সম্প্রীতির শারদীয়া
।। ড. অসীম সরকার ।।
দেবী দুর্গা শক্তির দেবী। দেবীর ‘দশ হাত’ ঐক্য বা সম্মিলিত শক্তির প্রতীক। অর্থাৎ দেবী দুর্গা সত্য, সুন্দর, কল্যাণ, শুভ, সংহতি ও ঐক্যের প্রতীক। দেবী দুর্গার যুদ্ধরতরূপ লোকশিক্ষার একটি দৃষ্টান্ত। এটি হচ্ছে অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে শুভ শক্তির যুদ্ধ, অন্যায়, অসত্য ও অনাচারের বিরুদ্ধে ন্যায়, সত্য ও সদাচারের সংগ্রাম। দেবীর বন্দনার প্রেক্ষাপট হলো অন্তরের আসুরিক শক্তির বিনাশ।
সব ধর্মের মূল লক্ষ্য হচ্ছে সমগ্র জীবের কল্যাণ সাধন; কোনো বিশেষ সম্প্রদায়ের কল্যাণ সাধন নয়। দুর্গাপূজার ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতা হিন্দুদের, কিন্তু মূলবাণী সমগ্র মানবজাতির কল্যাণে নিবেদিত। এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে বাঙালির হাজার বছরের অসাম্প্রদায়িক চেতনা। এই চেতনাকে ধারণ করে সবার সুখ-শান্তি কামনায় এবং সর্বজীবের মঙ্গলার্থে বাঙালি হিন্দু সম্প্রদায় বিপুল উৎসাহ-উদ্দীপনা ও উৎসবমুখর পরিবেশে নানা উপচার ও অনুষ্ঠানের মাধ্যমে পালন করে শারদীয় দুর্গাপূজা। সর্বপ্রকার হীনতা, সংকীর্ণতা ও ধর্মান্ধতার ঊর্ধ্বে উঠে ভেদাভেদ ভুলে গিয়ে জাতি-ধর্ম-বর্ণ-গোষ্ঠী-নির্বিশেষে সর্বস্তরের জনগণ শারদীয় দুর্গাপূজা উদযাপন করে এবং অংশগ্রহণ করে আনন্দ-উৎসবে। সবাই মিলিত হয় অভিন্ন মোহনায়, অভিন্ন চেতনায়। সবার অংশগ্রহণ ও উপস্থিতিতে শারদীয় দুর্গাপূজা রূপ লাভ করে সর্বজনীন মহোৎসবে, পরিণত হয় অন্যতম জাতীয় উৎসবে।
বাংলাদেশ এ ক্ষেত্রে অনন্য। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশ বাংলাদেশ। আবহমান কাল থেকে ঈদুল ফিতর, ঈদুল আজহা, ঈদে মিলাদুন্নবী, জন্মাষ্টমী, শারদীয় দুর্গোৎসব, বুদ্ধপূর্ণিমা, বড়দিন প্রভৃতি ধর্মীয় অনুষ্ঠান কোনো বিশেষ ধর্মের গণ্ডিতে সীমাবদ্ধ থাকে না, সর্বস্তরের মানুষের অংশগ্রহণ ও উপস্থিতিতে সম্প্রীতি ও সৌহার্দপূর্ণ পরিবেশে উদযাপিত হয় প্রতিটি ধর্মীয় উৎসব। ‘ধর্ম যার যার, উৎসব সবার’ মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার এই স্লোগান মনেপ্রাণে ধারণ করে জাতি-ধর্ম-বর্ণ-নির্বিশেষে সবাই পালন করে প্রতিটি ধর্মীয় উৎসব।
শারদীয় দুর্গাপূজাকে কেন্দ্র করে সারা দেশে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, মেলা, জনসমাগম ও শোভাযাত্রা হয়ে থাকে। মহামান্য রাষ্ট্রপতি, মাননীয় প্রধানমন্ত্রীসহ রাজনৈতিক ও সামাজিক নেতারা শুভেচ্ছা বিনিময় করেন। মণ্ডপে মণ্ডপে ভক্তিমূলক গান, চণ্ডীপাঠ, অর্চনা, আরতি, ভক্তদের শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদন এবং সেই সঙ্গে কোলাকুলি, প্রণাম, আশীর্বাদ ইত্যাদি দুর্গাপূজাকে ধর্মীয় আবেশে আনন্দঘন করে তোলে; কিন্তু বর্তমান প্রেক্ষাপট একটু ভিন্ন। বৈশ্বিক মহামারি কভিড-১৯-এর কারণে বাংলাদেশসহ সারা বিশ্ব আজ বিপর্যস্ত এবং মানুষের জীবন হুমকির সম্মুখীন। বর্তমান প্রেক্ষাপটে করোনার বিস্তার রোধে দুর্গাপূজার সময় নিম্নোক্ত বিষয়ের প্রতি বিশেষ দৃষ্টি রাখা আবশ্যক :
‘স্বাস্থ্যবিধি মেনে পূজা করা, পূজামণ্ডপে দর্শনার্থীদের জন্য মাস্ক ও হ্যান্ড স্যানিটাইজারের ব্যবস্থা করা, অতিরিক্ত সাজসজ্জা পরিহার করা, নিজস্ব স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর মাধ্যমে সার্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান এবং মেলা ও জনসমাবেশ না করা, কোনো প্রকার আতশবাজি বা পটকা না ফোটানো, প্রতিমা বিসর্জন উপলক্ষে শোভাযাত্রা না করা, কোনো প্রকার গুজবে বিভ্রান্ত না হওয়া, পূজাকে কেন্দ্র করে যাতে করোনার সংক্রমণ বৃদ্ধি না পায় সে বিষয়ে সর্বোচ্চ সচেতন থাকা এবং মাস্ক পরিধান করা।’
দুর্গাপূজার অন্যতম প্রধান দিক হচ্ছে নারীশক্তির প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন এবং নারীকে মাতৃজ্ঞান করা। চাণক্য পণ্ডিত বলেছেন, ‘মাতৃবৎ পরদারেষু’—পরের স্ত্রীকে মাতৃজ্ঞান করবে; কিন্তু বর্তমানে কতিপয় পশ্বাধম লম্পট কর্তৃক সেই নারীই হচ্ছে নির্যাতিত, নিগৃহীত ও ধর্ষিত। এ থেকে পরিত্রাণের উপায় হচ্ছে দুর্গাপূজার তাৎপর্য অনুধাবন করা এবং ব্যক্তিজীবনে তার প্রতিফলন ঘটানো।
শারদীয় দুর্গোৎসব হোক আনন্দময় ও উৎসবমুখর এবং সত্য ও সুন্দরের আলোকে আলোকিত হোক প্রত্যেকের জীবন। শারদীয় দুর্গোৎসবের মাধ্যমে সর্বপ্রকার হীনতা, সংকীর্ণতা, ধর্মান্ধতা, অজ্ঞানতা দূরীভূত হোক এবং বিনাশ হোক অন্তরের পশুত্ব ও আসুরিক শক্তির; বিনাশ হোক সব অশুভ শক্তির। জেগে উঠুক মানুষে মানুষে সৌহার্দ ও ভ্রাতৃত্ববোধ। রচিত হোক সম্প্রীতি ও মহামিলনের সেতুবন্ধ। নির্মল হোক সবার চিত্ত, সার্থক হোক শক্তি-সংহতি-কল্যাণ অন্বেষা। বিশ্ব থেকে চিরতরে ধ্বংস হোক পাশবিক প্রবৃত্তি, ধরণিতে নেমে আসুক শান্তির ধারা। বিশ্বমানবতার জয় হোক, সর্বস্তরের মানুষ জাতপাতের ভেদাভেদ ভুলে গিয়ে দেশ ও সমগ্র জাতির কল্যাণে ব্রতী হোক। হিংস্র সাম্প্রদায়িক শক্তির বিনাশ ঘটে নবচেতনায় গড়ে উঠুক ধনধান্য পুষ্পভরা আমাদের প্রাণপ্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশ।
লেখক : অধ্যাপক ও সাবেক চেয়ারম্যান, সংস্কৃত বিভাগ; ট্রাস্টি, হিন্দু ধর্মীয় কল্যাণ ট্রাস্ট; উপদেষ্টা, শারীরিক শিক্ষা কেন্দ্র; সিনেট সদস্য ও সাবেক প্রাধ্যক্ষ, জগন্নাথ হল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।