ভারতে রাফির ৫০০ নারী পাচার!

Published: 2 June 2021

বিশেষ সংবাদদাতা, ঢাকা :


ত্রিশ বছর বয়সী আশরাফুল ইসলাম রাফি ওরফে বস রাফি। মাত্র অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করেছে। ৮ বছর আগে পাড়ি জমিয়েছিল ভারতের বেঙ্গালুরুতে। সেখানে গিয়েই আয়ত্ত করে নেয় তামিল ভাষা। গাড়ি চালানোর সুবাদে শহরের আনাচে-কানাচে তার চেনা জানা হয়। একসময় কাজ নেয় বেঙ্গালুরুর একটি রিসোর্টে। সেখানে থাকাকালীন সময়ে বেঙ্গালুরুর অনেক পতিতালয়ের দালালের সঙ্গে তার পরিচয় হয়। তারপর থেকে সে নিজেও জড়িয়ে পড়ে দালালিতে।
একপর্যায়ে দেশে তার ঘনিষ্ঠদের সঙ্গে শুরু করে নারী পাচার। মডেলিংয়ে সুযোগ, ভালো চাকরি দেয়ার প্রলোভন দেখিয়ে দেশের নিম্ন্ন মধ্যবিত্ত থেকে শুরু করে মধ্যবিত্ত ঘরের তরুণীদের টার্গেট করে পাচার করতো ভারতে। আবার ভারত থেকে কিছু কিছু তরুণীকে পাচার করতো দুবাইসহ আরো কিছু পর্যটন ভিত্তিক দেশে। এভাবে মাত্র আট বছরেই আন্তর্জাতিক পাচার চক্রে নাম লেখায় বস রাফি। এই সময়ে রাফি প্রায় পাঁচ শতাধিক তরুণীকে পাচার করেছে। সম্প্রতি রাফি ও তার সহযোগীরা র‌্যাব’র কাছে গ্রেপ্তারের পর চাঞ্চল্যকর নানা তথ্য বের হয়ে আসছে।
র‌্যাব জানায়, সামপ্রতিক সময়ে ভারতের কর্ণাটক রাজ্যের রাজধানী বেঙ্গালুরুতে বাংলাদেশের এক তরুণীকে বিবস্ত্র করে পৈশাচিক কায়দায় নির্যাতনের একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। এ ঘটনার প্রেক্ষিতে ভারতের বেঙ্গালুরু পুলিশ রিফাজুল ইসলাম বাবু ওরফে টিকটক হৃদয় বাবু, সাগর, মোহাম্মদ বাবা শেখ, হাকিল ও দুই নারীসহ মোট ৬ জনকে গ্রেপ্তার করে। এ ঘটনায় ২৭শে মে রাতে তরুণীর বাবা হাতিরঝিল থানায় মানবপাচার আইন ও পর্নোগ্রাফি অ্যাক্টে একটি মামলা করেন। ওই মামলায় টিকটিক বাবুসহ আরো চারজনকে আসামি করা হয়। এ ঘটনার সূত্র ধরেই আশরাফুল মণ্ডল ওরফে বস রাফি ও তার সহযোগী ম্যাডাম সাহিদা (৪৬), মো. ইসমাইল সরদার (৩৮) ও মো. আব্দুর রহমান শেখকে (২৬) গ্রেপ্তার করা হয়েছে। সোমবার ঝিনাইদহ সদর, যশোরের অভয়নগর, ও বেনাপোল হতে তাদেরকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
র‌্যাব জানায়, চক্রটি বিভিন্ন প্রতারণামূলক ফাঁদে ফেলে এবং প্রলোভন দেখিয়ে নারী ও তরুণীদের পার্শ্বর্তী দেশে পাচার করতো দেশি-বিদেশিসহ প্রায় ৫০ জন এই চক্রের সঙ্গে জড়িত রয়েছে। চক্রের মূলহোতা বস রাফি এবং গ্রেপ্তারকৃত অন্যান্য সদস্যরা তার ঘনিষ্ঠ সহযোগী। এছাড়া ভারতে গ্রেপ্তার টিকটক হৃদয় তার অন্যতম সরবরাহকারী বা এজেন্ট। এছাড়া তার আরো এজেন্ট বা সরবরাহকারী রয়েছে। টিকটক হৃদয় অনলাইনে টিকটক ও বিভিন্ন সোস্যাল মিডিয়া গ্রুপের তরুণীদের টিকটক মডেল বানানো ও অন্যান্য প্রলোভন দেখিয়ে উচ্ছৃঙ্খল জীবনে আকৃষ্ট ও অভ্যস্ত করাতো। পরবর্তীতে তাদেরকে পার্শ্ববর্তী দেশ বা উন্নত দেশের বিভিন্ন মার্কেট, সুপারশপ, বিউটি পার্লারসহ বিভিন্ন ধরণের ভালো বেতনের চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে যৌনবৃত্তিতে নিয়োজিত করার উদ্দেশ্যেই ভারতে পাচার করতো। সেখানে পাচারের পর তাদেরকে বিভিন্ন নেশা জাতীয় ও মাদকদ্রব্য সেবন করিয়ে জোরপূর্বক অশালীন ভিডিও ধারণ করে ব্ল্যাকমেইল করতো যাতে পতিতাবৃত্তিতে বাধ্য হয়।
র‌্যাব জানায়, তরুণীদের বৈধ বা অবৈধ উভয় পথেই সীমান্ত অতিক্রম করানো হতো। তারা কয়েকটি ধাপে পাচারের কাজটি করতো। প্রথমত: ভুক্তভোগীদের তারা দেশের বিভিন্ন স্থান হতে সীমান্তবর্তী জেলা যেমন, যশোর, সাতক্ষীরা, ঝিনাইদহ নিয়ে আসতো। তারপর তাদরেকে সীমান্তবর্তী বিভিন্ন সেফ হাউজে নিয়ে যেত। সেখান থেকে সুবিধাজনক সময়ে লাইন ম্যানের মাধ্যমে অরক্ষিত এলাকা দিয়ে সীমান্ত অতিক্রম করাতো। পরে পাশ্ববর্তী দেশের এজেন্টরা তাদেরকে রিসিভ করে সীমান্ত নিকটবর্তী সেফ হাউজে রাখতো। সুবিধাজনক সময়ে কলকাতার সেফ হাউজে পাঠাতো। সুবিধামতো সময়ে কলকাতা থেকে বেঙ্গালুরু পাঠাতো। বেঙ্গালুরু পৌঁছানোর পর রাফি তাদের রিসিভ করে বিভিন্ন সেফ হাউজে নিয়ে যেতো। পরে ব্ল্যাকমেইল ও মাদকাসক্তে অভ্যস্ত করে অমানবিক নির্যাতন করতো। বাংলাদেশ থেকে ভারতে পাচার করার সময় বিভিন্ন সেফ হাউজগুলোতে তাদের জোরপূর্বক মাদক সেবন এবং পতিতাবৃত্তিতে বাধ্য করা হতো। সেফ হাউজগুলো হতে তাদের ১০/১৫ দিনের জন্য বিভিন্ন খদ্দেরের কাছে সরবরাহ করা হতো। এক্ষেত্রে পরিবহন ও খদ্দেরের নির্ধারিত স্থানে অবস্থানের জন্য বিশেষ নিরাপত্তা নেয়া হতো।
র‌্যাব জানায়, সমপ্রতি ভাইরাল হওয়া ভিডিও’র ভুক্তভোগীকে পাচারের উদ্দেশে টিকটক হৃদয় প্রলুব্ধ করে। পরে রাফি তাকে গত বছরের অক্টোবরে পাচার করে বেঙ্গালুরু নিয়ে সবুজের বাড়ির সেফ হাউসে অবস্থান করায় যেখানে ভিডিওটি ধারণ করে। বেঙ্গালুরুর বস রাফির বেশ কয়েকটি সেফ হাউস রয়েছে। এছাড়া বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী জেলাসমূহে তার সেফ হাউস রয়েছে। রাফির অন্যতম নারী সহযোগী ম্যাডাম সাহিদা। তার তিনটি বিয়ে হয়েছে। সে এবং তার দুই মেয়ে সোনিয়া ও তানিয়া পাচার চক্রের সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও সক্রিয়ভাবে জড়িত। সোনিয়া ও তানিয়া বর্তমানে বেঙ্গালুরুতে অবস্থান করছে। ভাইরাল ভিডিওতে তানিয়াকে সহযোগী হিসেবে দেখা গিয়েছে। সাহিদা দেশে একাধিক সেফ হাউস পরিচালনা করছে। সাহিদা দীর্ঘ ১০ বছর ধরে এই পেশায় জড়িত। এছাড়া গ্রেপ্তার ইসমাইল ও আরমান শেখ মূলহোতা বস রাফির বিশেষ সহযোগী হিসেবে পাচার তদারকি করে থাকে। তারাও নারী পাচারের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত।