বিজ্ঞান গবেষণা, সহযোগিতা ও অর্থায়ন বৃদ্ধিতে ইউনেসকোর আহ্বান
।।বিধান চন্দ্র দাস।।
পৃথিবীজুড়ে এখন বড় দুঃসময় চলছে। বিগত কয়েক মাসে আমাদের চেনা পৃথিবীটা অনেকটাই পাল্টে গেছে। এখন আমরা অপেক্ষা করছি, কবে আবার স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে আসবে। সেই সঙ্গে অধীর আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করছি একটি কার্যকর ভ্যাকসিন পাওয়ার জন্য। তাকিয়ে আছি গবেষণাগারগুলোর দিকে, যেখানে বিজ্ঞানীরা নিরলসভাবে এ জন্য কাজ করে চলেছেন। আমরা বুঝতে পারছি ও বিশ্বাস করছি গুটিবসন্ত, হাম, ডিপথেরিয়া, টিটেনাস, হুপিং কাশি, হেপাটাইটিস ‘বি’, পোলিওর মতো ভয়ংকর সংক্রামক রোগগুলোর ভ্যাকসিন যেমন বিজ্ঞানের অবদান, তেমনি কভিড-১৯-এর সমাধানও আনবে বিজ্ঞান।
বিজ্ঞানের ডানায় ভর করেই সভ্যতার বিকাশ ঘটেছে। সমাজ অগ্রগতির পেছনে বিজ্ঞান ও বিজ্ঞানীর ভূমিকা অপরিসীম। তবে বিজ্ঞান ইতিহাস বিশেষজ্ঞদের মতে, আদিতে বর্তমান মানবপ্রজাতি কিংবা বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া মানবসদৃশ প্রজাতিগুলো ক্ষুধা ও প্রকৃতির বিরূপতা জয় করার জন্য প্রথমে প্রযুক্তির উদ্ভব ঘটিয়েছিল। প্রকৃতির অন্য অনেক প্রজাতির মধ্যে প্রযুক্তিগত বিষয় (যেমন মৌমাছির চাক তৈরি করা) সহজাত হলেও মানবপ্রজাতির জন্য তা ছিল অর্জনের, শিক্ষণের ও জ্ঞানের। বিজ্ঞানের উৎপত্তি ও বিকাশের সূচনা ঘটেছিল এভাবেই।
বিজ্ঞান হচ্ছে বুদ্ধিবৃত্তিক ও ব্যাবহারিক কার্যক্রম—যার মাধ্যমে ভৌত ও প্রাকৃতিক বিশ্বের গঠন ও চরিত্রকে পর্যবেক্ষণ ও পরীক্ষণের দ্বারা সুশৃঙ্খলভাবে অধ্যয়ন করা হয়। আর প্রযুক্তি হচ্ছে বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের ব্যাবহারিক প্রয়োগ, বিশেষ করে শিল্পের ক্ষেত্রে। সেই হিসেবে আজ আমরা বিজ্ঞান বলতে যা বুঝি, মানব ইতিহাসের শুরুতে তা এভাবে ছিল না। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এর উৎপত্তি ও বিকাশ ঘটেছে। এ কথা অনস্বীকার্য যে একসময় প্রযুক্তি ও বিজ্ঞান দুটি ভিন্ন ধারায় প্রবাহিত হলেও এখন তা মিলেমিশে অনেকটাই একে অপরের পরিপূরক হয়ে দাঁড়িয়েছে। বর্তমানে বিজ্ঞান বলতে আমরা সাধারণভাবে প্রযুক্তিকেও অন্তর্ভুক্ত করে থাকি।
ইউনেসকো এবারের বিশ্ব বিজ্ঞান দিবসের (১০ নভেম্বর ২০১০) প্রতিপাদ্য করেছিল, ‘কভিড-১৯ মোকাবেলায় সমাজের জন্য ও সমাজের সাথে বিজ্ঞান’ (সায়েন্স ফর অ্যান্ড উয়িদ সোসাইটি ইন ডিলিং উয়িদ কভিড-১৯)। এই দিবস উপলক্ষে ইউনেসকোর মহাসচিব অ্যাড্রি অ্যাজুলে এক বার্তায় জানিয়েছিলেন, ‘পৃথিবীর বর্তমান সংকট আমাদের জানান দিচ্ছে বিজ্ঞান গবেষণা, সহযোগিতা ও অর্থায়ন বৃদ্ধি করা প্রয়োজন।’ ইউনেসকো তিনটি বিষয়ের ওপর জোর দিয়েছে। এগুলো হচ্ছে : ১. আন্তর্জাতিক বৈজ্ঞানিক সহযোগিতা বৃদ্ধিকরণ, ২. বিশুদ্ধ পানি নিশ্চিতকরণ ও পয়োনিষ্কাশনব্যবস্থা উন্নতকরণ ও ৩. বাস্তুতাত্ত্বিক পুনর্গঠন।
কভিড-১৯-কে বিবেচনায় নিয়ে এগুলো কিভাবে কার্যকর করা যাবে, সে বিষয়ে ইউনেসকো কিছু ইঙ্গিত দিয়েছে। আন্তর্জাতিক বৈজ্ঞানিক সহযোগিতা বৃদ্ধির বিষয়ে বলা হয়েছে, আন্তর্জাতিক ও জাতীয় পর্যায়ে বৈজ্ঞানিক সহযোগিতা জোরদার করা অত্যন্ত জরুরি। এ ছাড়া বিজ্ঞানী, নীতিনির্ধারক, পেশাজীবী, শিল্পপতি, চিকিৎসক, সুধীসমাজ ও জনগণের মধ্যে সংলাপের প্রয়োজনের কথাও বলা হয়েছে। বৈজ্ঞানিক জ্ঞান ও তথ্যের আদান-প্রদানে প্রবেশাধিকার, প্রমাণভিত্তিক নীতি ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং বিজ্ঞানকে বৈশ্বিকভাবে উন্মুক্তকরণের পক্ষে ইউনেসকো সুপারিশ করেছে। কভিড-১৯ ছড়িয়ে পড়া ঠেকাতে ও মহামারি মোকাবেলার জন্য বিশুদ্ধ নিরাপদ পানি ও উন্নত পয়োনিষ্কাশন ব্যবস্থা অপরিহার্য বলে ইউনেসকো উল্লেখ করেছে। পানি নীতিমালা তৈরি ও পানিসম্পদের সুস্থায়ী ব্যবস্থাপনাসহ উন্নত পয়োনিষ্কাশনব্যবস্থা তৈরির জন্য ইউনেসকোর পক্ষ থেকে বৈজ্ঞানিক ও কারিগরি সহায়তা প্রদানের কথাও বলা হয়েছে। বাস্তুতাত্ত্বিক পুনর্গঠনের জন্য ইউনেসকো জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে সমন্বিত পদ্ধতি প্রয়োগের ব্যাপারে জোর দিয়েছে। সেই সঙ্গে জীববৈচিত্র্যের সুস্থায়ী ব্যবহার ও উন্নয়নের ওপর ইউনেসকো গুরুত্ব দিয়েছে। এসব কাজ করার জন্য বৈজ্ঞানিক গবেষণা, সহযোগিতা ও অর্থায়ন বৃদ্ধির প্রয়োজনীয়তা অস্বীকার করার উপায় নেই।
উল্লিখিত বিষয়গুলো শুধু কভিড-১৯ মোকাবেলার জন্য প্রযোজ্য নয়, বরং আমাদের বর্তমান ও অনাগত আরো অনেক সমস্যা মোকাবেলার জন্যও প্রয়োজন। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, এগুলো কার্যকর করা খুব সহজ কাজ নয়। প্রথমত, ধরা যাক আন্তর্জাতিক বৈজ্ঞানিক সহযোগিতার কথা। গোপনীয়তা, নিরাপত্তাঝুঁকি ও ব্যবসা স্বার্থ রক্ষা করার মতো বিষয়গুলো এই সহযোগিতা বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে অন্যতম চ্যালেঞ্জ। দ্বিতীয়ত, বিশুদ্ধ পানি নিশ্চিতকরণ ও পয়োনিষ্কাশনব্যবস্থা উন্নতকরণ। জনসংখ্যা বৃদ্ধি ও আর্থ-সামাজিক বৈষম্য পৃথিবীর প্রত্যেক মানুষের জন্য বিশুদ্ধ পানির প্রাপ্যতা ও উন্নত পয়োনিষ্কাশন ব্যবস্থা নিশ্চিত করা কঠিন ও জটিল করে তুলেছে। তৃতীয়ত, বাস্তুতাত্ত্বিক পুনর্গঠনের জন্য আমাদের চারপাশে যে পরিমাণ বনভূমি তথা জীববৈচিত্র্য, জলাশয়, উন্মুক্ত প্রান্তরসহ দূষণহীন পরিবেশ ফিরিয়ে আনা প্রয়োজন, তার অন্যতম প্রধান বাধা হচ্ছে জনসংখ্যা। এ ছাড়া এসব কাজে অর্থায়ন বৃদ্ধির বদলে পরিবেশ ও মানুষের জন্য ক্ষতিকর কাজেই অনেকের উৎসাহ।
আন্তর্জাতিক বৈজ্ঞানিক সহযোগিতা প্রদানের ক্ষেত্রে অতীতে অনেক দেশের তিক্ত অভিজ্ঞতা হয়েছে। বর্তমানে কভিড-১৯-এর ভ্যাকসিন তৈরির বিষয়টি নিয়েও বিভিন্ন দেশের কয়েকটি গবেষণাগারের পক্ষ থেকে তথ্য কিংবা নমুনা চুরি হওয়ার আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে। এসব ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে আন্তর্জাতিক বৈজ্ঞানিক সহযোগিতার পথ ক্রমাগত সংকুচিত হচ্ছে। আন্তর্জাতিক ফোরামে বিষয়টির সমাধান খোঁজা দরকার।
জনসংখ্যা বৃদ্ধির সমস্যাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন। পৃথিবীর বর্তমান জনসংখ্যা পৃথিবীর মোট প্রাকৃতিক সম্পদের সুস্থায়ী ব্যবহারের হিসাবে দেড় গুণেরও বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে। এখনই বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে কঠোরভাবে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ করা দরকার। সেই সঙ্গে দরকার মানুষের সুষম খাদ্য, বিশুদ্ধ পানীয়, উন্নত পয়োনিষ্কাশনব্যবস্থা ও দূষণহীন ভারসাম্যময় পরিবেশ নিশ্চিত করার জন্য বিজ্ঞানকে সঠিকভাবে কাজে লাগানো। তবে এসব কাজ সম্পন্ন করার জন্য দেশে দেশে বৈজ্ঞানিক গবেষণা, আন্তর্জাতিক সহযোগিতা ও অর্থায়ন বৃদ্ধির কোনো বিকল্প নেই।
এ কথা ঠিক, বিজ্ঞান যে গতিতে এগিয়ে চলেছে, সমাজ তার সঙ্গে মিল রেখে এগোতে পারছে না। তৈরি হচ্ছে সংকট। কয়েক দশক আগে যুক্তরাষ্ট্রের বিখ্যাত কল্পবিজ্ঞান লেখক আইজাক অ্যাসিমভ বলেছিলেন, ‘আমাদের জীবনে সব থেকে দুঃখের বিষয় হচ্ছে বিজ্ঞান যে গতিতে এগিয়ে চলেছে, সামাজিক প্রজ্ঞা সেই গতিতে বৃদ্ধি পাচ্ছে না।’ ফলে বিজ্ঞানের অপব্যবহার প্রকট থেকে প্রকটতর হচ্ছে। আমরা বিজ্ঞানকে যতটা না ব্যবহার করছি মানুষের রোগব্যাধি নিরাময় তথা মানবকল্যাণের জন্য—তার থেকে অনেক বেশি ব্যবহার করছি যুদ্ধাস্ত্র তৈরি করে মানুষ মারার জন্য। প্রকৃতি আর পরিবেশ ধ্বংস করার জন্য। অনৈতিকভাবে অর্থ উপার্জনের জন্য। এসব বিষয় পর্যালোচনা করলে বিজ্ঞান ব্যবহারে আমাদের সামাজিক প্রজ্ঞার ঘাটতি স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
সমাজের জন্য ও সমাজের সঙ্গে বিজ্ঞানকে দেখতে হলে আমাদের মানসিকতার পরিবর্তন প্রয়োজন। বিজ্ঞানকে এমনভাবে ব্যবহার করা যাবে না, যা প্রকৃতি-পরিবেশ তথা মানবকল্যাণের বিরুদ্ধে যায়। বিজ্ঞানের সুযোগ-সুবিধা গ্রহণ করে বিজ্ঞানকে অস্বীকার করার মূঢ়তা ত্যাগ করতে হবে। সমাজ অগ্রগতির স্বার্থেই কুসংস্কার পরিহার করা উচিত। বিজ্ঞানমনস্ক সমাজই পারে বিজ্ঞানকে অপব্যবহার থেকে রক্ষা করে তাকে শান্তি ও উন্নয়নের কাজে ব্যবহার করতে। বিজ্ঞান গবেষণা, সহযোগিতা ও অর্থায়ন বৃদ্ধি এখন সময়ের দাবি।
লেখক : অধ্যাপক, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়