সামাজিক সম্প্রীতি ও ইসলাম

Published: 14 June 2021

।। জাফর আহমাদ ।।

’’ঈমানদার পুরুষ এবং ঈমানদার স্ত্রীলোকেরাই প্রকৃতপক্ষে পরস্পর পরস্পরের দায়িত্বশীল বা সাহায্যকারী বন্ধু। এদের পরিচয় এবং বৈশিষ্ট্য এই যে, এরা নেক কাজের আদেশ দেয়, অন্যায় কাজ থেকে বিরত রাখে, নামায কায়েম করে এবং যাকাত আদায় করে, আল্লাহ ও রাসুলের বিধান মেনে চলে। প্রকৃতপক্ষে এদের প্রতিই আল্লাহ রহমত বর্ষণ করেন।” (সুরা-তাওবা-৭১)

আরবী ‘জার’ শব্দের অর্থ প্রতিবেশী। বাঁশঝাড়ের ‘ঝাড়’ শব্দটি আরবী জার শব্দের ভাবার্থের দিক থেকে সমার্থক। কারণ বাংলা অভিধানে ‘ঝাড়’ শব্দের অর্থ করা হয়েছে ঘন বৃক্ষাবলী। যেহেতু বাঁশগুলো পাশাপাশি অবস্থান করে তাই একে বাঁশঝাড় বলা হয়। বাঁশগুলো মিলেমিশে পাশাপাশি বসবাস করার দরুন ঝাড়ের মাধ্যমে বিভিন্ন ঝড়-তুফানকে মোকাবেলা করে টিকে থাকতে পারে। অন্যথায় একাকি একটি বাঁশ ফাঁকা জায়গায় সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা সম্ভব হতো না। মানুষও নিজেদের অস্তিত্বের প্রয়োজনে সমাজবদ্ধ হয়ে বসবাস করে। প্রতিবেশীদের সহযোগীতা ছাড়া কোন মানুষই সমাজে বেশীদিন টিকে থাকতে পারে না। এ জন্য কুরআন ও হাদীসে প্রতিবেশীদের মধ্যে সম্প্রীতি, সহ-অবস্থান, ভ্রাতৃত্ববোধ, সমাজবদ্বতা বা দলীয় জীবন ও ঐক্যের জন্য অত্যধিক গুরুত্ব প্রদান করেছে। যেমন আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ “নিকট আত্মীয় ও এতিম-মিসকিনদের সাথে সদ্ব্যবহার করো। আত্মীয় প্রতিবেশী, অনাত্মীয় প্রতিবেশী, সঙ্গী-সাথী, মুসাফির এবং তোমাদের মালিকানাধীন দাস-দাসীদের প্রতি সদয় ব্যবহার করো।(নিসা ঃ ৩৬)

রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বহুবার প্রতিবেশীদের সাথে সৌজন্য প্রদর্শনের ওপর তাগিদ প্রদান করেছেন। তিনি বলেন,“আল্লাহ তা’আলা প্রতিবেশীদের প্রতি দায়িত্ব সম্পর্কে এত বেশী গুরুত্ব দিয়েছেন যে, মাঝে মধ্যে আমার মনে হয়েছে প্রতিবেশীদের হয়তঃ উত্তরাধিকারীর মর্যাদা দেয়া হতে পারে।” রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সামাজিক সম্প্রীতি ও সহাবস্থানকে ঈমানের সাথেও জুড়ে দিয়েছেন। তিনি বলেছেন “সে মু’মিন নয় যে পেটপুরে খেলো, অথচ তার প্রতিবেশী না খেয়ে রইল।” হযরত আবু হোরায়রা রাঃ হতে বর্ণিত, একদা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, আমি আল্লাহর কসম করে বলছি, সে লোকটি ঈমানদার নয়, আমি আল্লাহর কসম করে বলছি, সে লোকটি ঈমানদার নয়, আমি আল্লাহর কসম করে বলছি, সে লোকটি ঈমানদার নয়, সাহাবীদের মধ্য হতে একজন জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহর রাসুল! লোকটি কে? হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, যার অনিষ্ট হতে তার প্রতিবেশী নিরাপদ থাকে না। (বুখারী-মুসলিম) উম্মুল মুমেনীন হযরত আয়েশা রাঃ হতে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন জিব্রাইল আঃ নিয়মিতই আমাকে প্রতিবেশীর হক সম্পর্কে তাকীদ দিচ্ছিলেন। এমন কি আমার ধারণা জন্মেছিল প্রতিবেশীকে সম্পত্তির হকদার বা উত্তরাধিকার করা হবে। (বুখারী-মুসলিম)

ইসলামই একমাত্র পারস্পরিক সাম্য-সংহতি,মানবিক প্রেম-প্রীতি,ভ্রাতৃত্বপূর্ণ ও সহানুভুতিশীল সমাজ উপহার দিয়েছে। ইসলামী সমাজ ব্যবস্থার অধিবাসীরাই সামাজিক সম্প্রীতি ও সহাবস্থানের এমন অনন্য নজীর স্থাপন করেছে যা পৃথিবীর অন্য কোন ব্যবস্থায় পরিলক্ষিত হয় না। সামাজিক ভ্রাতৃত্ববোধ এমন একটি বিষয় যার ওপর ইসলামের সামগ্রীক ব্যবস্থাপনা বা সামাজিক কাঠামো অনেকাংশে নির্ভরশীল। এটি ছাড়া সহ-অবস্থানের চিন্তাই করা যায় না। চাই তা ছোট পরিবারিক পর্যায়ে হউক বা আন্তর্র্জাতিক পরিমণ্ডলেই হোক।

সামাজিক ভ্রাতৃত্ববোধ ও পারস্পকি সৌহার্দপূর্ণ আচরণ ইসলামের অপরিহার্য দাবী। ইসলামের সামগ্রীক জীবন দর্শনের দিকে গভীর দৃষ্টিনিবেশ করলে দেখা যাবে যে, ইসলামের মৌলিক বিষয় তথা তাওহীদ, রেসালাত, নামায, যাকাত, রোযা ও হজ্বসহ অন্যান্য কর্মকাণ্ডগুলোও মানুষের মধ্যে পারস্পরিক ভ্রাতৃত্ববোধ জাগ্রত করার জন্যই নিরন্তর কাজ করে যায়। কারো সাথে সাক্ষাত হলেই সামাজিক সম্প্রীতি ও সহ-অবস্থানের প্রাথমিক যে শিক্ষা ইসলাম পেশ করেছে তা হলো ‘আসসালামু আলাইকুম’ তোমার ওপর শান্তি বর্ষিত হউক।’ এর মাধ্যমে ব্যক্তি ব্যক্তিকে এ জানান দিল যে, প্রকৃতপক্ষেই আমি তোমার একজন কল্যাণকামী। সম্প্রীতি ও সহ অবস্থানের উত্তম এক পরিবেশ চালু করার জন্য এর চেয়ে উত্তম পদ্বতি অন্য কোন ব্যবস্থায় নাই। তদপুরি আমরা লক্ষ করবো ইসলামের বিশ্বাস ও কর্ম কিভাবে সম্প্রীতি ও সহ-অবস্থানের শিক্ষা দিয়ে থাকে। যেমন:-

‘তাওহীদ’ তথা এক আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস থেকে ভ্রার্তৃত্বের মূল্যবোধ উদ্ভূত। প্রত্যেকেই এক আল্ল¬াহ ও রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এ বিশ্বাসী এবং প্রত্যেকেই এক আদমের আঃ বংশদ্ভূত, কাজেই ভ্রার্তৃত্ব, পারস্পরিক নির্ভরশীলতা ও সৌহার্দ ঈমানেরই অংগ। ঈমানের এই ঐক্য মানুষের সহবস্থানের মানসিকতাকে সুসংহত করে।

‘নামায, প্রতিদিন নামায ধনী-দরিদ্র, রাজা-ফকির সকলকে একই কাতারে একাকার করে মানুষে মানুষে ভেদাভেদকে নিচ্ছিন্ন করে দিচ্ছে। সকলেই এখানে একই রাজাধিরাজের কাছে ভিক্ষার হাতকে প্রসারিত করে থাকে। যে রাজাধিরাজ কোন ব্যক্তির প্রভাব প্রতিপত্তি, বিশেষ মর্যাদা ও উচুঁ নীচুর শ্রেনী বিন্যাশ করেন না। এবং তাঁকেও কোন ব্যক্তি কখনো তার বিশেষ মর্যাদার প্রভাবে প্রভাবিত করতে পারেন না। এভাবে ভ্রাতৃত্বের বন্ধন সৃষ্টির জন্য নামাযই এক উপযুক্ত হাতিয়ার হিসাবে কাজ করে । ভ্রাতৃত্বের এ প্রবল টানে ইসলামী সমাজ ব্যবস্থায় সামাজিক সহ-অবস্থানের পরিবেশ সৃষ্টি হবে।

‘যাকাত’ সমাজে বিরাজমান ব্যাপক পার্থক্য হ্রাসের একটি কার্যকরী প্রতিষ্ঠান। সমাজের অধিবাসীরা একাধারে নৈতিক,কল্যাণকামী এবং সামাজিক ও অর্থনৈতিক দায়িত্বজ্ঞান সম্পন্ন পরস্পরের বন্ধু। যেমন:-আল কুরআনের ঘোষনা ”ঈমানদার পুরুষ এবং ঈমানদার স্ত্রীলোকেরাই প্রকৃতপক্ষে পরস্পর পরস্পরের দায়িত্বশীল বা সাহায্যকারী বন্ধু। এদের পরিচয় এবং বৈশিষ্ট্য এই যে,এরা নেক কাজের আদেশ দেয়, অন্যায় কাজ থেকে বিরত রাখে, নামায কায়েম করে এবং যাকাত আদায় করে, আল্ল¬াহ ও রাসুলের বিধান মেনে চলে। প্রকৃতপক্ষে এদের প্রতিই আল্লাহ রহমত বর্ষণ করেন।” (সুরা-তাওবা-৭১)
‘সওম’ রোযা তাকওয়া ভিত্তিক সমাজ গঠন করে সামাজিক বন্ধনকে সুদৃঢ় করে। হযরত ইবনে আব্বাস রাঃ রমযানে অন্যান্য সময় অপেক্ষা অধিক দয়ালু ও সহানুভূতিশীল হতেন। এ সময় কোন প্রার্থী তার দুয়ার হতে বঞ্চিত হতে পারত না।

‘হজ্জ’ বিশ্বজনিন ভ্রার্তৃত্ব সৃষ্টির এক বিশেষ ট্রেনিং এ হজ্জ। কালো-ধলা, বর্ণ-বৈষম্যহীন এক বিশ্ব গঠনের লক্ষ্যে সকল্ইে একই পোষাকে মাত্র দু-টুকরো কাপড় পরিধান করে দীন-ভিক্ষুকের ন্যায় আল্ল¬াহর দরবারে হাজির হতে হয়। এখানেও কোন ব্যক্তি বা দেশের বিশেষ মর্যাদা ও উচুঁ নীচুর শ্রেনী বিন্যাশ করা হয় না। এবং তাঁকেও কোন পরাশক্তি প্রতিপত্তির প্রভাবে প্রভাবিত করতে পারে না। মানবতার বন্ধু রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জীবনের শেষ হজ্জ অনুষ্ঠানে সোনার বাণী শুনিয়েছিলেন যে, “তোমরা সবাই ভাই এবং প্রত্যেকে সমান। তোমাদের কেউ অন্যের উপর বেশী সুবিধা বা মর্যাদা দাবী করতে পারবে না। একজন আরব অনারব থেকে বেশী মর্যাদাশীল নয় এবং একজন অনারবও আরববাসী থেকে অধিক মর্যাশীল নয়।” এভাবে হ্জ্জ ভ্রাতৃত্বের বন্ধন সৃষ্টি করে থাকে। ফলে আন্তর্র্জাতিক সহাবস্থানের পরিবেশ সৃষ্টি হয়।

একটি সুস্থ সমাজের মেীলিক বৈশিষ্ট্য হলো ভ্রার্তৃত্ববোধ। এটি ছাড়া কখনো একটি সুস্থ্য-সুশীল সমাজ গঠিত হতে পারেনা। আর ইসলামই একমাত্র এ ভ্রার্তৃত্ব সৃষ্টির লক্ষ্যে যতোপুযুক্ত কর্মসুচী দিয়েছে। মুসলমান এমনই উদার হৃদয়, সহানুভূতিশীল ও মানব-দরদী হবে যে হৃদয়ের ঐকান্তিক ইচ্ছায় মানুষ সমাজ কল্যাণে সহায়ক শক্তি হিসাবে কাজ করবে।

আল্ল¬াহ রাব্বুল আলামীন বলেন“ তোমরা সবাই মিলে আল্ল¬াহর রজ্জু মজবুতভাবে আঁকরে ধরো এবং দলাদলি করো না। আল্ল¬াহ তোমাদের প্রতি যে অনুগ্রহ করেছেন সে কথা স্মরণ রেখো। তোমরা ছিলে পরস্পরে শুত্রু। তিনি তোমাদের হৃদয়গুলো জুড়ে দিয়েছেন। ফলে তার অনুগ্রহ ও মেহেরবানীতে তোমরা ভাই ভাই হয়ে গেছো।(তোমাদের অবস্থা এমনটি হয়েছিল যে,) তোমরা একটি অগ্নীকুন্ডের কিনারে দাঁড়িয়ে ছিলে। আল্ল¬াহ সেখান থেকে তোমাদের বাঁচিয়েছেন। এ ভাবে আল্ল¬াহ তাঁর নিদর্শনসমুহ তোমাদের সামনে সুষ্পষ্ট করে তুলেন। হয়ত এ নিদর্শনগুলোর মাধ্যমে তোমরা নিজেদের কল্যাণের সোজা পথ দেখতে পাবে।”(সুরা আলে ইমরান ঃ ১০৩)

ইসলামের আগমনের পুর্বে আরব অধিবাসীরা যে সব ভয়াবহ অবস্থার সম্মুখীন হয়েছিল, সে দিকে দৃষ্টিপাত করলে একটি বিশৃংখল পরিবেশের চিত্র আমাদের সামনে ভেসে উঠে। সামাজিক বন্ধন বলতে যা তার কিছুই সেখানে ছিলনা। পারস্পরিক শত্রুতা, কথায় কথায় ঝগড়া বিবাদ এবং রাতদিন মারামারি, কাটাকাটি, হানাহানি ও যুদ্ধ-বিগ্রহের কারনে সমগ্র জাতি ধ্বংসের কবলে নিক্ষিপ্ত হয়েছিল। এই আগুনে পুড়ে ভস্মীভূত হওয়া থেকে ইসলামই রক্ষা করেছিল। ইসলামের এ জীবন্ত অবদান তারা স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করছিল। তারা ছিল পরস্পরে রক্তপিপাসু। ইসলামের বদৌলতে তারা পরস্পর মিলে একাকার হয়ে গিয়েছিল।এঁদের সম্পর্কে আল্ল¬াহ স্বয়ং বলছেন “ মোহাম্মদ আল্ল¬াহর রাসুল। আর যারা তার সাথে আছে তারা কাফেরদের ব্যাপারে বজ্র কঠোর, নিজেরা পরস্পর দয়া পরাবশ।”(সুরা আল ফাতাহ্ ঃ ১৯) হিজরত পরবর্তি আনসার মোহাজিদের পারস্পরিক সাহায্য সহযোগীতা ও সহর্মমিতা পৃথিবীর ইতিহাসে উজ্জল নিদর্শন হয়ে আছে।

আমাদের পারিবারিক কি সামাজিক, ব্যক্তিগত কি দলীয়, জাতীয় কি আন্তর্র্জাতিক জীবনে সহনশীলতা, সহমর্মিতা ও সৌহার্দতা আজ হাড়াতে বসেছি। সামাজিক সম্প্রীতি ও সহাবস্থানের মধুর সম্পর্ক আজ ছিন্ন হয়ে গেছে। ফলে ক্রমান্বয়ে আমরা জাহিলিয়াত যুগের ন্যায় একটি সার্বিক ধ্বংসের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি। এ ধ্বংসের কবল থেকে দেশ-জাতি-বর্ণ নির্বিশেষে সকলেরই মুক্তির জন্য ইসলামের সামাজিক সম্প্রীতি ও সহঅবস্থানের মহান শিক্ষা আমাদের গ্রহণ করতে হবে।