টক অব দ্যা সিলেট : কেমনে আটক হলো আকবর?
আকবরের আকুতি ‘মোজে জান ভিক্ষা দে মেরা ভাই

Published: 9 November 2020

সিলেট অফিস :  সিলেট বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ বরখাস্ত আকবর হোসেন ভূঁইয়াকে গ্রেফতার নিয়ে সিলেটে শুরু হয়েছে নানা আলোচনা সমালোচনা।

বেশ কয়েকটি ভিডিও ভাইরাল হওয়ার পর নানা প্রশ্নও দেখা দিয়েছে বিভিন্ন মহলে।
খাসিয়াদের পাঠানো ভিডিও চিত্রে দেখা গেছে আকবরকে যেখান থেকে আটক করা হয়েছে সেখানে দুটি ভারতীয় কার। দুর্গম এলাকায় কার দুটি কিভাবে আসল এ নিয়েও প্রশ্নের শেষ নেই। অনেকে বলেছেন আকবরকে ভারতীয় গোয়েন্দা বাহিনী অন্য জায়গা থেকে আটক করে খাসিয়াদের মাধ্যমে পুশব্যাক করিয়েছে।
অন্য সুত্র জানায়, দুর্গম এলাকার খাসিয়ারা রায়হান হত্যা নিয়ে তেমন ওয়াকিবহাল নয়। তারপর চেহারা সুরত বদলিয়ে আকবর অন্য রুপ ধারণ করেছে তাই আকবর নামক একজন খুনি ভারতে রয়েছে তা তারা জানার কথা নয়। অনেকের প্রশ্ন কে বা কাহারা খাশিয়াদের হাতে আকবরকে তুলে দিয়ে নিশ্চিত করেছে সে রায়হানের খুনি। আর তারই মাধ্যমে তারা অবগত হয়েই সীমান্ত অতিক্রম করে দেশে পাঠিয়েছে।
সুত্র জানায়, ডনা সীমান্ত এলাকা দু’দেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর শতর্ক পাহারা রয়েছে। এই পাহারার মধ্যে কিভাবে অর্ধশত খাসিয়ার কাছ থেকে ৬ জন বাংগালী আকবরকে নিরাপদে দুই দেশের সীমান্ত রক্ষীদের চোখ ফাঁকি দিয়ে দেশে নিয়ে আসলো ?

ভিডিও চিত্রে দেখা গেছে গলায় খাসিয়াদের সাজে পুঁথির মালা। মুখে দাড়ি। ক্লান্ত শ্রান্ত চেহারা। পরনে ফুল হাতা শার্ট। রশি দিয়ে বেঁধে রাখা কোমর। প্রথম দেখাতে কারোরই বুঝতে পারার কথা না যে তিনিই বন্দরবাজার ফাঁড়ির একসময়ের দাপুটে ইনচার্জ এসআই (বরখাস্তকৃত) আকবর হোসেন ভূঁইয়া। হ্যা তিনিই সেই এসআই আকবর। যার হাতে নির্মমভভবে মৃত্যু হয়েছে আখালিয়ার যুবক রায়হানের। হত্যার পর পালিয়ে গিয়েছিলেন সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ভারতে অবস্থান নেন। সেখান থেকে ভারতীয়রা তাকে ধরে তুলে দিয়েছে কানাইঘাটের সীমান্তবর্তী জনতার হাতে। আর তাদের হাত থেকেই গ্রেফতার করেছে সিলেট জেলা পুলিশ।

তবে পুলিশ সুপার বলছেন, তাদের সাজানো ছকে এবং ‘বিশ্বস্ত বন্ধুদের’ সহযোগিতায় বাংলাদেশ সীমান্ত থেকেই তারা ধরেছেন আকবরকে।

এদিকে, ভাইরাল হওয়া একটি ভিডিও চিত্র দেখে অনেকটা স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছে যে তিনি আটক হয়েছেন ভারতীয়দের হাতেই। পরে তাকে সীমান্তে হস্তান্তর করা হয়। ওই ভিডিও চিত্রে দেখা যায়, তাকে দুটি সাদা গাড়ির মাঝখানে আটকে রেখে হাত বেঁধে প্রশ্ন করা হচ্ছে হিন্দিতে। আর আকবর ভাঙ্গা ভাঙ্গা হিন্দি ও বাংলা মিলিয়ে উত্তর দিচ্ছেন। তিনি সেই ভিডিওতে হিন্দিতে বার বার বলছেন, ‘মোজে জান ভিক্ষা দে মেরা ভাই’।

প্রশ্নকর্তারা বলছেন ইন্ডিয়া কেমনে আসছ- প্রশ্ন। আকবর বলেন, ‘ইন্ডিয়ায় একটা পরিবার আছে। বলছিল, যে গেলে এখানে থাকার জায়গা পাবে। ’ আরেকজন প্রশ্ন করছেন তুমি কি দোষ করছো সেখানে (বাংলাদেশে)। প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, এক রিমান্ডে আসামিকে মারছি। আমি একা মারিনি। আরও ৬/৭জন পুলিশ ছিলো। এসময় একজন আকবরের দিকে ছুরি হাতে তেড়ে গেলে তিনি ভয় পেয়ে বললেন, ভাই আমি ঠিক বলছি, ঠিক বলছি। আমিও মারছি।’ এসময় তিনি বার বার প্রাণ ভিক্ষা দেয়ার আকুতি জানান তাদের কাছে। একটি বিশ্বস্ত সূত্র বলছে, এই ভিডিও গ্রেফতারের আগের দিনের।

আকবরকে পুলিশের কাছে সোপর্দ করার আগে আরো দুটি ভিডিও সোস্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয়েছে। দুই মিনিটের বেশি সময় স্থায়ী দুটো ভিডিও’র প্রথমটি দুই মিনিট পাঁচ সেকেন্ডের। এতে দেখা গেছে, আকবরকে পিছমোড়া করে বেঁধে রাখা। দুই হাত পেছনে রেখে রশি টাঙিয়ে তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে দেখা গেছে কয়েকজনকে। এ সময় আকবর বলেন, ‘আমাকে বলা হয়, তুমি চলে যাও, দুই মাস পর পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে ফিরে আসবা।… আমি মারিনি ভাই।’

দ্বিতীয় ভিডিওতে দেখা গেছে আকবর বসা। ২ মিনিট ৩৫ সেকেন্ড স্থায়ী এই ভিডিওতে শোনা যায়, আকবরকে নাম জিজ্ঞেস করা হচ্ছে। এ সময় আকবর বসা ছিলেন। নাম কি? জানতে চাওয়ায় আকবর দুই হাত জোড় করে বলেন, ‘আমি আকবর’। ‘তুমি আকবর, তুমি তো পালাইয়া আসছো, হত্যা করছো?’জবাবে আকবর বলেন, ‘না, ভাই আমি মারিনি। হাসপাতালে নিয়েছি।’এ সময় সঙ্গে থাকা কয়েকজনকে বলতে শোনা যায়, ‘মাইরও না। এইটা বাংলাদেশী।…বিচার হবে। বিচার করবে তাঁরা…।’

আকবর ‘আমি বাঁচব না ভাই…’ বলে আহাজারী করছিলেন। আকবরকে নাম জিজ্ঞেস করার সময় হাতজোড় করে থাকতে দেখা যায়। যারা তাঁকে নানা প্রশ্ন জিজ্ঞেস করছিলেন, তাঁদের কারো কারো কথাবার্তা বাংলা হলেও খাসিয়াদের মতো টান ছিল। আর আকবরের গলায় পুঁথির মালা ছিল। অনেকটা খাসিয়া যুবকের মতো সাজে ছিলেন আকবর। কথাবার্তার একপর্যায়ে পানির বোতল এগিয়ে দেওয়া হয় আকবরকে।

ভিডিওতে যে স্থানে আকবরকে দেখা গেছে, সেটি পাহাড়ি এলাকা। ঝোপঝাড় ও ঝরনা মাড়িয়ে আকবরকে নিয়ে যেতে দেখা যায়। এরপর আকবরকে বাংলাদেশী জনতার কাছে হস্তান্তর করা হয়। এরপর রশি দিয়ে বেঁধে পুলিশে সোপর্দ করা হয়।

এদিকে, পুলিশ সুপার ফরিদ উদ্দিন আহমদ সোমবার সন্ধ্যা রাতে প্রেস ব্রিফিংয়ে বলেন, জেলা পুলিশের প্রত্যক্ষ তত্বাবধানে এসআই আকবরকে সীমান্ত এলাকা থেকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তিনি বলেন, আমরা রোববার ইনফরমেশন পেয়েছিলাম কানাইঘাট সীমান্ত দিয়ে সে পালিয়ে যেতে পারে। এজন্য আমরা সেখানে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করেছিলাম। বিশেষ করে এই টিমে নেতৃত্ব দেন কানাইঘাট ও জকিগঞ্জ থানার ওসিসহ পুলিশের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। ৩ দিন সর্বোচ্চ চেষ্টা চালিয়ে সোমবার সকাল ৯টায় সাদা পোশাকে জেলা পুলিশ আকবরকে গ্রেফতার করতে সক্ষম হয়েছে। পুলিশের কাছে খবর আসে- আকবর ভারতে পালিয়ে যেতে পারে। এ খবর পেয়েই কানাইঘাট ও জকিগঞ্জ সীমান্তে নজরদারি বৃদ্ধি করা হয়। পুলিশের আইজি ড. বেনজীর আহমেদের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, স্যারের প্রত্যক্ষ নির্দেশ ছিল এ বিষয়ে। এছাড়া সিলেটের রেঞ্জ ডিআইজি স্যারও সার্বক্ষণিক এই বিষয়ে পরামর্শ ও নির্দেশনা দিয়েছিলেন।

এসপি বলেন, আকবরকে গ্রেফতারে সহযোগিতা করেছেন সীমান্ত এলাকার কয়েকজন ‘বিশ্বস্ত বন্ধু’। আকবর ভারতে পালিয়ে গিয়েছিল নাকি সে সীমান্ত দিয়ে ভারতে যেতে চেয়েছিল- তা তদন্ত করা হচ্ছে।

এর আগে গোয়েন্দা সূত্র জানিয়েছিলো, রায়হান আহমদ মারা যাওয়ার দুদিন পরই আকবর সিলেটের কোম্পানীগঞ্জ দিয়ে ভারতের মেঘালয়ে পালিয়ে গেছেন। এ ব্যাপারে সংবাদ সম্মেলনে পুলিশ সুপার বলেন, সে আগে ভারতে পালিয়ে গিয়ে আবার ফিরে আসতে পারে। তবে আমরা তাকে সীমান্ত এলাকা থেকেই গ্রেফতার করেছি।

আকবরকে আটকের কিছু ভিডিওচিত্র সোশ্যাল মিডিয়া ফেসবুকে ভাইরাল হয়েছে। তাতে দেখা যায় একদল খাসিয়া আকবরের হাত পা বেঁধে পাহাড়ি ছড়া দিয়ে হাঁটিয়ে নিয়ে আসছেন। এসময় ওই যুবকরা আকবরকে বিভিন্ন প্রশ্নও করেন। কানাইঘাট এলাকার স্থানীয় কয়েকজন জানিয়েছেন, ভিডিওতে যে যুবকদের দেখা গেছে তারা খাসিয়া স¤প্রদায়ের এবং যে জায়গার ছবি দেখা গেছে তা ভারতের অভ্যন্তরের।

এ ব্যাপারে পুলিশ সুপারকে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, একটি ভিডিও ছড়িয়েছে বলে শুনেছি। তবে সেটি এখনো আমি দেখিনি। আমরা বাংলাদেশের সীমান্ত থেকেই পুলিশের স্থানীয় কিছু বন্ধুদের সহযোগিতায় আকবরকে গ্রেফতার করেছি। রাত পৌনে ৮ টার দিকে পিবিআই’র কাছে আকবরকে হস্তান্তর করা হয় বলে এসপি জানান। পিবিআইর একটি দল পুলিশ সুপার কার্যালয়ে এসে আকবরকে নিয়ে যায়। তিনি বলেন, পরবর্তী আইনী পদক্ষেপ পিবিআই নেবে। সন্ধ্যা ৫টা ৫৫ মিনিটে কঠোর নিরাপত্তায় তাকে কানাইঘাট থেকে সিলেট পুলিশ সুপার কার্যালয়ে নিয়ে আসা হয়।

পুলিশ সুপার বলেন, কেউ আইনের উর্ধে নয়। যে কেউ আইন অমান্য করলে তাকে শাস্তি পেতে হবে। এসআই আকবর জঘন্য কাজ করেছে। তাই তাকেও শাস্তি পেতে হবে।

নগরীর আখালিয়া নিহারিপাড়ার বাসিন্দা রায়হানকে ১০ অক্টোবর রাতে সিলেটের বন্দরবাজার ফাঁড়িতে তুলে নিয়ে নির্যাতন করা হয়। পরের দিন ১১ অক্টোবর তিনি মারা যান। এ ঘটনায় হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইনে তাঁর স্ত্রী তাহমিনা আক্তার বাদী হয়ে কোতোয়ালি থানায় মামলা করেন। ১২ অক্টোবর ফাঁড়ির ইনচার্জের দায়িত্বে থাকা এসআই আকবর হোসেনসহ চারজনকে সাময়িক বরখাস্ত ও তিনজনকে প্রত্যাহার করা হয়। পরের দিন থেকে তিনি লাপাত্তা ছিলেন।