স্থানীয় নির্বাচনে প্রার্থী বাছাইয়ে আওয়ামী লীগের হার্ডলাইন
।। ড. প্রণব কুমার পাণ্ডে।।
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের সাম্প্রতিক সময়ে একটি অনলাইন মিডিয়া ব্রিফিংয়ে বলেছেন, আসন্ন স্থানীয় সরকার নির্বাচনের ক্ষেত্রে দল কেন্দ্রীয় নেতাদের বা সংসদ সদস্যদের ‘ইয়েস ম্যান’দের মনোনীত করবে না। তিনি এর মাধ্যমে আরো একটি বিষয় স্পষ্ট করেছেন যে পূর্ববর্তী নির্বাচনে বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন কিংবা দলীয় মনোনীত প্রার্থীদের বিরুদ্ধে কাজ করেছেন—এমন কাউকেই মনোনয়ন দেবে না দল। এই বার্তাটি আসন্ন স্থানীয় সরকার নির্বাচনে দলের সাফল্যের প্রেক্ষাপটে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।
দলভিত্তিক স্থানীয় সরকার নির্বাচন পদ্ধতি চালু করা ছিল বর্তমান সরকারের একটি প্রশংসনীয় উদ্যোগ। এই পদ্ধতিটি বিভিন্ন উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশে অনুশীলন করা হয়; এমনকি দলভিত্তিক স্থানীয় সরকার নির্বাচনব্যবস্থা আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারতে চালু আছে। সাধারণত শিক্ষাবিদ ও উন্নয়ন অনুশীলনকারীরা স্থানীয় সরকারকে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ অনুশীলনের আবাসস্থল হিসেবে বিবেচনা করেন। জনগণ যদি স্থানীয় পর্যায়ে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ অনুশীলন করে, তবে দেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা আরো জোরদার হবে। এজাতীয় অনুশীলন রাজনৈতিক দলের নেতৃত্ব গড়ে তোলার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে—এমন এক ধরনের রাজনৈতিক পরিবেশে যেখানে রাজনৈতিক প্রক্রিয়া মূলত নিয়ন্ত্রিত হয় ব্যাবসায়িক শ্রেণি এবং সাবেক আমলাদের দ্বারা।
তবে আওয়ামী লীগের মতো একটি রাজনৈতিক দল, যে দলটি বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে স্বাধীনতাযুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়েছিল, ২০১৬ সালে অনুষ্ঠিত ইউনিয়ন পরিষদ, উপজেলা পরিষদ এবং পৌরসভায় দলভিত্তিক নির্বাচনের সন্তোষজনক অভিজ্ঞতা লাভ করতে পারেনি; কারণ তারা দলের অভ্যন্তরে বিভিন্ন ধরনের সমস্যার মুখোমুখি হয়েছিল। দলে অনেক অনুপ্রবেশকারী স্থানীয় প্রভাবশালী নেতাদের সহায়তায় স্থানীয় সরকার নির্বাচনে মনোনয়ন পেয়েছেন। অনেক বিরোধী নেতা এমপি এবং স্থানীয় নেতাদের সহায়তায় ২০১৬ সালের ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়নে নির্বাচন করে বিজয়ী হওয়ার বিষয়টি বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রচারিত হয়েছে। এর ফলে মনোনয়ন পেতে ব্যর্থ নিবেদিতপ্রাণ স্থানীয় নেতাদের মধ্যে অসন্তোষ প্রচুর পরিমাণে বেড়ে যায়।
বর্তমানে আওয়ামী লীগের স্থানীয় রাজনীতির দলীয় সংগঠন সংসদ সদস্য ও উপজেলা চেয়ারম্যানের মধ্যে ক্রমবর্ধমান দ্বন্দ্বের কারণে বিভিন্ন ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েছে। অনেক জায়গায় উপজেলা পর্যায়ের নেতা, সংসদ সদস্য ও পৌরসভার চেয়ারম্যানদের মধ্যে মতবিরোধ রয়েছে। এর মূল অন্তর্নিহিত কারণটি হলো সংসদ সদস্যরা; স্থানীয় পর্যায়ে তাঁদের ঘনিষ্ঠ সহযোগীদের নিয়ে একটি রাজনৈতিক নেটওয়ার্ক গড়ে তোলার চেষ্টা করেন, যাতে তাঁরা তাঁকে সার্বক্ষণিক অটল সমর্থন জোগাবে; এমনকি বেশির ভাগ ক্ষেত্রে উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ের দলীয় কমিটি এই লোকদের নিয়ে গঠিত হয়। অতএব কেন্দ্রীয় নেতারা যখন তৃণমূল থেকে প্রার্থীদের তালিকা চান, তখন এই নেতারা সংসদ সদস্যকে তাঁর পছন্দের মানুষদের নিয়ে তালিকা প্রস্তুত করতে সহায়তা করেন। এজাতীয় অনুশীলন সারা দেশে আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক সংগঠনকে দুর্বল করেছে।
গ্রামীণ বাস্তবতা অনুধাবন করে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক যথাযথভাবে কেন্দ্রীয় ও স্থানীয় পর্যায়ের নেতাদের কেন্দ্রীয় পর্যায়ে প্রার্থীদের তালিকা প্রেরণের সময় সতর্ক থাকার নির্দেশ দিয়েছেন। ২০২১ সালে দেশে স্থানীয় সরকারের বিভিন্ন স্তরে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। পৌরসভা নির্বাচনের প্রথম পর্বটি ২০২০ সালের ডিসেম্বরের শেষের দিকে অনুষ্ঠিত হবে। এরই মধ্যে পৌরসভা নির্বাচনের দ্বিতীয় পর্বের তফসিল ঘোষিত হয়েছে এবং পরের বছরে কয়েকটি ধাপে পৌরসভা নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। ২০২১ সালে প্রায় চার হাজার ৫৫৪টি ইউপিতে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। ফলে ইউপি নির্বাচনের প্রার্থী বাছাই করার সময় ক্ষমতাসীন দল অসুবিধায় পড়তে পারে।
এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপি স্থানীয় পর্যায়ে দুর্বল হয়ে পড়েছে। সারা দেশে নির্বাচনে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থীদের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার প্রয়োজনীয় শক্তি তাদের নেই। সুতরাং আওয়ামী লীগের পক্ষে আসল চ্যালেঞ্জ হলো, নিজের সংগঠনের মধ্যে বিরোধ নিষ্পত্তি করা এবং জনপ্রিয়তা অর্জনকারী ও জনগণের সেবা করতে পারে এমন সেরা প্রার্থীদের মনোনীত করা। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ গত ১২ বছরে দেশের বিভিন্ন সেক্টরে অসাধারণ সাফল্য অর্জন করেছে। এই সাফল্যে বেশির ভাগ জনগণ উপকৃত হয়েছে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সুনাম বৃদ্ধি পেয়েছে, যা স্থানীয় স্তরের ভোটে স্থায়ী প্রভাব ফেলবে।
ক্ষমতাসীনদের নির্বাচন জয়ের বিষয়ে উদ্বিগ্ন হওয়া উচিত নয়, কারণ স্থানীয় পর্যায়ে তাঁদের অবস্থান বিরোধী দলের চেয়ে অনেক বেশি শক্তিশালী। তবে উন্নয়নের সুবিধাকে কাজে লাগাতে হলে দলকে নির্বাচনে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করতে হবে। আমরা জানি যে স্থানীয় পর্যায়ের নির্বাচনের ক্ষেত্রে অনেক বিষয় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। সবচেয়ে বড় কথা, প্রার্থীদের গ্রহণযোগ্যতা এবং ভোটারদের সঙ্গে তাঁদের যোগাযোগ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সে কারণেই আওয়ামী লীগের বহু বিদ্রোহী প্রার্থী ২০১৬ সালে পৌরসভা ও ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচনে জয়লাভ করেছিল।
পূর্ববর্তী স্থানীয় সরকার নির্বাচনের অভিজ্ঞতা থেকে দলের শিক্ষা নেওয়া উচিত। একটি বিষয় লক্ষণীয় যে সাধারণ সম্পাদক নিজেই স্থানীয় পর্যায়ে যাঁরা ‘ইয়েস ম্যান’ নেটওয়ার্ক তৈরি করতে চাইছেন, তাঁদের জন্য একটি পরিষ্কার বার্তা প্রেরণ করেছেন। দলের স্বার্থে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে যাঁরা কাজ করেন, সেসব নিবেদিতপ্রাণ স্থানীয় নেতাদের মনোনয়ন দিয়ে স্থানীয় পর্যায়ে এই নেটওয়ার্ক ভেঙে দলটিকে পুনর্গঠন করার এটাই সময়। কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব যদি এই চক্র ভেঙে দলের পুনর্গঠনের ব্যবস্থা করতে পারে, তবে স্থানীয় পর্যায়ে তাদের অবস্থান আরো শক্তিশালী হবে, যা পরবর্তী সময়ে সংসদ নির্বাচনে তাদের সহায়তা করতে পারে।
এ বিষয়টি অস্বীকার করার মতো নয় যে প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশের উন্নয়নে নিবিড়ভাবে কাজ করে যাচ্ছেন। তিনি শুধু অর্থনৈতিক উন্নয়নের পরিবর্তনের এজেন্ট হয়ে ওঠেননি, কভিড-১৯ মহামারি মোকাবেলায়ও সফল হয়েছেন। বিভিন্ন উন্নত দেশের শক্তিশালী অর্থনীতিগুলো যখন এই মহামারি মোকাবেলার জন্য লড়াই করছে, তখন অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশের অর্থনীতি অনেক বেশি শক্তিশালী অবস্থানে রয়েছে। কভিড-১৯ মহামারিতেও আমাদের জিডিপি খুব একটা কমেনি। আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ মহামারি চলাকালীন আগের রেকর্ডকে ছাড়িয়ে গেছে। সরকার সমাজের দুর্বল ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে সমর্থন করেছে।
যখন আমাদের প্রধানমন্ত্রী দেশের উন্নয়নের জন্য দিন-রাত কাজ করছেন, আওয়ামী লীগের একদল নেতা স্থানীয়ভাবে দলকে দুর্বল করে হলেও তাঁদের অবস্থানকে শক্তিশালী করতে ব্যস্ত রয়েছেন। সুতরাং আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের উচিত স্থানীয় সরকার নির্বাচনে সর্বাধিক যোগ্য প্রার্থীদের মনোনীত করে এই রাজনীতিবিদদের একটি ভালো শিক্ষা দেওয়া। তাঁরা যদি সংসদ সদস্য এবং স্থানীয় নেতাদের ব্যক্তিগত নেটওয়ার্ক ভেঙে দলের জন্য নিবেদিতপ্রাণ নেতাদের মনোনীত করতে পারেন, তবে স্থানীয় পর্যায়ে আওয়ামী লীগকে রাজনৈতিক সংগঠন হিসেবে শক্তিশালী করা সহজ হবে। সরকারের প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নের জন্য ক্ষমতাসীন দলের একটি শক্তিশালী স্থানীয় রাজনৈতিক সংগঠনের অস্তিত্ব অপরিহার্য। সুতরাং আমরা আশা করি যে কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব স্থানীয় সরকার নির্বাচনের প্রার্থীদের মনোনয়নের সময় স্থানীয় পর্যায়ে ‘ইয়েস ম্যান’ নেটওয়ার্ক ভাঙার প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন করবেন। তাঁরা যদি এটি করতে পারেন, তবে রাজনৈতিক সংগঠন হিসেবে আওয়ামী লীগ সবচেয়ে বেশি উপকৃত হবে এবং অনেক বেশি মানুষের সমর্থন লাভ করবে।
লেখক : রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকপ্রশাসন বিভাগের অধ্যাপক