সুবর্ণজয়ন্তীতে পেছন ফিরে দেখা

Published: 26 March 2021

।। তোফায়েল আহমেদ।।

এবারের ছাব্বিশে মার্চ স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর পূর্তি তথা সুবর্ণজয়ন্তী। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবর্ষ ও স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উৎসব আমরা একসঙ্গে পালন করছি।

ঐতিহাসিক এই দিনে বঙ্গবন্ধুর কথা শ্রদ্ধাবনত মস্তকে স্মরণ করি। তিনি শুধু বাংলাদেশের নন, বিশ্বের মহান নেতা ছিলেন। তিনি প্রথমে নিজেকে, পরে আওয়ামী লীগকে, তারপর বাঙালি জাতিকে স্বাধীনতার লক্ষ্যে তৈরি করেছেন। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর তিনি উপলব্ধি করেন এ পাকিস্তান বাঙালিদের জন্য হয়নি।

একদিন বাংলার ভাগ্যনিয়ন্তা বাঙালিদেরই হতে হবে। সেই লক্ষ্য সামনে নিয়ে ধীরে ধীরে অগ্রসর হয়ে ১৩টি মূল্যবান বছর কারাগারের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে কাটিয়েছেন। মহান ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে জাতীয় মুক্তিসংগ্রামের একপর্যায়ে স্বাধিকারের দাবিতে তিনি ৬ দফা কর্মসূচি প্রণয়ন করলে তার কণ্ঠ চিরতরে স্তব্ধ করে দেওয়ার লক্ষ্যে ‘রাষ্ট্র বনাম শেখ মুজিব ও অন্যান্য’ অর্থাৎ আগরতলা মামলার আসামি হিসাবে তাকে ফাঁসি দেওয়ার চেষ্টা করে স্বৈরশাসক আইয়ুব খান।

তখন বাংলার জাগ্রত ছাত্রসমাজ ঐক্যবদ্ধ হয়ে দেশব্যাপী গণআন্দোলন গড়ে তুলে সর্বাত্মক গণঅভ্যুত্থান সৃষ্টি করে। আসাদ-মতিউর-মকবুল-রুস্তম-আলমগীর-সার্জেন্ট জহুরুল হক-ড. শামসুজ্জোহাসহ অসংখ্য শহিদের রক্ত ঝরে। অবশেষে ১৯৬৯-এর ২২ ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধু কারামুক্ত হন। ২৩ ফেব্রুয়ারি তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে (সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) ১০ লক্ষাধিক মানুষের উপস্থিতিতে বাঙালি জাতি তাকে কৃতজ্ঞচিত্তে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে ভূষিত করে।

১৯৭১-এর ২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। স্বাধীনতার ঘোষণা নিয়ে দীর্ঘকাল ধরে স্বার্থান্বেষী মহল কুতর্ক জারি রেখেছে। ’৭০-এর নির্বাচনে যদি বঙ্গবন্ধু অংশগ্রহণ না করতেন বা একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পেতেন, তাহলে স্বাধীনতা ঘোষণা করার সুযোগ পেতেন না, অথবা হয়তো পেতেন তবে অনেক পরে। বঙ্গবন্ধুকে অনেকেই বলেছিলেন, ‘এলএফও’র (লিগাল ফ্রেমওয়ার্ক অর্ডার) অধীনে নির্বাচনে গিয়ে কোনো লাভ হবে না।’ তাদের উদ্দেশে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘এলএফও! এই নির্বাচনকে গণভোট হিসাবে আখ্যায়িত করে আমি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করব এবং প্রমাণ করব কে এই দেশের নেতা। আর নির্বাচনের পর আমি এলএফও টুকরো টুকরো করে ছিঁড়ে ফেলবো।’ জেনারেল নিয়াজির জনসংযোগ কর্মকর্তা সিদ্দিক সালিক তার ‘উইটনেস টু সারেন্ডার’ গ্রন্থে লিখেছেন, ‘The Legal Framework Order irked Mujib sorely. He was particularly irritated at Sections 25 and 27 which vested powers of authentication of the future constitution in the President. It implied that Mujib would not be free to implement his six points, even if he obtained majority seats in the National Assembly (Parliament) unless his Constitution Bill received the President’s approval. It is on the issue that Mujib said, I shall tear the LFO in the pieces after the election.’ (পৃষ্ঠা-১৬-১৭)। এলএফও-তে প্রাপ্তবয়স্কদের ভোটাধিকার এবং জনসংখ্যার ভিত্তিতে প্রতিনিধিত্ব মেনে নেওয়া হয়। জাতীয় পরিষদে ৩১৩টি আসনের মধ্যে জনসংখ্যার অনুপাতে আমরা পেলাম ১৬৯টি আসন।

কিন্তু ভবিষ্যতে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েও যাতে বঙ্গবন্ধু ৬ দফা ও ১১ দফার ভিত্তিতে শাসনতন্ত্র প্রণয়ন করতে না পারেন সেজন্য ইয়াহিয়া খান এলএফও-তে বিতর্কিত ২৫ ও ২৭ নং দুটি অনুচ্ছেদ সন্নিবেশিত করেন। এলএফও-তে সন্নিবেশিত দুটি ধারাই ছিল আসন্ন নির্বাচনে বিজয়ী দলকে ঠেকানোর অপচেষ্টা।

কিন্তু বঙ্গবন্ধু সত্যিকার অর্থেই নির্বাচনকে গণভোটে রূপান্তরিত করে বিজয়ী হন। নির্বাচনের পরপরই ১৯৭১-এর ৩ জানুয়ারি তিনি আওয়ামী লীগের নবনির্বাচিত ১৬৭ জন এমএনএ ও ২৮৮ জন এমপিএকে নিয়ে শপথ অনুষ্ঠান করে বলেছিলেন, ‘এই গণভোটের মাধ্যমে ৬ দফা আজ আমার না, আমার দলেরও না, ৬ দফা আজ জনগণের সম্পত্তিতে রূপান্তরিত হয়েছে। যদি কেউ ৬ দফার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করে তবে তাকে জ্যান্ত কবর দেওয়া হবে। এমনকি আমি যদি করি আমাকেও।’ এভাবে তিনি ৬ দফাকে আপসহীন অবস্থায় নিয়ে গিয়েছিলেন।

বঙ্গবন্ধু জানতেন ইয়াহিয়া খান ক্ষমতা হস্তান্তর করবেন না এবং তাকে বিচ্ছিন্নতাবাদী হিসাবে চিহ্নিত করবেন। সে জন্য বঙ্গবন্ধু নিয়মতান্ত্রিকভাবে এগিয়েছেন। এ নির্বাচনে সারা দেশ সফর করে তিনি বাংলার মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করেন। ১ মার্চ যখন ইয়াহিয়া খান জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত করেন, মানুষ রাজপথে নেমে আসে। সাতই মার্চ বঙ্গবন্ধু জীবনের শ্রেষ্ঠ ভাষণের মধ্য দিয়ে বাংলার মানুষকে স্বাধীনতার এক মোহনায় দাঁড় করিয়ে নিরস্ত্র বাঙালি জাতিকে সশস্ত্র বাঙালি জাতিতে রূপান্তরিত করেন। নির্বাচনের পরপরই ১৮ ফেব্রুয়ারি ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে ডেকে চার জাতীয় নেতার সামনে আমাদের চারজনকে- মণি ভাই, সিরাজ ভাই, রাজ্জাক ভাই ও আমাকে-একটি ঠিকানা মুখস্থ করিয়েছিলেন। ভারতে গেলে আমরা কোথায় আশ্রয় পাব, থাকব-সে জন্য আমাদের চার টুকরা কাগজ দিয়ে বলেছিলেন মুখস্থ করো। কাগজে ঠিকানা লেখা ছিল, ‘সানি ভিলা, ২১নং রাজেন্দ্র রোড, নর্দার্ন পার্ক, ভবানীপুর, কলকাতা’। মুক্তিযুদ্ধ শুরুর পর এই ঠিকানায় আমরা আশ্রয়গ্রহণ করি। অর্থাৎ বহু আগে থেকেই বঙ্গবন্ধু দেশ স্বাধীনের পরিকল্পনা করেন। সেই ১৯৬২ সালে তিনি দেশ স্বাধীনের পরিকল্পনা নিয়ে আগরতলা গিয়েছিলেন। আগরতলা মামলা তো মিথ্যা ছিল না। কিন্তু পরিকল্পনা মতো কাজ হয়নি। আগরতলা মামলায় যারা অভিযুক্ত তারা তো আসলেই স্বাধীনতার জন্য একটি সশস্ত্র পরিকল্পনা গ্রহণ করেছিলেন। এটা সত্য। যার জন্য ‘আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা’ বললে যারা অভিযুক্ত তারা অসন্তুষ্ট হন। তারা বলেন, ‘আমরা তো ষড়যন্ত্র করিনি। আমরা তো দেশের স্বাধীনতার জন্যই একটি পরিকল্পনা করেছিলাম।’

বঙ্গবন্ধুর হৃদয়ের মধ্যেই ছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতা। তার বড় প্রমাণ ৬ দফা। তিনি বিচক্ষণ নেতা ছিলেন। ঘূর্ণিঝড়-জলোচ্ছ্বাসের কারণে উপকূলীয় অঞ্চলে নির্বাচন পেছালে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে থাকার সুযোগ পাই। নির্বাচনের দিন বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ছিলাম। সেদিন তাকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, ‘আপনি কয়টি আসন পাবেন?’ বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘আমি অবাক হবো যদি আমি দুটি আসন হারাই।’ বিস্ময়ের ব্যাপার দুটি আসনই আমরা হারিয়েছিলাম। একটিতে নুরুল আমিন, অন্যটিতে রাজা ত্রিদিব রায় জয়ী হন। নির্বাচনের পরই তিনি পূর্ণ স্বাধীনতার পরিকল্পনা করেন। এই পরিকল্পনার ছক এঁকেছিলেন যখন তিনি ’৬৯-এর অক্টোবরে লন্ডন সফরে যান। সেখানে ভারতীয় প্রতিনিধি ফনীন্দ্র নাথ মুখার্জী, তথা পিএন মুখার্জী-যাকে আমরা মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ‘মিস্টার নাথ’ বলে সম্বোধন করতাম-বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে লন্ডনে দেখা করে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পরিকল্পনা বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে ভারত সরকারের ভূমিকা বঙ্গবন্ধুকে অবহিত করেন, যেগুলো পরে বাস্তবায়িত হয়। বঙ্গবন্ধু একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে তবেই স্বাধীনতা ঘোষণা করার রাজনৈতিক বৈধতা অর্জন করেন। সাতই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণেও তিনি বিচক্ষণতার সঙ্গে বক্তব্য পেশ করেছেন। বঙ্গবন্ধু সবসময় চেয়েছেন তিনি আক্রান্ত হবেন, কিন্তু আক্রমণকারী হবেন না। তাই তো ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে যেটা সিদ্দিক সালিক তার বইতে লিখেছেন, “When the first shot had been fired, ‘the voice of Sheikh Mujibur Rahman came faintly through on a wavelength close to that of the official Pakistan Radio. In what must have been, and sounded like, a pre-recorded message, the Sheikh proclaimed East Pakistan to be the ‘People’s Republic of Bangladesh. ‘It said, ‘This may be my last message. From today Bangladesh is independent. I call upon the people of Bangladesh, wherever you are and with whatever you have, to resist the army of occupation to the last. Your fight must go on until the last soldier of the Pakistan occupation army is expelled from the soil of Bangladesh and final victory is achieved.’’ (পৃষ্ঠা-৭৫)।

প্রিয় মাতৃভূমির স্বাধীনতার জন্য এ রকম একটি চূড়ান্ত ঘোষণায় পৌঁছাতে বঙ্গবন্ধুকে দীর্ঘ ২৪টি বছর বাঙালি জাতিকে সুনির্দিষ্ট কর্মসূচির ভিত্তিতে নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনের মধ্য দিয়ে লক্ষ্য স্থির করে, ধাপে ধাপে জাতীয় মুক্তিসংগ্রাম পরিচালনা করে, জনগণের ম্যান্ডেট নিয়ে, শাসকগোষ্ঠীর সব ষড়যন্ত্রের জাল ছিন্ন করে, জেল-জুলুম-হুলিয়া-ফাঁসির মঞ্চকে উপেক্ষা করে মৃত্যুঞ্জয়ী শক্তি নিয়ে প্রস্তুতি গ্রহণ করতে হয়েছে। একদিনে হয়নি। বহু বছর ধরে, অগণিত মানুষের আত্মদানের মধ্য দিয়ে সমগ্র বাঙালি জাতি তাদের প্রিয় নেতা বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণাকে শিরোধার্য জ্ঞান করেছে। বঙ্গবন্ধু ঘোষিত এ ঘোষণাটিই ’৭১-এর এপ্রিলের ১০ তারিখে মুজিবনগরে প্রতিষ্ঠিত ‘বাংলাদেশ গণপরিষদ’ কর্তৃক গৃহীত স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের ৬নং প্যারায় অনুমোদিত হয়ে সাংবিধানিক বৈধতা অর্জন করেছে।

বঙ্গবন্ধুর এ স্বাধীনতার ঘোষণাই ২৬ মার্চ দুপুর দেড়টায় চট্টগ্রাম বেতার থেকে এমএ হান্নানের কণ্ঠে বারবার প্রচারিত হয়। ২৬ মার্চ জিয়াউর রহমানের ঘোষণার কোনো রেকর্ড নেই। এমনকি জিয়াউর রহমানের শাসনামলে ‘প্রামাণ্যকরণ কমিটি’র চেয়ারম্যান মফিজউল্লাহ কবীর ও হাসান হাফিজুর রহমানের সম্পাদনায় ১৫ খণ্ডে প্রকাশিত ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের দলিলপত্র’ সংকলনের ৩নং খণ্ডে আছে, ‘জিয়াউর রহমান মহান নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষে ২৭ মার্চ ঘোষণা দেন।’ কিন্তু ২৬ তারিখ তো যুদ্ধ শুরু হয়েছে। জেনারেল শফিউল্লাহ, খালেদ মোশাররফ, মেজর রফিক ইতোমধ্যে ডিফেক্ট করে যুদ্ধ শুরু করেছেন। সুতরাং ২৬ মার্চ জিয়াউর রহমানের ঘোষণার কথা মোটেও সত্য নয়।

যারা ২৬ মার্চ জিয়ার ঘোষণার কথা বলে, তারা অসত্য কথা বলে, বাস্তবের সঙ্গে যার কোনো মিল নেই। ইয়াহিয়া খান তার ২৬ মার্চের ভাষণে রাজনৈতিক তৎপরতা নিষিদ্ধ করে একজন ব্যক্তির কথা উল্লেখ করে বলেছেন, ‘সপ্তাহখানেক আগেই আমার উচিত ছিল শেখ মুজিবুর রহমান ও তার অনুসারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা … কেননা কয়েকটি শর্ত দিয়ে সে আমাকে ট্র্যাপে ফেলতে চেয়েছিল। দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বকে সে আক্রমণ করেছে-এ অপরাধ বিনা শাস্তিতে যেতে দেওয়া হবে না।’ এবং এই একজন ব্যক্তির বিরুদ্ধেই রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগ এনে সামরিক আদালতে বিচার হয়। সামরিক শাসক কতটা প্রতিহিংসাপরায়ণ ছিল যে, আমার মতো একজন ক্ষুদ্র কর্মীকেও আমার অনুপস্থিতিতে সামরিক আদালতে বিচার করল। ১৯৭১-এর ২০ এপ্রিল সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, আবদুল মান্নান, আবিদুর রহমান ও আমাকে মার্শাল ল’ কোর্টে হাজির হওয়ার নির্দেশ জারি করা হয়। পরে ২৭ এপ্রিল আমাদের অনুপস্থিতিতে ১৪ বছর সশ্রম কারাদণ্ড, অর্ধেক সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হয়। আজকাল বিভিন্নজন বিভিন্নরকম দাবি করে। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ ছাড়া আমরা ছাত্রলীগের কেউ কিছু করতে পারিনি। বঙ্গবন্ধু জাতীয় নেতা হিসাবে যা করতে পারতেন না, আওয়ামী লীগের অগ্রগামী সংগঠন হিসাবে ছাত্রলীগ বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে তা পালন করত। কোনোটাই বঙ্গবন্ধুর অনুমোদন ছাড়া হয়নি।

ফেব্রুয়ারির ২২ তারিখে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান তার মন্ত্রিসভা বাতিল করেন এবং পিণ্ডিতে গভর্নর ও সামরিক প্রশাসকদের নিয়ে এক গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক করেন। ওই বৈঠকে লারকানা ও রাওয়ালপিণ্ডি বৈঠকে গৃহীত গণহত্যার নীলনকশা ‘অপারেশন সার্চলাইট’ বাস্তবায়নের ব্যবস্থাদি চূড়ান্ত করা হয়।

এসবের পরিপ্রেক্ষিতে ২৪ ফেব্রুয়ারি এক জনাকীর্ণ সংবাদ সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘…গত সপ্তাহে জাতি যে ধরনের নাট্যাভিনয় প্রত্যক্ষ করেছে, তা বন্ধ হওয়া দরকার। জনসাধারণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের শাসনতন্ত্র প্রণয়ন ও তাদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর বানচালের উদ্দেশ্যে ইচ্ছাকৃতভাবে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করা হচ্ছে।… পাকিস্তানে যখনই জনসাধারণ গণতান্ত্রিক পন্থায় ক্ষমতা গ্রহণে উদ্যত হয়েছে তখনই এই তামস শক্তি সক্রিয় হয়ে ওঠে। এই গণবিরোধী শক্তি ১৯৫৪ সালে পূর্ববাংলার নির্বাচিত শক্তিকে ক্ষমতাচ্যুত করে, ১৯৬৬ সালের আইন পরিষদ ভেঙে দেয়, ১৯৫৮ সালে দেশে সামরিক আইন জারি করে এবং তারপর প্রতিটি গণআন্দোলন ব্যর্থ করার জন্য হস্তক্ষেপ করে। এই ষড়যন্ত্রকারী শক্তি যে আবার আঘাত হানার জন্য তৈরি হচ্ছে, জাতীয় পরিষদের তারিখ ঘোষণার পর যেসব ঘটনা ঘটছে সেগুলো থেকেই এটা প্রতীয়মান হয়।

জনাব জেড এ ভুট্টো ও পিপল্স পার্টি আকস্মিকভাবে এমন সব ভঙ্গিমা ও উক্তি করতে শুরু করেছে যা জাতীয় পরিষদের স্বাভাবিক কাজে বাধা সৃষ্টি করে শাসনতান্ত্রিক পদ্ধতি বানচালের প্রবণতাই উদঘাটন করে। এভাবে জনসাধারণের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর বানচালেরও চেষ্টা করা হচ্ছে।

… বাংলাদেশের জাগ্রত জনতাকে, কৃষক-শ্রমিক-ছাত্র ও জনগণকে বিজয় বানচালের ষড়যন্ত্র প্রতিরোধ করার জন্য প্রস্তুত হতে হবে।… আমরা যে ক্ষমতাকে স্বীকার করি, তা হচ্ছে জনগণের ক্ষমতা। জনগণ সব স্বৈরাচারীকেই নতি স্বীকারে বাধ্য করেছে। কারণ স্বৈরাচারীর ক্ষমতার দম্ভ জাগ্রত জনগণের সংকল্পবদ্ধ আঘাতের কাছে টিকে থাকতে পারেনি।… আমরা আজ প্রয়োজন হলে আমাদের জীবন বিসর্জন করারও প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি, যাতে আমাদের ভবিষ্যৎ বংশধরদের একটি কলোনিতে বাস করতে না হয়। যাতে তারা একটি স্বাধীন দেশের নাগরিক হিসেবে সম্মানের সঙ্গে মুক্ত জীবনযাপন করতে পারে, সে প্রচেষ্টাই আমরা চালাব।’ এই দীর্ঘ ও তাৎপর্যপূর্ণ বিবৃতিতে বঙ্গবন্ধু ভবিষ্যৎ বংশধরদের যাতে একটি উপনিবেশে বসবাস করতে না হয় তার অংশ হিসাবে ‘স্বাধীন দেশের’ কথা বলছেন।

’৭১-এর মার্চের ১ তারিখে দুপুর ১টা ৫ মিনিটে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান বেতার ভাষণে ৩ মার্চ ঢাকায় আহূত জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত ঘোষণা করেন। পূর্ব প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করা বক্তব্যে ক্ষোভ-বিক্ষোভে উত্তাল হয়ে ওঠে ঢাকা নগরী। এদিন হোটেল পূর্বাণীতে আওয়ামী লীগ পার্লামেন্টারি পার্টির সভায় ৬ দফাভিত্তিক শাসনতন্ত্রের খসড়া প্রণয়নের কাজ চলছিল।

অধিবেশন স্থগিত ঘোষণায় বিক্ষুব্ধ মানুষ হোটেল পূর্বাণীর সামনে এসে সমবেত হয় এবং স্লোগানে স্লোগানে চারদিক প্রকম্পিত করে তোলে। বঙ্গবন্ধু হোটেলের সামনে এসে সবাইকে শান্তিপূর্ণভাবে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার আহ্বান জানান। তিনি বলেন, ‘অধিবেশন বন্ধ করার ঘোষণায় সারা দেশের জনগণ ক্ষুব্ধ। আমি মর্মাহত। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া তার ওয়াদা ভঙ্গ করেছেন। আমি সংগ্রাম করে এ পর্যন্ত এসেছি। সংগ্রাম করেই মুক্তি আনব। আপনারা ঐক্যবদ্ধ থাকুন।’ এরপর আসে বাঙালির ইতিহাসের পরমাকাঙ্ক্ষিত দিন সাতই মার্চ। সেদিন ছিল রোববার।

সংগ্রামী বাংলা সেদিন অগ্নিগর্ভ, দুর্বিনীত। বঙ্গবন্ধু যখন ‘ভাইয়েরা আমার’ বলে বক্তৃতা শুরু করেন, জনসমুদ্র পিনপতন নিস্তব্ধতার মধ্যে ডুবে যায়। সেদিন নেতার বক্তৃতার শেষাংশ ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’ বস্তুত ছিল বীর বাঙালির জন্য স্বাধীনতার ঘোষণা।

আজ সেই ঐতিহাসিক ভাষণ জাতিসংঘের ইউনেস্কো ঘোষিত ‘বিশ্ব ঐতিহ্যের প্রামাণ্য দলিল’ হিসাবে বিশ্বসভায় স্বীকৃত। দেশকে স্বাধীন করে জাতির পিতা তার জীবনের প্রথম লক্ষ্য পূরণ করেছেন। কিন্তু তার দ্বিতীয় লক্ষ্য বাংলাদেশের অর্থনৈতিক মুক্তি অর্জন, যা তিনি সমাপ্ত করে যেতে পারেননি। সেই লক্ষ্য পূরণে বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ আজ বিশ্বে উন্নয়নের রোল মডেলে পরিণত হয়েছে। যে বাংলাদেশকে একদিন হেনরি কিসিঞ্জারসহ পৃথিবীর অনেকেই হাস্যাস্পদ মন্তব্য করে বলেছিল, ‘বাংলাদেশ হবে তলাবিহীন ঝুড়ি, বাংলাদেশ হবে দরিদ্র দেশের মডেল।’ আজ তাদের বক্তব্য ভুল প্রমাণিত হয়েছে।

বাংলাদেশ ’৭৫-এ ছিল স্বল্পোন্নত আর আজ আমরা উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হয়েছি। জাতির পিতার জন্মশতবর্ষ ও স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর আনন্দঘন ক্ষণে সর্বান্তকরণে কামনা করি, জাতির পিতার আরাধ্য স্বপ্নের বাংলাদেশকে ক্ষুধামুক্ত-দারিদ্র্যমুক্ত সোনার বাংলায় রূপান্তরিত করতে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সমগ্র জাতি ঐক্যবদ্ধভাবে স্বপ্ন পূরণের পথে এগিয়ে যাওয়ার মহতী যাত্রা অব্যাহত রাখবে।

তোফায়েল আহমেদ : আওয়ামী লীগ নেতা; সংসদ সদস্য; সভাপতি, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি