যুক্তরাজ্যে করোনাভাইরাস মিউটেশন: বাংলাদেশেও সতর্কতা জরুরি
।। ড. খোন্দকার মেহেদী আকরাম ।।
প্রথমে কানাডা, তারপর জার্মানি, ফ্রান্স, ইটালিসহ ইউরোপের বেশিরভাগ দেশ এবং সম্প্রতি ভারত ও পাকিস্তান সহ পৃথিবীর প্রায় ৪০ টি দেশ যুক্তরাজ্যের সাথে সকল ফ্লাইট বাতিল করেছে এবং বর্ডার বন্ধ করে দিয়েছে।
আর এর একমাত্র কারণ হচ্ছে যুক্তরাজ্যে করোনাভাইরাসের নতুন এক রুপান্তর বা মিউটেশন যা ভাইরাসটিকে পরিনত করেছে অত্যান্ত সংক্রমণশীল এক মিউট্যান্ট ভাইরাসে!
১৮ ডিসেম্বর যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন আনুষ্ঠানিক ভাবে ঘোষনা দিয়েছেন যে তাদের দেশে করোনাভাইরাসের মিউটেশন ঘটেছে, যার কারণে লন্ডনসহ দেশটির দক্ষিণ এবং দক্ষিণ-পূর্ব অঞ্চলে দ্রুত করোনা সংক্রমণ ছড়িয়ে পরছে। এ অঞ্চলের ৬২ শতাংশ আক্রান্ত মানুষের শরীরেই এই রুপান্তরিত দ্রুতবিস্তার সক্ষম ভাইরাসের উপস্থিতি পাওয়া গেছে। এই নতুন মিউট্যান্ট ভাইরাসটির ছড়িয়ে পরার সক্ষমতা বেড়েছে ৭০ শতাংশ যা আর-নট (R0) নাম্বারের বৃদ্ধি ঘটাচ্ছে ০.৪ ভাগ। আর-নট নাম্বার যত বেশি, ভাইরাস সংক্রমণ বিস্তার ততো দ্রুত। ধারনা করা হচ্ছে খুব দ্রুত এসব এলাকার প্রায় সব সংক্রমণই এই নতুন মিউট্যান্ট করোনাভাইসটি দিয়ে হবে। সম্ভাব্য বিপর্যয় এড়াতে এবং দেশটির অন্যান্য অঞ্চলে এই ভাইরাসের বিস্তার বন্ধ করতে দেশটিতে বড়দিন উজ্জাপনের উপর নিষেধাজ্ঞা সহ আক্রান্ত অঞ্চলে চতুর্থ পর্যায়ের লক-ডাউন ঘোষণা করা হয়েছে।
আর যুক্তরাজ্য থেকে এই মিউট্যান্ট ভাইরাসটি যেন অন্যান্য দেশে ছড়িয়ে না পরতে পারে তার জন্য বিভিন্ন দেশ যুক্তরাজ্যের সাথে সকল বিমান যোগাযোগ বন্ধ করেছে। অবশ্য এর ভেতরই বিমান আরোহীদের মাধ্যমে অস্ট্রেলিয়া এবং ডেনমার্কে ভাইরাসটি ছড়িয়ে পরেছে।
হল্যান্ড এবং দক্ষিণ আফ্রিকাতেও পাওয়া গেছে এই একই ধরনের মিউট্যান্ট করোনাভাইরাস। সন্দেহ করা হচ্ছে এই মিউটেটেড ভাইরাসটি এরই ভেতরে আরো অনেক দেশে ছড়িয়ে পরে থাকতে পারে।
▪️ করোনাভাইরাসের মিউটেশন কী এই প্রথম?
না। করোনাভাইরাস এক ধরনের এমআরএনএ ভাইরাস যা প্রাকৃতিক ভাবেই নিয়মিত মিউটেটেড বা রুপান্তরিত হয়। এখন যে করোনাভাইরাসটি সাড়া পৃথিবীব্যাপী রয়েছে তা চীনের উহানে প্রথম আবির্ভূত হওয়া ভাইরাস থেকে আলাদা। মার্চের পর থেকে যে ভাইরাসটি বিদ্যমান তা একটি মিউটেটেড ভাইরাস যার স্পাইক প্রেটিনে ডি-৬১৪-জি (D614G) মিউটেশন ঘটেছে। এই মিউটেশনের ফলে রুপান্তরিত ভাইরাসটির সংক্রমণ ক্ষমতা মূল ভাইরাস থেকে কিছুটা বেড়েছে বলে ধারনা করা হয়। স্পাইক প্রোটিন হচ্ছে করোনাভাইরাসের খোলকে থাকা কাঁটার মত একটি প্রোটিন যার মাধ্যমেই ভাইরাসটি মানুষের কোষে থাকা এসিই-টু রিসিপ্টরের সাথে বন্ধন সৃস্টির মাধ্যমে সংক্রমণ ঘটায়। মিউটেশনের মাধ্যমে স্পাইক প্রোটিনের গঠনগত পরিবর্তন হলে ভাইরাসটিও তার আচরন পরিবর্তন করতে পারে।
ইউরোপে আরো একটি বিশেষ মিউটেশন ঘটেছিল ভাইরাসটির স্পাইক প্রোটিনে। এই মিউটেশনটি এ-২২২-ভি নামে পরিচিত। ভাইরাসের এই মিউটেশনটি ধরা পরেছিল এই গ্রীষ্মে স্পেনে হলিডে করতে যাওয়া আক্রান্ত মানুষের মধ্যে। এযাবৎ করোনাভাইরাসের স্পাইক প্রোটিনে প্রায় চার হাজার বার মিউটেশন ঘটেছে!
▪️ সাম্প্রতিক ইউকে মিউটেশন এত ভয়ংকর কেন?
সম্প্রতি যুক্তরাজ্যে করোনাভাইরাসের স্পাইক প্রোটিনে ১৭ টি মিউটেশন ঘটেছে, যা পলিজেনিক ক্লাস্টার মিউটেশন হিসেবে এক সাথে বিদ্যমান। অর্থাৎ সবগুলো মিউটেশনই একই ভাইরাসে বিদ্যমান। এবং এই মিউটেশনের কারনে অ্যামাইনো এসিডেও পরিবর্তন ঘটে। আর যেহেতু অ্যামাইনো এসিড দিয়ে প্রোটিন অনু গঠিত, তাই এক সাথে ১৭ টি মিউটেশনের কারনে স্পাইক প্রোটিনের গঠনে বড় ধরনের পরিবর্তন হয়েছে। আর এ কারনেই রুপ পরিবর্তন করেছে ভাইরাসটি। নতুন যে মিউটেশনগুলো ঘটেছে তার ভেতরে প্রধান কয়েকটি নিম্মরূপ:
(১) এন-৫০১-ওয়াই মিউটেশন: এই মিউটেশনটি ঘটেছে স্পাইক প্রোটিনের রিসিপ্টর বাইন্ডিং ডোমেইন বা আরবিডি (RBD) তে। আরবিডি হচ্ছে স্পাইক প্রোটিনের প্রান্তে থাকা একটি ক্ষুদ্র অংশ যার মাধ্যমে ভাইরাসটি কোষে থাকা এসিই-টু রিসিপ্টরের সাথে আটকে যায়। পরীক্ষায় দেখা গেছে যে এন-৫০১-ওয়াই মিউটেশনের কারনে রুপান্তরিত ভাইরাসটির রিসিপ্টরের সাথে বন্ধন সৃস্টি করার প্রবনতা বৃদ্ধি পেয়েছে।
(২) এইচ-৬৯/ভি-৭০ ডিলেশন: এই মিউটেশনের কারনে স্পাইক প্রোটিন থেকে দুইটি অ্যামাইনো এসিড হারিয়ে গেছে বা প্রোটিনটির ক্ষুদ্র একটি অংশ ভেংগে পরেছ। এর ফলে ভাইরাসটি মানবদেহের ইমিউন সিস্টেমকে ফাঁকি দেয়ার ক্ষমতা অর্জন করেছে। আর এভাবেই ভাইরাসটি নির্বিঘ্নে বংশ বিস্তার করতে পারছে এবং একজন থেকে আরেকজনে ছড়াতে পারছে দ্রুত। এধরনের মিউটেশন মিংক নামক পশুর শরীরে ঘটেছে এর আগেও হল্যান্ড এবং ডেনমার্কে।
(৩) পি-৬৮১-এইচ মিউটেশন: এই মিউটেশনটি ঘটেছে স্পাইক প্রোটিনের এস-১ এবং এস-২ সাব-ইউনিটের সংযোগ স্থল ‘ফিউরিন ক্লিভেজ’ সাইটে। স্পাইক প্রোটিনের এই অংশটির উপর ফিউরিন বিক্রিয়া করে স্পাইক প্রোটিনকে সক্রিয় করে। সুতরাং এই ক্লিভেজ সাইটের কোন মিউটেশন বা পরিবর্তন হলে ভাইরাসের সংক্রমণ করার গতি প্রকৃতি পাল্টে যেতে পারে।
উপরোল্লেখিত মিউটেশনগুলোর কারনে ভাইরাস অতি দ্রুত ছড়ালেও কোভিডের সিভিয়ারিটি তেমন একটা বাড়েনি। তবে ইনফেকশন বেশি হলে বেশি মানুষ অসুস্থ হবে। এবং বেশি মানুষ অসুস্থ হলে মোট মৃত্যুও কিছুটা বেড়ে যেতে পারে। সুতরাং এই রুপান্তরিত ভাইরাস থেকে সতর্ক থাকা আরো বেশি জরুরি।
▪️ এই নতুন মিউটেশন কী ভ্যাকসিনের কার্যকারিতায় কোন প্রভাব ফেলবে?
ইউকের করোনাভাইরাস মিউটেশনের কারনে স্পাইক প্রোটিনের ১৭ টি স্থানে পরিবর্তন হয়েছে। এযাবৎ যত ভ্যাকসিন তৈরী করা হয়েছে তার সবকটির টার্গেটই হচ্ছে এই স্পাইক প্রোটিন। সুতরাং এই প্রোটিনের গঠনগত পরিবর্তনে ভ্যাকসিনের কার্যকারীতা কমে যাওয়া অস্বাভাবিক কিছু নয়। তবে এখন পর্যন্ত বিজ্ঞানীদের বিশ্বাস এই বর্তমান মিউটেশন ভ্যাকসিনের কার্যকারিতায় তেমন কোন নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে না। তবে এখনও এর উপরে কোন পরীক্ষালব্ধ উপাত্ত নেই। আরো কিছুদিন গেলে এবং আরো গবেষণা হলে এই প্রশ্নের উত্তর সঠিক ভাবে পাওয়া যাবে।
▪️ এই মিউটেশন কী কোভিড টেস্টে কোন প্রভাব ফেলবে?
উত্তর হচ্ছে, হ্যাঁ ফেলবে। আরটি-পিসিআর কোভিড টেস্টে যদি ভাইরাস ডিটেকশনে শুধুমাত্র এস-জিন (S-gene) টার্গেট করা হয় তাহলে ফলস নেগেটিভ রেজাল্ট আসতে পারে। অবশ্য যে সব কীটে জফজঢ় জিন এবং সাথে ঊ জিন বা ঘ জিন টার্গেট থাকে সেসব কীটের টেস্টে কোন সমস্যা নেই। তবে অবশ্যই যে কীটই ব্যবহার করা হউক না কেন, ৩-মবহব টেস্ট কীট অবশ্যই ব্যবহার করা উচিত।
▪️ এ সময়টাতে বাংলাদেশর করনীয় কী?
এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের করোনা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রনের ভেতরে রয়েছে। তবে বাংলাদেশে ইউকের নতুন মিউট্যান্ট করোনাভাইরাসটি যেন কোন ভাবেই প্রবেশ করতে না পারে সে ব্যবস্থা করতে হবে। ৪০ টি দেশ সোমবারের ভেতরেই যুক্তরাজ্যের সাথে সকল বিমান যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়েছে। এই কাতারে রয়েছে ভারত এবং পাকিস্তানও। বাংলাদেশর উচিত হবে কালবিলম্ব না করে এখনই ইউকে থেকে বাংলাদেশগামী সকল ফ্লাইট বন্ধ করে দেয়া। শুধু তাই নয়। প্রতি ১০০ টা কোভিড টেস্টে অন্তত ৫ টি স্যাম্পলের জিন সিকুয়েন্স করা এখন জরুরি, কারণ যুক্তরাজ্যে নতুন মিউট্যান্ট ভাইরাসটি পাওয়া গেছে সেপ্টেম্বর মাসে। আর এই মিউট্যান্ট ভাইরাসের কেন্দ্রস্থল হল লন্ডন এবং কেন্ট। প্রচুর বাংলাদেশী এই অঞ্চলটিতে বসবাস করেন এবং তারা নিয়মিত দেশে বেড়াতে আসেন। সেপ্টেম্বর থেকে ডিসেম্বর অনেক ব্রিটিশ প্রবাসী বাংলাদেশে এসেছেন। তাদের সাথে এই অনাকাংক্ষিত ভাইরাসটি দেশে চলে এসেছে কিনা তা কিন্তু নিশ্চিত করে বলা যায়না। সুতরাং চোখ কান খোলা রাখতে হবে। বর্তমানের মিউটেটেড ভাইরাসটিকে হাল্কা ভাবে নেয়ার কোন অবকাশ নেই।
লেখক: এমবিবিএস, এমএসসি, পিএইচডি, সিনিয়র রিসার্চ অ্যাসোসিয়েট, শেফিল্ড ইউনিভার্সিটি, যুক্তরাজ্য।