Monday 13th January 2025

টিকা প্রাপ্তিতে সংশয়ের কারণ নেই

Published: 6 January 2021

ডা. মোশতাক হোসেন

করোনাভাইরাসের টিকা বাংলাদেশের পাওয়া নিয়ে গত সোমবার হঠাৎ অনিশ্চয়তার সৃষ্টি হয়। টিকা উৎপাদনকারী ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউট টিকা রপ্তানি করতে পারবে না বলে আন্তর্জাতিক কয়েকটি সংবাদমাধ্যমে খবর প্রকাশের পর বাংলাদেশে এক ধরনের উদ্বেগ ছড়িয়ে পড়ে। ইতোমধ্যে সরকারের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে স্পষ্ট বক্তব্য এসেছে। আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানও জানিয়েছে, চুক্তি অনুযায়ী টিকা সরবরাহ করা হবে। এতে কোনো প্রভাব পড়বে না।
আমরা জানি, করোনার সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় দক্ষিণ এশিয়ায় সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত দেশ ভারত। করোনা মোকাবিলায় ভারতের তুলনায় অনেকাংশে ভালো অবস্থানে রয়েছে বাংলাদেশ। সুতরাং এটা সহজেই অনুমেয় যে, ভারতের নাগরিকরা চাইবে সেখানকার পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের পর অন্য দেশে টিকা রপ্তানি করা হোক। মূলত সংকটটা এ কারণেই সৃষ্টি হয়ে থাকতে পারে। তবে মনে রাখতে হবে, সেরাম ইনস্টিটিউট ভারতের রাষ্ট্রীয় কোনো প্রতিষ্ঠান নয়; এটি একটি আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ওই প্রতিষ্ঠানকে দায়িত্ব দিয়েছে এ অঞ্চলের উন্নয়নশীল দেশগুলোতে স্বল্প খরচে করোনার টিকা সরবরাহ করার। সারাবিশ্বে সেরাম ইনস্টিটিউটের মতো এ রকম আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান আরও ৫-৬টি রয়েছে। তবে সেরাম ইনস্টিটিউট যেহেতু ভারতে অবস্থিত এবং সেখানকার অবস্থা যেহেতু তুলনামূলক উদ্বেগের; কাজেই তারা টিকা সরবরাহের ক্ষেত্রে ভারতকে অগ্রাধিকার দেবে, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু বাংলাদেশের সঙ্গে যেহেতু আগেই চুক্তি হয়েছে, সেহেতু টিকা প্রাপ্তির ক্ষেত্রে সংশয়ের কোনো কারণ নেই। এখন বরং নজর দেওয়া উচিত টিকা সংরক্ষণ ও বিতরণ ব্যবস্থাপনার দিকে।
টিকা আমদানির ক্ষেত্রে ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের সুনির্দিষ্ট নীতিমালা রয়েছে। ন্যাশনাল ভ্যাকসিন ডেভেলপমেন্ট প্ল্যানে উল্লেখ করা হয়েছে- বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও সাতটি উন্নত দেশ তথা ব্রিটেন, ফ্রান্স, জার্মানি, যুক্তরাষ্ট্র, জাপান ও অস্ট্রেলিয়ার মতো কোনো একটি দেশ এবং ইউরোপিয়ান মেডিসিন এজেন্সি- এই তিনটি পক্ষের মধ্যে যে কোনো দুটি পক্ষের অনুমোদনপ্রাপ্ত কোনো প্রতিষ্ঠানের টিকা আমদানির পর ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর নতুন করে আর ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল করবে না। তবে যদি এমন কোনো ভ্যাকসিন আমদানি করা হয় বা দেশীয় কোনো ভ্যাকসিন গ্রহণ করা হয়, যা উপরোক্ত পক্ষগুলোর মধ্যে কমপক্ষে দুটি পক্ষের অনুমোদিত নয়, সে ক্ষেত্রে ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর যথাযথভাবে ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের পরই তা অনুমোদন দেবে।
জানুয়ারির শেষ অথবা ফেব্রুয়ারির শুরুতে সেরামের কাছ থেকে ভ্যাকসিন পাওয়ার কথা বাংলাদেশের। সে লক্ষ্যে ভ্যাকসিন ব্যবস্থাপনার জন্য স্বাস্থ্য বিভাগ ইতোমধ্যে ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। করোনা মহামারির শুরু থেকেই কাজ করে আসা বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষকে নিয়ে গঠিত সমন্বয় কমিটির কাছে দায়িত্ব বণ্টন করা হয়েছে। যারা টিকা পাবে তাদের তালিকা প্রস্তুতকরণ এবং সুষ্ঠুভাবে টিকা প্রদান নিশ্চিত করার পরিকল্পনাও হয়েছে। টিকা প্রদানের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অভিজ্ঞতা রয়েছে। তবে এবারের টিকা প্রদানের পরিধি অনেক ব্যাপক হওয়ায় কিছুটা চ্যালেঞ্জ থাকবে। এ ক্ষেত্রে জনগণের ব্যাপক সমর্থন প্রয়োজন হবে। সর্বসাধারণের সক্রিয় অংশগ্রহণে স্বচ্ছতা ও বৈষম্যহীনভাবে টিকা প্রদান নিশ্চিত করতে হবে। অর্থাৎ যাদের টিকা দরকার তারা যেন টিকা পায়, সে জন্য নাগরিক উদ্যোগ প্রয়োজন। নাগরিক সমাজ সক্রিয় থাকলে টিকার অপচয় হবে না।
টিকা দেওয়ার জন্য স্বাস্থ্য অধিদপ্তর একটি গাইডলাইন তৈরি করেছে। প্রথমে করোনা চিকিৎসায় সরাসরি যুক্ত চিকিৎসক, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীরা টিকা পাবেন। পরে ধাপে ধাপে ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠী টিকার আওতায় আসবে। টিকা বণ্টনের জন্য সারাদেশে তিন স্তরে কমিটি গঠন করা হয়েছে। টিকা পেতে অনলাইনে ভোটার আইডি কার্ড দিয়ে নিবন্ধন করতে হবে। প্রতিষ্ঠানে টিকা বিতরণের জন্য ১৫ ধরনের প্রায় ছয় হাজার ৩০০টি স্থান নির্ধারণ করা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে বিভিন্ন মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল, বিশেষায়িত হাসপাতাল, জেলা সদর হাসপাতাল, উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, সংক্রামক ব্যাধি হাসপাতাল, ইউনিয়ন উপস্বাস্থ্যকেন্দ্র, ১০ ও ২০ শয্যার হাসপাতাল, মা ও শিশু হাসপাতাল, পুলিশ হাসপাতাল, জাতীয় সংসদ স্বাস্থ্যকেন্দ্র, সচিবালয় ক্লিনিক ও সিটি করপোরেশন হাসপাতাল। ১৮ বছরের নিচের জনগোষ্ঠী ও অন্তঃসত্ত্বা নারীদের ওপর করোনার টিকার ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল কোথাও হয়নি। সঙ্গত কারণেই তারা টিকার বাইরে থাকবে। বাংলাদেশে মোট জনগোষ্ঠীর প্রায় ৪০ ভাগের বয়স ১৮ বছরের নিচে। ফলে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মানুষ ঝুঁকিতে থাকবে। তাই যত দ্রুত সম্ভব এই বয়সের মানুষের মধ্যে ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের উদ্যোগ নিতে হবে।

বিগত সময়ে আমরা দেখেছি, মহামারির ব্যাপকতায় দেশের স্বাস্থ্য বিভাগ কিছু বেসরকারি সংস্থাকে করোনা পরীক্ষার অনুমতি দেয়। সেখানে করোনা পরীক্ষার ক্ষেত্রে অনিয়ম-দুর্নীতি হয়েছে। এ বিষয়টি মাথায় রেখে টিকা প্রদান কর্মসূচি পরিচালনা করতে হবে। কোনোভাবে যদি বিষয়টি সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচি বা ইপিআইকে এড়িয়ে অন্য কোনো পক্ষকে প্রদান করা হয়, তাহলে করোনা পরীক্ষাকে কেন্দ্র করে যে ধরনের অপ্রীতিকর পরিস্থিরি সৃষ্টি হয়েছিল, টিকা প্রদানের ক্ষেত্রে তার চেয়েও খারাপ পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে। যেহেতু করোনার টিকা প্রদান করা হবে বৃহৎ পরিসরে, সেহেতু বেসরকারি খাতকে অবশ্যই সম্পৃক্ত করতে হবে। তবে সেটি করতে হবে ইপিআইর নিয়ন্ত্রণে। টিকা প্রদানের প্রথম পর্যায়ে সেটি করা যাবে না। সারাদেশে টিকা প্রদানের একটি কাঠামো দাঁড়িয়ে গেলে স্বচ্ছতার ভিত্তিতে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান অংশগ্রহণ করতে পারে।
ইতোমধ্যে উন্নত কয়েকটি দেশে টিকা প্রদান কার্যক্রম শুরু হয়েছে। সেখানে টিকা গ্রহণ করা না-করা নিয়ে মানুষের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়েছে। এমনকি পশ্চিমা বিশ্বে ভ্যাকসিনবিরোধী এক ধরনের সোচ্চার অবস্থানও গ্রহণ করেছে কিছু মহল। বাংলাদেশসহ এশিয়া ও আফ্রিকার দেশগুলো বিগত সময়ে টিকার মাধ্যমেই গুটিবসন্ত, জলবসন্ত ও পোলিওমুক্ত হয়েছে। কাজেই টিকার উপকারিতা আমরা জানি। এখানকার মানুষ টিকা গ্রহণে উদগ্রীব। আশা করি, এখানে টিকা গ্রহণ করা না-করা নিয়ে কোনো সংশয় তৈরি হবে না। তবে আমাদের দেশে অন্য ধরনের সংকট তৈরির আশঙ্কা রয়েছে। এখানে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে টিকা প্রদান করা চ্যালেঞ্জিং হতে পারে। কিছু মানুষ ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে দুর্নীতির আশ্রয় নিতে পারে। সে বিষয়ে সবাইকে সতর্ক থাকতে হবে।
মনে রাখা দরকার, যতক্ষণ আমরা প্রত্যেক মানুষকে নিরাপদ করতে না পারব, ততক্ষণ পর্যন্ত কেউই নিরাপদ থাকব না। বিশ্ব-বাস্তবতায়ও একই কথা, যতক্ষণ প্রত্যেকটি দেশ নিরাপদ না হবে, ততক্ষণ পর্যন্ত বিশ্ব নিরাপদ হবে না। কারণ মহামারি দেশ-মহাদেশের সীমারেখা মানে না; দেশের ভেতরেও ক্ষমতাবান-ক্ষমতাহীন কিংবা ধনী-গরিবের ভেদাভেদ মানে না। কাজেই সবাই মিলে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত মানুষেরা যেন টিকা থেকে বঞ্চিত না হন এবং টিকাদান কর্মসূচিতে যাতে কোনো অনিয়ম না হয়, সে জন্য সরকারের পাশাপাশি নাগরিক সমাজকেও সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে।
উপদেষ্টা, আইইডিসিআর



x