শিরশ্ছেদ, পিটিয়ে-পুড়িয়ে মারা ও ধর্ম
।। চিররঞ্জন সরকার ।।
লালমনিরহাটে এ স্থানেই আবু ইউনুস মো. সহিদুন্নবী নামে একজনকে ধর্ম অবমাননার দায়ে গণপিটুনি দিয়ে হত্যার পর লাশ পুড়িয়ে দেওয়া হয়।
সম্প্রতি ফ্রান্সে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা বিষয়ক এক ক্লাসে মহানবী হজরত মোহাম্মদ (সা.)-এর কার্টুন দেখানোর কারণে শিক্ষককে হত্যার ঘটনায় ফ্রান্সজুড়ে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়। হাজার হাজার মানুষ ক্ষোভ প্রকাশ করে। দেশটির প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ ‘মৌলবাদী ইসলাম’ এর বিপরীতে দেশের ধর্মনিরপেক্ষ মূল্যবোধ সমুন্নত রাখার পক্ষে জোরালো অবস্থান গ্রহণের অঙ্গীকারের কথা জানান। ‘ফ্রান্স ব্যঙ্গচিত্র দেখানো বন্ধ করবে না’ বলেও জানান তিনি। ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁর এই কথাগুলো নিজ দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষকে আশ্বস্ত করলেও সংখ্যালঘু মুসলিম জনগোষ্ঠীকে বিক্ষুব্ধ করে তুলেছে।
ম্যাক্রোঁর মন্তব্যে মুসলিম বিশ্বেও তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়। আর এই সুযোগটা গ্রহণ করে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোগান। যিনি মুসলিম বিশ্বের নেতা হওয়ার জন্য গত কয়েক বছর ধরেই মরিয়া চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। তিনি ফরাসি পণ্য বয়কটের ডাক দেন। একই সঙ্গে ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁর বিরুদ্ধে বিষোদগার করেন। এমনকি ম্যাক্রোঁকে মানসিকভাবে অসুস্থ বলেও মন্তব্য করেন।
এই ঘটনার পর পৃথিবীর বিভিন্ন মুসলিম দেশে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ‘বয়কট ফ্রান্স’ আন্দোলন শুরু হয়। কুয়েত, জর্ডান ও কাতারের অনেক সুপারমার্কেট থেকে ফরাসি পণ্য সরিয়ে নেওয়া হয়েছে৷ লিবিয়া, সিরিয়া ও গাজায় প্রতিবাদ হয়েছে৷ পাকিস্তানেও প্রতিবাদ হচ্ছে। এদিকে ফ্রান্সের বিরুদ্ধে বিশ্বের সবচেয়ে বড় প্রতিবাদ সমাবেশটি হয়েছে বাংলাদেশে। এখানে ফ্রান্সবিরোধী আন্দোলন ক্রমেই জোরদার হয়ে উঠছে। ফ্রান্সের মুসলিমরা আরও বেশি প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে উঠছে। এর জের ধরে ২৯ অক্টোবর নিস শহরের এক গির্জায় ছুরি দিয়ে কুপিয়ে অন্তত তিনজন ফরাসি নাগরিককে হত্যা করা হয়।
উল্লিখিত ঘটনায় প্রথমেই ফরাসিদের ভূমিকার সমালোচনা করতে হয়। মতপ্রকাশের স্বাধীনতার নামে ভিন্ন ধর্মবিশ্বাসীদের মনে আঘাত দেওয়া মোটেও ঠিক কাজ নয়। কোনো বিবেচনাতেই এটা মেনে নেওয়া যায় না। ফ্রান্সে বিভিন্ন ব্যঙ্গচিত্রের পুনর্প্রকাশ বিশ্বের বহু মুসলমানের জন্য অপমানজনক ও ভয়াবহ আক্রমনাত্মক। ধর্ম ও পবিত্র ধর্মীয় প্রতীকগুলোর অবমাননা ঘৃণা উসকে দেয় এবং সহিংস উগ্রবাদ সমাজকে মেরুকরণ ও খণ্ডিত হওয়ার দিকে ঠেলে দেয়। যা অনাকাঙ্ক্ষিত।
এবার ফ্রান্সের বিরুদ্ধে ভূমিকাপালনকারীদের আচরণ নিয়ে কিছু কথা বলা যাক। যারা ফ্রান্সের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে শামিল হয়েছেন, তারা কিন্তু একবারের জন্যও ফ্রান্সের যে শিক্ষকের শিরশ্ছেদ করা হয়েছে কিংবা নিসের গির্জায় যে সব নিরীহ ব্যক্তিদের ছুরি দিয়ে কুপিয়ে খুন করা হয়েছে, এই নৃশংস খুনের ব্যাপারে কিছু বলছেন না। ধর্মের অবমাননা অবশ্যই ঘৃণ্য কাজ, কিন্তু মানুষ খুন কি তার চেয়ে বেশি ঘৃণ্য নয়?
ফরাসি পণ্য বর্জনের ডাক দেওয়াটাই বা কতটা যৌক্তিক? বাংলাদেশ তো নয়ই, আরব ও অন্য মুসলিম প্রধান দেশগুলোও ফ্রান্সের রপ্তানির বড় বাজার নয়৷ এসব দেশে সব মিলিয়ে ৩ শতাংশেরও কম ফরাসি পণ্য রপ্তানি হয়৷ তাদের বড় বাজার ইউরোপ, প্রায় ৬০ শতাংশ৷ এছাড়া যুক্তরাষ্ট্র ও চীনও তাদের বড় বাজার৷ বাংলাদেশ থেকে ৩ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি মূল্যের পণ্য আমদানি করে ফ্রান্স৷ আর রপ্তানি করে ৩০ দশমিক ৭ কোটি ডলারের পণ্য৷ কাজেই ফরাসি পণ্য বর্জনের আন্দোলন করে ফ্রান্সকে দমানো যাবে বলে মনে হচ্ছে না৷
ফ্রান্সবিরোধী আন্দোলন গড়ে উঠার পেছনে ফরাসি প্রেসিডেন্ট ম্যাক্রোঁ ও তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোগানের অবদানও কম নয়। এরদোগানের প্রবল বাসনা হচ্ছে সৌদি আরব, ইরান ও মিশরের প্রভাবকে হটিয়ে মুসলিম বিশ্বের নেতা হওয়া। আর করোনাকবলিত ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ম্যাক্রোঁ নানা রাজনৈতিক–অর্থনৈতিক টানাপড়েনের শিকার। সিরিয়া ও লিবিয়া নিয়ে বিতর্ক কিংবা আজারবাইজান–আর্মেনিয়া ইস্যু নিয়ে খুব একটা স্বস্তিতে নেই। বলা যায়, ফ্রান্স ও তুরস্ক দুই মেরুতে অবস্থান, দুই দেশের৷ এদিকে ২০২২ সালের এপ্রিলে অনুষ্ঠিত হবে ফ্রান্সের নির্বাচন৷ কিছুদিন আগেই হয়ে গেল ‘ইয়েলো ভেস্ট‘ আন্দোলন৷ দেশের অর্থনীতি নিয়ে কিছুটা ব্যাকফুটে থাকা ম্যাক্রোঁ এই ইস্যুতে একটা পাকা জায়গা করে রাখতে চাইছেন৷ মুসলিমরিবোধী অবস্থান তার সমর্থনকে বাড়িয়ে দেবে। সেক্ষেত্রে দেশটির ৮–১০ ভাগ মুসলিমের সমর্থন হারালেও তার রাজনৈতিক লাভের সম্ভাবনা বেশি। তাই তিনি চাইছেন অভিবাসী মুসলিমদের ক্রমাগত হিংস্রতার বিষয়গুলোকে সামনে এনে তাদের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নিতে। যদিও শেষ বিচারে এই বিভেদ ও বিদ্বেষমূলক নীতি কতটুকু কি কার্যকর হবে–সে প্রশ্ন থাকছেই।
অন্য দিকে ধর্মীয় সেন্টিমেন্টকে পুঁজি করে সুযোগসন্ধানী এরদোগানের ফরাসি–বিদ্বেষ নীতিও নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে বলেই মনে করা হচ্ছে। শেষ বিচারে বিশ্বব্যাপী ফরাসী পণ্য বয়কট আন্দোলনের ভয়াবহ কুফল ভোগ করতে হবে মুসলিম জনগোষ্ঠীকেই। এমনিতেই ইউরোপ ও আমেরিকায় মুসলিমদের ভ্রমণ কিংবা ভিসা পাওয়া দিন দিন কঠিন হচ্ছে। আগামী দিনে যা আরও কঠোর হয়ে উঠতে পারে। ইউরোপ–আমেরিকায় মুসলিম জনগোষ্ঠীর ভিসা পাবার হার অনেক কমে যাবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। শুধু তাই নয়, মুসলিম শরণার্থীদের ইউরোপের নাগরিক বা স্থায়ী হবার আইন এবং পদ্ধতি আরো কঠোর হবে। এক্ষেত্রে লক্ষ লক্ষ মুসলিম শরণার্থীকে স্থায়ী ভিসার পরিবর্তে অপেক্ষমাণ ভিসা দিয়ে যুগের পর যুগ কাজ করিয়ে নেওয়া হতে পারে। ফলে মুসলিম অভিবাসীরা ইউরোপের দেশগুলোতে আরো বেশি বর্ণবাদ আর বৈষম্যের শিকার হবে।
কাজেই ধর্মীয় ভাবাবেগে পরিচালিত ‘বয়কট ফ্রান্স’ আন্দোলন শেষ পর্যন্ত বড় ক্ষত ও ক্ষতির সৃষ্টি করতে পারে। সবচেয়ে বড় কথা ধর্ম রক্ষার জন্য ফ্রান্সকে বয়কটের প্রয়োজন নেই। প্রয়োজন ধর্মকে ধারণ করা। ধর্মের সুনীতিগুলো যদি সত্যিই কল্যাণকর হয়, তাহলে অন্যরাও সেই ধর্মে আকৃষ্ট হবে। নিজের ধর্ম রক্ষার জন্য কাউকে খুন করার প্রয়োজন নেই। আপনগুণেই ধর্ম বিকশিত হবে।
তা ছাড়া ধর্ম নিজের ভেতরে চর্চার জিনিস। যা অন্তরে ধারণ করতে হয়, চর্চা করতে হয়। অন্যের কথায় নেচে উগ্রতা ছড়ানোর জিনিস নয়। আমাদের সরল বিশ্বাসকে পুঁজি করে অনেকেই উগ্রতা ছড়িয়ে নিজেদের স্বার্থ হাসিল করার চেষ্টা করেন। সেই সুযোগ কাউকে দেওয়া উচিত নয়। ম্যাক্রোঁকে নয়, এরদাগানকেও নয়।
ইসলামসহ বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থে ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি না করার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, মানুষ ধর্ম নিয়েই সবচেয়ে বেশি বাড়াবাড়ি করছে। ধর্ম অবমাননার অভিযোগ পেলেই তার সত্যাসত্য যাচাই না করে মানুষ উন্মত্ত হয়ে উঠছে। মানুষ হিসেবে এটাই আমাদের সবচেয়ে বড় ক্ষুদ্রতা। বড় অধর্ম। এ অধর্ম চলছে তো চলছেই।
সর্বশেষ লালমনিরহাটে ইসলাম অবমাননার গুজব পিটিয়ে জুয়েল নামে একজন সাবেক কলেজ শিক্ষককে পুড়িয়ে মারা হয়েছে। এ হত্যার দায় আমাদের সকলের। ক্ষমতাসীনরাও এ দায় এড়াতে পারেন না। ক্ষমতায় থাকার লোভে এদেশে ধর্মকে সবার ওপরে, সব থেকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। রাজনৈতিক দলগুলো নিজেরদের প্রভাব ও জনসমর্থন বাড়াতে ধর্ম নিয়ে খেলছেন। ঘুষ, দুর্নীতি, ধর্ষণ, নারী নির্যাতন, খুন, ছিনতাই, রাহাজানির মতো ঘটনাগুলো চরম অধর্মের প্রকাশ হলেও সেসব নিয়ে আমাদের মাথাব্যথা নেই। ধর্ম আমাদের মধ্যে মানবিক অনুভূতিগুলোকে, ঈমানকে শক্ত করতে পারছে না। আমরা ধর্ম অবমাননার ইসু খুঁজে বের করছি আর উন্মত্তের মতো আচরণ করছি। প্রশ্ন হলো, এই যে ধর্ম অবমাননার নামে একজন একজন মানসিক প্রতিবিন্ধী ব্যক্তিকে পিটিয়ে–পুড়িয়ে মেরে ফেলা হলো, তাতে কি ধর্মের মর্যাদা বেড়েছে? নাকি এতে আরও বেশি ধর্মের অবমাননা হয়েছে?
হাজার হাজার মানুষ যেখানে একজন মানুষকে পিটিয়ে আগুনে পুড়িয়ে হত্যা করেছে, সেখানে কেউ কি এই ঘটনায় কেউ ব্যথিত, বিস্মিত, ক্ষুব্ধ হয়েছেন? মনে হয় না! তাহলে কোথায় আমাদের ধর্ম? মানুষ হয়ে মানুষের প্রতি আমরা যদি সহমর্মী না হই, উন্মত্ত আচরণ করি, মানুষকে বাঁচানোর ক্ষেত্রে নয়, বরং মরার ক্ষেত্রে ভূমিকা পালন করি, তাহলে এর চেয়ে বড় অধর্ম আর কি হতে পারে?
কিছু মানুষ ও সংগঠন ধর্মের নামে সাংঘাতিক ধর্মান্ধতা দেখাচ্ছে। এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে হবে। ধর্মের নামে, ধর্ম অবমাননার কথা বলে যারা অন্যায় করছেন, তার বিরুদ্ধেও সোচ্চার হতে হবে। অন্যায়কারী ও অন্যায়ের সমর্থক, দু’জনেই সমান অপরাধী। ধর্মান্ধতার মোকাবিলা কঠোর ভাবে করতে না পারলে ক্ষতি হয় প্রকৃত ধর্মের।