ইহা একটি স্টেশন
অরুপ রায়, ভারত : মান্ধাতার আমলের গোয়ালঘরের মতো মনে হলেও এটি একটি রেলওয়ে স্টেশন ।
বৃটিশ পূর্ব ভারতবর্ষে এর নাম ছিলো “লাতু রেলওয়ে স্টেশন”। এখনো অনেকে এই নামেই ডাকছে, যদিও দেশভাগ তথা ১৯৬৫ সালের পাক্-ভারত যুদ্ধের পর এর নাম হয় “শাহবাজপুর রেলওয়ে স্টেশন”, কারণ গণভোটে লাতুর বৃহৎ অংশটি ভারতে থেকে যায় এবং স্টেশনটি সহ কিয়দংশ চলে আসে পূর্ব্ব-পাকিস্তানে ।
অবিভক্ত ভারতে বৃটিশদের তৈরী ছিল এই স্টেশন । তৎকালীণ জলঢুপ থানা, বর্তমান বিয়ানীবাজার, বড়লেখা ও জুড়ী উপজেলার মানুষের কাছে ‘লাতু রেলস্টেশন’ নামে সমধিক পরিচিত । ব্রিটিশ আমলে ১৮৯৬ থেকে ১৮৯৮ সালে কুমিল্লা-আখাউড়া-কুলাউড়া-বদরপুর রেলপথটি চালু করে তৎকালীন আসাম-বেঙ্গল রেলওয়ে । এই রেলপথটি ১৯০৩ সালে আসামের লামডিং পর্যন্ত প্রসারিত হয় ।
চট্টগ্রাম বন্দরের রেল সংযোগের জন্য আসাম চা রোপণকারী সংঘের দাবির প্রতিক্রিয়ায় আসাম-বেঙ্গল রেলওয়ে ১৮৯১ সালে বাংলার পূর্ব দিকে একটি রেলপথ নির্মাণ শুরু করে । চট্টগ্রাম ও ত্রিপুরার অধুনা কুমিল্লার মধ্যে ১৫০ কিলোমিটার পথ খোলা হয় ১৮৯৫ সালের রেলওয়ে ট্রাফিকে ।
১৯৪৭ সালে ভারত ভাগের সাথে এটি গুরুত্ব হিসাবে বিবেচিত হয়েছিল । শ্রীহট্টের লোকজন এই রেললাইন দিয়ে করিমগঞ্জ, বদরপুর, হুজাই, লঙ্কা, লামডিং, শিলচর, গৌহাটি যাতায়াত করতেন । এ লাইনে চলাচলকারী ট্রেন যাত্রীসহ মালামাল বহন করত । এই স্টেশন হয়েই ১৯১৯ সালে শ্রীহট্টে পা রেখেছিলেন কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ।
লাতু বা শাহবাজপুর স্টেশনের পরবর্তী স্টেশনের নাম ‘মহিশাসন’, যেটি অধুনা আসামের করিমগঞ্জের অংশ । মহিশাসন সীমান্ত রেলওয়ে স্টেশনটি ভারতের সীমান্তবর্তী করিমগঞ্জ জেলার ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে অবস্থিত একটি সীমান্ত রেলওয়ে ট্রানজিট সুবিধা কেন্দ্র হিসেবে বিবেচিত ছিল । স্বাধীনতার নামে দেশভাগের পরেও এই স্টেশনটি ছিলো জমজমাট, হুইসেল বাজিয়ে ছুটে চলত ট্রেন, কিন্তু ১৯৬৫ সালে পাক্-ভারত যুদ্ধের সময়ে মহিশাসন-লাতু রেলওয়ে চলাচল পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায় ।
মহিশাসন-শাহবাজপুর(লাতু) রুটটি ১৯৯৬ সালের ডিসেম্বর থেকে চালুর কথা থাকলেও প্রয়োজনীয় সংষ্কার ও রেলওয়ে ট্রাফিকের অভাবের কারণে চালু হয়নি । ভৌগলিকভাবে আসামের জাতিগোষ্টী, ভাষা ও সংস্কৃতির সাথে আমাদের শ্রীহট্ট অঞ্চলের অনেক মিল রয়েছে ।
তৎকালীণ করিমগঞ্জ ছিলো আমাদের মহকুমা শহর । এই মহকুমার অধীনে ৫টি থানা ছিলো যথাক্রমে করিমগঞ্জ, বদরপুর, জলঢুপ, রাতাবাড়ি ও পাথারকান্দি । সেই সময়ে শত শত মানুষ কাজের গন্তব্যে যেতে সময়ের আগেই এই স্টেশনে অপেক্ষার সময় কাটাতেন । মানুষের কোলাহলে মুখর সেই স্টেশনটি আজ গোয়ালঘরে পরিণত হয়েছে । কত শত স্মৃতি জড়িয়ে আছে আমাদের এই লাতু স্টেশনটিতে ।
শত বৈরীতা স্বত্বেও কাঁটাতারের বেড়া উপেক্ষা করে যদি দুই পঞ্জাবের আঠারী-ওয়াগা সীমান্তপথ চালু থাকতে পারে, তবে এপার বাংলা ওপার বাংলা মিলে কি লাতু-মহিশাসন রেলওয়ে চালু রাখতে পারি না ? অমৃতসর-লাহোর যদি পারে, তবে লাতু-মহিশাসন কেন নয় ? স্বাধীনতার নামে দেশভাগের সেই ক্ষত শুকোবে কবে, শুনতে কি পারব মৈত্রীর সেই হুইসেল ?