসের পটভূমি। মনে রাখতে হয় চীন ও পাকিস্তানের অক্ষ আজ এই এলাকার স্থায়ী শান্তির বিঘ্ন ঘটাচ্ছে। ভারত ও বাংলাদেশের সম্পর্কের পটভূমিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ প্রতিনিধির সফর দুই দেশের এবং একটি ত্রিভুজ রচনার চেষ্টা কূটনৈতিক দিক থেকে যথেষ্ট তাৎপর্য দাবি করে।