ভ্যাকসিন-সন্দেহবাদ কিভাবে দূর হবে
১৯৬০-এর দশকে গুজব নিয়ে গবেষণা করতে গিয়ে শিক্ষাবিদরা মহামারিবিদ্যার সহযোগিতা নিয়েছিলেন। তাঁরা লক্ষ করলেন, কিভাবে একেকটা জনগোষ্ঠীর মধ্যে একেকটা কাহিনি ছড়িয়ে পড়ে, যা কিছু মানুষকে আক্রান্ত করে, কেউ কেউ অনাক্রান্ত থেকে যায় এবং আবার একদল প্রতিরোধী মানুষ এটাকে থামিয়ে দিতে পারে।
পরবর্তী সময়ে গবেষকদের এই অন্তর্দৃষ্টি স্বাস্থ্য পেশাজীবীরাও গ্রহণ করেছিলেন। তাঁরা মনে করলেন, রোগের প্রাদুর্ভাব নিয়ন্ত্রণে জনশ্রুতিকেও কাজে লাগানো যেতে পারে এবং যদিও এটি ভয়ংকরও হতে পারে। আবিষ্কারের শুরু থেকে টিকা নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্ব চলে এলেও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে তা অনেক দেশে বেড়ে গেছে। টিকাদান কর্মসূচির নিরাপত্তা সম্পর্কে ভিত্তিহীন ভয়ের গল্পই মূলত ক্রমবর্ধমান টিকা সন্দেহবাদ ও সরাসরি প্রত্যাখ্যানের কারণ হয়ে উঠেছে। অধ্যাপক হেইডি লারসন তাঁর ‘স্টাক : হাউ ভ্যাকসিন রিওমার্স স্টার্ট অ্যান্ড হোয়াই ডন্ট গো-অ্যাওয়ে’ গ্রন্থে বলেছেন, ‘আমাদের যেমন আগের চেয়ে অধিকতর ভালো ভ্যাকসিন বিজ্ঞান রয়েছে, আরো ভালো নিরাপত্তা বিধি ও প্রক্রিয়া রয়েছে; তেমনি আমাদের মধ্যে আতঙ্কিত মানুষও রয়ে গেছে।’
অদূর ভবিষ্যতে কভিড-১৯ ভ্যাকসিন সম্ভবত চাহিদার পরিমাণকে ছাড়িয়ে যাবে। মার্কিন কম্পানি মডার্নার পর ফাইজার-বায়োএনটেক ঘোষণা দিয়েছে তাদের ভ্যাকসিন ৯০ শতাংশের বেশি কার্যকর। অথচ আগামী বছর পর্যন্ত এটি যুক্তরাষ্ট্রের বাইরে পাওয়া যাবে না। টিকার আরেক প্রতিযোগী অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি-অ্যাস্ট্রাজেনেকা তাদের থেকে কিছুটা পিছিয়ে রয়েছে।
কিন্তু যখনই বহু মানুষ টিকাপ্রাপ্তির সম্ভাবনায় রোমাঞ্চিত, তখনই এক জরিপে জানা গেল বিশ্বের প্রতি চারজন মানুষের মধ্যে তিনজন বলছে তারা টিকা পাওয়া গেলে গ্রহণ করবে। তার মানে টিকা নিতে রাজি নয় এমন মানুষ এক-চতুর্থাংশ। এখন যে অস্বাভাবিক গতিতে এই পণ্যটির উদ্ভাবন ও পরীক্ষা চলে আসছে, তা অন্যদের মধ্যে উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে; এমনকি টিকা নিয়ে স্বভাবসুলভ আশাবাদী মানুষের মধ্যেও উদ্বেগটা দেখা যাচ্ছে। যেখানে গত মে মাসে ৭২ শতাংশ আমেরিকান বলেছিল টিকা পাওয়া গেলে তারা নিশ্চিতভাবে বা সম্ভবত গ্রহণ করবে, সেখানে এখন মাত্র ৫১ শতাংশ বলছে, তারা নিশ্চিতভাবে বা সম্ভবত টিকা নেবে।
এই অনাস্থা বৃদ্ধির পেছনে ভীতি ছড়ানো একটা ভূমিকা রেখেছে। বস্তুত টিকা নিয়ে যাঁরা রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হচ্ছেন, তাঁরা এ জন্য দায়ী। আর সোশ্যাল মিডিয়া অমূলক কিছু দাবি সমর্থন করে কয়েক ঘণ্টা বা কয়েক দিনের মধ্যেই বিশ্বব্যাপী এক ‘তথ্যমারি’ (ইনফোডেমিক-বিভ্রান্তিকর তথ্য বিস্তার) ছড়িয়ে দিচ্ছে, যেখানে অ্যালগরিদম পদ্ধতির কারণে এসব চরমপন্থী পোস্ট চোখের সামনে বেশি আসে। এর ফলে টিকার গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে যে ক্ষতি হয়েছে, তা দূর করতে কয়েক বছর বা দশক লেগে যেতে পারে। যদিও ইন্টারনেট কম্পানিগুলো দেরিতে হলেও কিছু পদক্ষেপ নিচ্ছে; কিন্তু আরো ব্যবস্থা গ্রহণের প্রয়োজন রয়েছে।
আসলে সমস্যাটা শুধু অপপ্রচার নয়; বরং কেন তা বিশ্বাস করা হয় সেটাও একটা সমস্যা। লন্ডন স্কুল অব হাইজিন অ্যান্ড ট্রপিক্যাল মেডিসিন পরিচালনাকারী অধ্যাপক লারসন সতর্ক করে দিয়েছেন যে মানুষ যখন বুঝতে পারে তারা বোকার মতো ব্যবহৃত হয়েছে, তখন নিজেদের অবস্থান নিয়েই তাদের মধ্যে সন্দেহ বাড়ে, যা ভ্যাকসিন দোদুল্যমানতা ও প্রত্যাখ্যানের দিকে মোড় নেয়।
ভ্যাকসিনবিরোধী প্রচারের বিরুদ্ধে লড়তে হলে মানুষের মধ্যে কঠোর মনোভাব তৈরির আগেই লড়তে হবে। যখন কোনো পরীক্ষিত প্রমাণও বন্য বক্তব্য ও অযৌক্তিক কাহিনি মোকাবেলা করতে ব্যর্থ হয়, তখন তা হতাশাজনক বটে। তবে সন্দেহের কিছু অন্তর্নিহিত যুক্তিও আছে। এটা সত্য যে জায়ান্ট ওষুধ কম্পানিগুলো প্রায় ক্ষেত্রেই নৈতিক সংশয় তথা যাচাই-বাছাইয়ে বেশি সময় দিতে রাজি নয় এবং সরকারগুলোও সব সময় জনগণের জীবনের বিষয়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নেয় না। আবার মেডিক্যাল স্টাফরাও অনেক সময় যৌক্তিক উদ্বেগ উড়িয়ে দিতে চান। ফলে একটি টিকাকে সম্পূর্ণভাবে ঝুঁকিমুক্ত করা যায় না।
যুক্তরাষ্ট্রে কৃষ্ণাঙ্গদের সম্মতি ছাড়াই তাদের ওপর শ্বেতাঙ্গ বিজ্ঞানীদের পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালানোর ভয়াবহ ইতিহাস রয়েছে। এই যখন অবস্থা, তখন স্বাস্থ্যসেবায় চলমান বর্ণবাদী বৈষম্যের মধ্যেই শ্বেতাঙ্গদের তুলনায় কৃষ্ণাঙ্গরা কভিড-১৯ টিকা কম নেবে বলে জানিয়েছে। অথচ রোগটিতে তাদের দ্বিগুণ মারা যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। বস্তুত নতুন টিকার বিষয়ে যথাযথ বার্তা প্রদানের অর্থ শুধুই সুবিধা ও সুরক্ষা সম্পর্কে স্বচ্ছতার বিষয়ই নয়; বরং সম্ভাব্য ঝুঁকি ও অনিশ্চয়তার কথা স্বীকার করা এবং ব্যাখ্যা দেওয়ার প্রয়োজন রয়েছে।
অধ্যাপক লারসন যুক্তি দেখিয়েছেন যে মানুষ যখন নিজেদের মর্যাদাবোধ ও নিজেদের জীবনের ওপর নিয়ন্ত্রণ অনুভব করে না, তখন টিকাবিরোধী সেন্টিমেন্ট বাড়তে থাকে। এখন টিকাদান বিষয়ে মানুষের আস্থা পুনরুদ্ধারের জন্য দীর্ঘ মেয়াদে আরো কিছু মৌলিক পর্যালোচনার প্রয়োজন রয়েছে। অনেকেই আশা করেছিলেন যে অন্তত এই মহামারি মানুষের পুনর্বিবেচনাবোধ তৈরি করবে—কারা মূল্যবান, কী মূল্যবান, কিভাবে আমাদের বাঁচা উচিত এবং একে অপরের সঙ্গে সম্পর্ক রাখা উচিত।
সূত্র : সম্পাদকীয়, গার্ডিয়ান
ভাষান্তর : আফছার আহমেদ