জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা বাস্তবায়নে করণীয়

Published: 30 October 2020

।। বিধান চন্দ্র দাস ।।

সম্প্রতি জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘দেশজ যা কিছু আছে, উদ্ভিদ ও প্রাণী প্রত্যেকটাকে আমরা সংরক্ষণ করব।’ (কালের কণ্ঠ, ১৬ সেপ্টেম্বর ২০২০)। দেশের সরকারপ্রধানের কাছ থেকে জীববৈচিত্র্যের সার্বিক সংরক্ষণ বিষয়ে এ ধরনের যথার্থ কোনো ঘোষণা এর আগে এভাবে শোনা যায়নি।

এ ছাড়া গত ১ অক্টোবর (২০২০) নিউ ইয়র্কে জাতিসংঘ সদর দপ্তরে বায়োডাইভার্সিটি সামিটে (জীববৈচিত্র্য শীর্ষ সম্মেলন) প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভিডিও বার্তায় পৃথিবীতে প্রতিটি জীবের গুরুত্ব সম্পর্কে বলেছেন, ‘এই গ্রহে প্রতিটি প্রজাতি বাস্তুতন্ত্রে নির্দিষ্ট ভূমিকা পালন করে।’ পৃথিবী বিখ্যাত কনজারভেশন বায়োলজিস্টরা বাস্তুতন্ত্রে প্রতিটি প্রজাতির গুরুত্ব অনুধাবন করেন। তাঁদের মতে, জীববৈচিত্র্যকে রক্ষা করতে হলে প্রয়োজন বাস্তুতন্ত্রের সব জীবপ্রজাতি রক্ষার ব্যাপারে সমানভাবে গুরুত্ব প্রদান।

অথচ বাংলাদেশে আমরা যারা জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ নিয়ে কথা বলি, তাদের অনেকেই জীববৈচিত্র্যের সার্বিক সংরক্ষণ অর্থাৎ দেশজ যা কিছু আছে, উদ্ভিদ ও প্রাণী প্রত্যেকটার সংরক্ষণ নিয়ে কথা বলি না। বেশির ভাগ সময় আমরা জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ বিষয়ে একপেশে কথাই বলি।

আমাদের দেশে কথায় ও কর্মকাণ্ডে প্রধানত বড় বড় সব প্রাণী (হাতি, বাঘ, পাখি, কুমির, ব্যাঙ, মাছ ইত্যাদি মেরুদণ্ডীজাতীয় প্রাণী; যারা সমগ্র জীববৈচিত্র্যের ৪ শতাংশেরও কম) ও উদ্ভিদ (সমগ্র জীববৈচিত্র্যের ১৫ শতাংশ) সংরক্ষণের বিষয় স্থান পায়। বাকিরা থাকে অনেকটাই অবহেলিত। এই বাকিরা কারা? এরা হচ্ছে প্রধানত অমেরুদণ্ডী প্রাণী (জীববৈচিত্র্যের ৭৮ শতাংশ: পোকা-মাকড়সহ সব প্রকার সন্ধিপদযুক্ত প্রাণী, কেঁচো, কৃমি, শামুক ইত্যাদি প্রাণী) ও অণুজীবজাতীয় জীব (জীববৈচিত্র্যের ৩ শতাংশ)।

প্রকৃতপক্ষে আমরা আমাদের দেশের অমেরুদণ্ডী প্রাণী ও অণুজীবজাতীয় জীবদের উল্লেখযোগ্য অংশকে চিনি না ও জানি না। তাদের সঠিক নির্ভরযোগ্য কোনো তালিকাও আমাদের কাছে নেই। ফলে জীববৈচিত্র্যের এই ৮১ শতাংশ সম্পর্কে অন্ধকারে থেকে সমগ্র জীববৈচিত্র্য কিভাবে সংরক্ষণ করা সম্ভব? এই প্রেক্ষাপটে প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক দেশের সব প্রজাতি সংরক্ষণের ঘোষণা নিঃসন্দেহে আশাব্যঞ্জক।

বাস্তুতন্ত্রের ভারসাম্য বজায় রাখার জন্য অমেরুদণ্ডী প্রাণী ও অণুজীবজাতীয় জীব অপরিহার্য। কেউ কেউ বলেন, বন কিংবা বড় বড় প্রাণী রক্ষা করলেই সব জীববৈচিত্র্য এমনিতে রক্ষা হবে। কথাটি সঠিক নয়। প্রকৃতিতে বড় প্রাণী কিংবা বন সংরক্ষণ করতে হলেও সেখানে বসবাসকারী অমেরুদণ্ডী প্রাণী ও অণুজীবজাতীয় জীবদের চিনতে হয়, জানতে হয়। পৃথিবীর উন্নত দেশগুলো তাই করে।

বাংলাদেশ ‘কনভেনশন অন বায়োলজিক্যাল ডাইভার্সিটি’ (সিবিডি)-তে স্বাক্ষর করেছে। আন্তর্জাতিক এই কনভেনশনের উদ্দেশ্য হচ্ছে জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ করা। অর্থাৎ সব প্রজাতি সংরক্ষণ। সেই কারণে দেশের সব প্রজাতিকে চেনা, জানা, তালিকাভুক্ত করা ও তাদের সংরক্ষণের ওপর গবেষণা করা প্রয়োজন। সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রীর একনেক সভার ঘোষণা বাংলাদেশে জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ বিষয়ে নিঃসন্দেহে নতুন মাত্রা পেয়েছে।

বাংলাদেশ জাতীয় জীববৈচিত্র্য কৌশল ও কর্মপরিকল্পনা তৈরি করে এর সংশোধিত কপি সিবিডিতে জমা দিয়েছে। দেশে জীববৈচিত্র্য রক্ষায় প্রয়োজনীয় আইনও পাস করা হয়েছে। এ ছাড়া দেশে সংরক্ষিত এলাকার পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছে। কিন্তু আমাদের পরিবেশ ও বাস্তুতন্ত্রের জন্য অতি গুরুত্বপূর্ণ অমেরুদণ্ডী ও অণুজীবজাতীয় জীবদের চেনা, জানা, তালিকাভুক্ত করা, নমুনা সংগ্রহ করা ও তাদের সংরক্ষণের ওপর গবেষণা করা সন্তোষজনকভাবে সম্ভব হয়নি।

এই কাজগুলো চটজলদি সম্পন্ন করা সম্ভবও নয়। কারণ অমেরুদণ্ডী ও অণুজীব, বিশেষ করে অমেরুদণ্ডী প্রাণিজগৎ বিশাল বৈচিত্র্য দিয়ে ভরা। প্রাণিজগতে বর্তমানে স্বীকৃত ৩৩টি পর্বের মধ্যে একটি বাদে (কর্ডাটা, এখানেও অমেরুদণ্ডী আছে) বাকি সবই অমেরুদণ্ডী প্রাণীর অন্তর্ভুক্ত। পৃথিবীতে এই ৩২টি প্রাণী পর্বের মধ্যে আছে ৮৫টি শ্রেণি, ৪৫৬টি বর্গ ও পাঁচ হাজার ১০৮টি পরিবার। এই গ্রুপগুলোর মধ্যেই আমাদের দেশের সব অমেরুদণ্ডী প্রাণী প্রজাতি অন্তর্ভুক্ত। আমাদের দেশে অবশ্য এই সংখ্যক গ্রুপ নেই। তবে যা আছে তার সংখ্যাও কম নয়। সেই কারণে দেশের অমেরুদণ্ডী প্রাণী প্রজাতিসহ সব জীব প্রজাতি অধ্যয়নের জন্য প্রয়োজন বিপুলসংখ্যক বিশেষজ্ঞ ও এসংক্রান্ত গবেষণার সুযোগ-সুবিধা। বাস্তবতা হচ্ছে আমাদের দেশে গ্রুপভিত্তিক, বিশেষ করে অমেরুদণ্ডী প্রাণীদের জন্য বিশেষজ্ঞ সংখ্যা খুবই অপ্রতুল। সুযোগ-সুবিধাও নেই বললেই চলে।

এশিয়াটিক সোসাইটি অব বাংলাদেশ থেকে প্রকাশিত ‘এনসাইক্লোপিডিয়া অব ফ্লোরা অ্যান্ড ফনা’-র অমেরুদণ্ডীর খণ্ডগুলোতে দেশে বিদ্যমান অমেরুদণ্ডীদের অল্পসংখ্যক প্রজাতিকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এ ছাড়া অমেরুদণ্ডীদের যে তালিকা সেখানে দেওয়া হয়েছে তাদের সবাই বাংলাদেশে এখনো আছে কি না তা যাচাই করা হয়নি। এগুলোর বেশির ভাগের ভাউচার নমুনাও কোথাও সংরক্ষিত নেই। আন্তর্জাতিক সংস্থা (আইসিজেডএন) কর্তৃক বাতিলকৃত অনেক বৈজ্ঞানিক নাম এখানে লিপিবদ্ধ করা হয়েছে।

এই প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের জীববৈচিত্র্য শনাক্তকরণ, ডাটাবেইস তৈরি, ভাউচার নমুনা রক্ষণাবেক্ষণ ও প্রজাতিভিত্তিক সংরক্ষণসহ দেশের প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণের ব্যাপারে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য নিচের বিষয়গুলো বিবেচনা করা যেতে পারে।

১. দেশের পুরনো চারটি বিভাগে (ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, খুলনা) চারটি ন্যাচারাল হিস্ট্রি মিউজিয়াম প্রতিষ্ঠা করা। ২. এগুলো শুধু দর্শকদের জন্য নমুনা দেখানোর ভবন হবে না। উন্নত দেশগুলোর মতো (ব্রিটিশ ন্যাচারাল হিস্ট্রি মিউজিয়াম; স্মিথসোনিয়ান ন্যাশনাল ন্যাচারাল হিস্ট্রি মিউজিয়াম, ওয়াশিংটন; বার্লিন ন্যাচারাল হিস্ট্রি মিউজিয়াম ইত্যাদি) এগুলোর অভ্যন্তরে থাকবে জীববৈচিত্র্য তথা দেশের প্রাকৃতিক সম্পদসংক্রান্ত উন্নতমানের গবেষণা ইউনিটগুলো। ৩. প্রতিটি ন্যাচারাল হিস্ট্রি মিউজিয়াম—সংশ্লিষ্ট বিভাগ বা অঞ্চলের সব জীববৈচিত্র্য তথা প্রাকৃতিক সম্পদ শনাক্তকরণ, ডাটাবেইস তৈরি, ভাউচার নমুনা রক্ষণাবেক্ষণ, পর্যবেক্ষণ, অধ্যয়ন ও প্রজাতিভিত্তিক সংরক্ষণের ব্যাপারে কাজ করবে। ৪. জলবায়ু পরিবর্তনজনিত অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণে প্রতিটি ন্যাচারাল হিস্ট্রি মিউজিয়ামে সংশ্লিষ্ট বিভাগ বা অঞ্চলের অপ্রচলিত খাদ্য উৎসর সন্ধানে ব্যাপক গবেষণার ব্যবস্থা থাকবে। ৫. জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কিংবা অন্য কারণে দেশের বিপদাপন্ন প্রজাতিদের সংরক্ষণের (প্রকৃতিতে রেখে কিংবা বাইরে এনে) ব্যাপারে প্রতিটি ন্যাচারাল হিস্ট্রি মিউজিয়াম কার্যকর ভূমিকা রাখবে। ৬. স্কুল-কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী তথা দেশের মানুষের জীববৈচিত্র্য তথা প্রাকৃতিক সম্পদ সম্পর্কে শিক্ষা ও ভালোবাসা তৈরির জন্য প্রতিটি ন্যাচারাল হিস্ট্রি মিউজিয়ামের বছরব্যাপী কর্মসূচি থাকবে।

তবে আমাদের মনে রাখা দরকার, এটি এক দীর্ঘ প্রক্রিয়া। বিশেষ করে জীববৈচিত্র্যের গ্রুপভিত্তিক বিশেষজ্ঞ তৈরির বিষয়টি। প্রতিষ্ঠান ছাড়া প্রকল্প করে দেশে গ্রুপভিত্তিক বিশেষজ্ঞ তৈরি ও এসংক্রান্ত গবেষণার সুযোগ-সুবিধা সৃষ্টি হবে না। আর এই দুটি বিষয় ছাড়া দীর্ঘ মেয়াদে জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ করাও সম্ভব না। উন্নত দেশগুলোর ন্যাচারাল হিস্ট্রি মিউজিয়ামগুলো বহু বছর ধরে কাজ করেই এ ব্যাপারে সফলতা পেয়েছে। অনেক দেশ এসব কাজের জন্য তাদের অঞ্চলভিত্তিক একটি করে ন্যাচারাল হিস্ট্রি মিউজিয়াম প্রতিষ্ঠা করেছে। কাজেই প্রধানমন্ত্রীর ‘দেশজ যা কিছু আছে, উদ্ভিদ ও প্রাণী প্রত্যেকটাকে আমরা সংরক্ষণ করব’ ঘোষণার বাস্তবায়ন করতে হলে এখনই এ ব্যাপারে উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন।

লেখক : অধ্যাপক, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়