ভ্যাকসিন ব্যবস্থাপনাটা যেন সুষ্ঠু হয়
।। মুঈদ রহমান ।।
বিশ্বে করোনার আক্রমণ শুরু হওয়ার এক বছর পেরিয়ে গেল। আজতক এর তাণ্ডব থামানো যায়নি। গত ৮ জানুয়ারির পরিসংখ্যান অনুযায়ী, সারা বিশ্বে মোট করোনায় আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ৮ কোটি ৯৩ লাখ ছাড়িয়ে গেছে। এর মধ্যে মারা গেছেন ১৯ লাখেরও বেশি আর সুস্থ হয়েছেন ৬ কোটি ৪০ লাখ মানুষ। সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত ও মৃতের দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।
দেশটিতে ওই তারিখ পর্যন্ত আক্রান্ত হয়েছেন ২ কোটি ২৪ লাখেরও বেশি নাগরিক। মারা গেছেন প্রায় ৩ লাখ ৭৮ হাজার এবং সুস্থ হয়ে উঠেছেন ১ কোটি ৩২ লাখ মানুষ। বাংলাদেশের চিত্র যুক্তরাষ্ট্রের মতো ভয়াবহ না হলেও দুশ্চিন্তার বাইরে নয়। এ সময়ে আমাদের দেশে আক্রান্ত হয়েছেন ৫ লাখ ২০ হাজার ৬৯০ জন, মারা গেছেন ৭ হাজার ৭৩৪ জন এবং সুস্থ হয়েছেন ৪ লাখ ৬৫ হাজার ২৭৯ জন। শত নিরাশার ভেতরেও আশার কথা হলো, গত সপ্তাহজুড়ে পরীক্ষা বিবেচনায় শনাক্তের হার ৭ শতাংশের মতো। সুতরাং সার্বিকভাবেই বলা যায়, করোনার সঙ্গে তাল মিলিয়ে আমাদের জীবন-জীবিকা অব্যাহত রেখেছি বটে; তবে তার ছোবল থেকে আমরা মোটেই নিরাপদ নই। এখনও দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ আছে। একটি কথা পরিষ্কারভাবেই বলা উচিত- আমাদের চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ জনসংখ্যার দেশ যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আক্রান্তের তুলনামূলক চিত্রে স্বস্তি পাওয়ার কিছু নেই। সত্য কথা হলো, আমরা কম হারে হলেও আক্রান্ত হচ্ছি। এই আক্রান্তের আশঙ্কা যতদিন না তিরোহিত হবে, ততদিন আমাদের স্বস্তির কোনো কারণ নেই। আর এই আক্রান্তের আশঙ্কাকে দূর করতে পারে একমাত্র ভ্যাকসিনের সহজলভ্যতা। তাই সারা বিশ্বের প্রায় ৮০০ কোটি মানুষ এখন করোনা ভ্যাকসিনের অপেক্ষায় দিন গুনছে।
২০২০ সালে গোটা বছরজুড়ে গণমাধ্যমগুলো করোনা মোকাবিলায় নানা ধরনের সতর্কতা ও সাবধানতার কথা প্রচার করে এসেছে। কিন্তু গেল সপ্তাহের সংবাদগুলোর মধ্যে কিছুটা হলেও আশার কথা প্রচার করা হয়েছে। করোনার আতঙ্ক আপাতত ভ্যাকসিন পাওয়া, না পাওয়ার আলোচনায় এসে ঠেকেছে। সরকার এ বিষয়ে তৎপর বলেই মনে হচ্ছে। আমাদের জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি (একনেক) এরই মধ্যে ভ্যাকসিন কেনা বাবদ ৫ হাজার ৬৫৯ কোটি ৭ লাখ টাকার অনুমোদন দিয়েছে। এ অর্থের ভেতর কেবল ভ্যাকসিন কেনা বাবদ ব্যয় ধরা হয়েছে ৩ হাজার ৪৩৭ কোটি টাকা। বাকি ২ হাজার ২২২ কোটি টাকা খরচ হবে ভ্যাকসিন সংরক্ষণ, পরিবহণসহ আনুষঙ্গিক কর্মকাণ্ডে। অন্যদিকে, ‘চলমান কোভিড-১৯ ইমারজেন্সি রেসপন্স অ্যান্ড প্যানডেমিক প্রিপার্ডনেস’ শীর্ষক প্রকল্পটির মূল ব্যয় ধরা হয়েছিল ১ হাজার ১২৭ কোটি ৫১ লাখ টাকা। নতুন সিদ্ধান্তে এই ব্যয় বেড়ে দাঁড়ালো ৬ হাজার ৭৮৬ কোটি ৫৮ লাখ টাকা। প্রকল্পটি বাস্তবায়নে বাইরের সহযোগিতা নেওয়া হবে। বিশ্বব্যাংক ও এশিয়ান ইনফ্রাস্ট্রাকচার ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংক দেবে প্রায় ৬ হাজার ১১৪ কোটি টাকা। সব আয়োজনে ধারণা করা হচ্ছে, এ প্রকল্পের আওতায় প্রায় ১৪ কোটি ভ্যাকসিন সংগ্রহ করা সম্ভব হবে।
এতটা স্বস্তির খবরে জল ঢেলে দেয় একটি সংবাদ-ভারত ভ্যাকসিন রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। সংবাদটি আহত হওয়ার মতো। কারণ ভ্যাকসিনের একটি বড় অংশ সেরাম ইনস্টিটিউট অফ ইন্ডিয়া থেকে কেনার কথা। এ নিয়ে বেশ কয়েকদিন পত্রপত্রিকায় সমালোচনার কথা প্রচার হয়েছে। গত ৫ জানুয়ারি জনমনে সৃষ্ট বিভ্রান্তি দূর করতে টুইটারে বার্তা পাঠান সেরাম ইনস্টিটিউটের প্রধান নির্বাহী আদর পুনাওয়ালা। বার্তায় তিনি বলেন, ভারত থেকে যে কোনো দেশে টিকা রপ্তানির অনুমোদন আছে, এ নিয়ে বিভ্রান্তির কিছু নেই। সেই সঙ্গে পরিকল্পনামন্ত্রী এমএ মান্নান এবং স্বাস্থ্য বিভাগের সচিব আব্দুল মান্নান এক প্রেস ব্রিফিংয়ে সময়মতো ভ্যাকসিন পাওয়া যাবে বলে আশাবাদ ব্যাক্ত করেছেন। ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউটের উৎপাদিত ভ্যাকসিন আমাদের দেশে বাজারজাতকরণের ‘এক্সক্লুসিভ ডিস্ট্রিবিউটর’ হলো বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেড। তাদের বক্তব্য হলো, বাংলাদেশের নিয়ন্ত্রক সংস্থা কোভিশিল্ড অনুমোদন দিলে চুক্তি অনুযায়ী আগামী ৩ ফেব্রুয়ারির মধ্যে প্রথম চালানের ৫০ লাখ ডোজ পাঠানোর কথা সেরাম ইনস্টিটিউটের। তবে এখানে একটা কিন্তু থেকে যায়।
সেরাম ইনস্টিটিউট বলছে, তারা ভারতের চাহিদাকেই অগ্রাধিকার ও জোর দেবে। সেক্ষেত্রে অনেকের ধারণা, প্রথম চালান বাংলাদেশে আসতে প্রায় দুই মাস বিলম্ব হতে পারে, এমনকি তা জুন-জুলাই পর্যন্ত গড়াতে পারি। বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে ভ্যাকসিন ক্রয় ও তা বিতরণের ক্ষেত্রে যেসব পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে তাতে আমরা আশাবাদী হতেই পারি। যেমন ভ্যাকসিন আমদানির ক্ষেত্রে বেক্সিমকোকে যে পূর্ব-অনুমোদন বা অনাপত্তিপত্র (এনওসি) দেওয়া হয়েছে তা নিঃশর্ত নয়। অব্যবস্থাপনা রোধে সাতটি শর্ত দেয়া হয়েছে : ১. ভ্যাকসিনটি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ইমার্জেন্সি ইউজ লিস্টিং বা প্রি কোয়ালিফিকেশন অর্জনের পর ব্যবহার করা যাবে; ২. ভ্যাকসিনটির নিবন্ধন পাওয়ার জন্য ওষুধ প্রশাসনে আবেদন করতে হবে। অনুমতি মিললেই তা আমদানি করা যাবে; ৩. ভ্যাকসিনটি কেবল কোভিড-১৯ প্যানডেমিক পরিস্থিতিতেই ব্যবহারযোগ্য; ৪. ভ্যাকসিনটির রিস্ক ম্যানেজমেন্ট প্ল্যান (আরএমপি) দাখিল করতে হবে; ৫. ভ্যাকসিন ব্যবহারের নেতিবাচক প্রভাবও থাকতে পারে। তাই তা ব্যবহারের ফলে উদ্ভূত এডভার্স ইভেন্ট ফলোইং ইম্যুনাইজেশান (এইএফআই) রিপোর্ট প্রথম দুই মাস পর্যন্ত ১৫ দিন পরপর এবং পরবর্তী সময়ে প্রতি মাসে ওষুধ প্রশাসনে জমা দিতে হবে; ৬. ভ্যাকসিনের প্রতিটি ব্যাচের লট রিলিজ ন্যাশনাল কন্ট্রোল ল্যাবরেটরি থেকে গ্রহণ করতে হবে এবং ৭. এই অনাপত্তিপত্রের মেয়াদ ইস্যুর তারিখ থেকে পরবর্তী ৯ মাসের জন্য কার্যকর হবে। সুতরাং সরকারের তরফ থেকে সবদিকেই নজর দেয়া হয়েছে বলে মনে করা যেতে পারে।
কিন্তু কোভিড-১৯ এমনই একটি সমস্যা, যা মোকাবিলা করার বেলায় সরকারের আন্তরিকতার পরও ঝুঁকি থেকে যায়। ভয়াবহতার মাত্রা, আকার, তা প্রতিরোধে প্রক্রিয়া-পদ্ধতি-সব মিলিয়ে এখনই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলার মতো পরিস্থিতি হয়নি। সমস্যাটা বিশ্বের প্রায় ৮০০ কোটি মানুষের। এ চাহিদা একদিনে পূরণ হওয়ার নয়। এখানে দরকষাকষির বিষয়টিকে আমলে নিতে হবে। ভ্যাকসিন প্রস্তুতকারক কোন দেশ কোন দেশকে অগ্রাধিকার দেবে তার রয়েছে একটি রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও কুটনৈতিক সম্পর্কের যোগসূত্র। যদিও বা পাওয়া গেল, তার দাম হবে একটা নিয়ামক। যেমন চুক্তি অনুযায়ী কোভেক্স ভর্তুকির মাধ্যমে ক্রয় করা প্রথম ৩ কোটি ৪৪ লাখ ভ্যাকসিনের ডোজপ্রতি বাংলাদেশে দাম পড়বে ২ ডলার বা ১৯০ টাকা। কিন্তু পরবর্তী ডোজগুলো যেহেতু প্রতিযোগিতামূলক দামে কিনতে হবে তাই ধারণা করা হচ্ছে, সেগুলোর ডোজপ্রতি দাম পড়বে প্রায় ১০ ডলার বা ৮৫০ টাকা। এই ব্যবধানকেও বিবেচনায় নিতে হবে। রপ্তানিকারক থেকে ভ্যাকসিন গ্রহীতার পথটাও সরল-সুগম নয়। বাংলাদেশের কথাই যদি ধরি, আমদানিকৃত ভ্যাকসিনটি প্রথমেই আসবে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে। সেখান থেকে সোজা চলে যাবে ইপিআই সেন্টার স্টোরেজে। স্টোরেজ থেকে যাবে জেলা হেডকোয়ার্টারে। সেখান থেকে যাবে উপজেলায়। এবং শেষ পর্যন্ত যাবে ভ্যাকসিন সেন্টারে, যেখান থেকে ভ্যাকসিনটি চূড়ান্তভাবে প্রয়োগ করা হবে। সুতরাং এ দীর্ঘ প্রক্রিয়ায় ভ্যাকসিনটিকে যথাযথ তাপমাত্রায় সংরক্ষণ করে বিতরণ ও প্রয়োগের কাজটি সহজসাধ্য নয়। তবে তা আবার অসম্ভবও নয়। স্বাস্থ্যকর্মীদের পাশাপাশি এর জন্য চাই অত্যন্ত সুদক্ষ একটি ব্যবস্থাপনা। বিগত দিনের স্বাস্থ্য খাতের বেহাল দশা দেখে অনেকেই এ ব্যাপারে নিরাশ হতে পারেন। তবে এখন আমাদের আশার ওপর ভর করেই বাঁচতে হবে।
যেহেতু স্বল্প মেয়াদে মোট চাহিদার তুলনায় মোট জোগান অপ্রতুল, তাই তার সমাধান করতে হবে অগ্রাধিকার ভিত্তিতেই। এই অগ্রাধিকার নিশ্চিত করতেও সরকারকে অনেকখানি ঘাম ঝরাতে হবে। ইতোমধ্যেই অগ্রাধিকারের একটি খসড়া তৈরি করেছে সরকার। কিন্তু প্রশ্ন হলো, অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত গ্রুপের তুলনায়ও যদি প্রাপ্যতা কম থাকে সেক্ষেত্রে অত্যন্ত সুবিবেচনা ও স্বচ্ছতার প্রয়োজন পড়বে। এটিও কম চ্যালেঞ্জের কথা নয়।
আরেকটি বিষয় সরকারের তরফ থেকে পরিষ্কার করা হয়নি। আমরা এখনো শুধু ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউটের ওপর নির্ভর করছি। কিন্তু এরই মধ্যে আমেরিকার ফাইজার-বায়োএনটেক ও মডার্নার টিকা অনুমোদন পেয়েছে। অপরদিকে রাশিয়া ও চীনের টিকা বেশ কয়েকটি দেশে ব্যবহৃত হচ্ছে। এক হিসাবে দেখা গেছে, সারা বিশ্বে এ পর্যন্ত প্রায় ৩০টি দেশে বিভিন্ন কোম্পানির টিকা দেওয়া হচ্ছে। সব মিলিয়ে আমাদের বিকল্প উৎসের বিষয়টি মাথায় রাখতে পারলে ভালো হতো।
দু’দিন আগে-পরে দেশে করোনা ভ্যাকসিন আসার মতো অবস্থা পরিলক্ষিত হচ্ছে। যেহেতু আমরা প্রস্তুতকারী নই, তাই আমাদের অন্য দেশের ওপরই নির্ভর করতে হবে। সেখানে বিলম্বের ঘটনা অপ্রত্যাশিত নয়। আমরা আশা করছি, ভ্যাকসিনপ্রাপ্তির পর যেন কোনো অরাজকতা না হয়। কারণ বর্তমান দুঃসময়েও এদেশে সাহেদ-সাবরিনাদের তৎপরতা দেখা গিয়েছিল। সেই লজ্জা ও দুঃখজনক ঘটনার যেন পুনরাবৃত্তি না হয়।
ম্ঈুদ রহমান : অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়