আল্লাহ তাঁদের সম্মানিত করেন

Published: 26 June 2021

।। জাফর আহমাদ ।।

আল্লাহ তাদের অপমাণিত করেন না, যারা:-
১. আত্মীয়ের সাথে ভাল ব্যবহার করেন।
২. সদা সত্য কথা বলেন।
৩. আমানত পরিশোধ করে দেন।
৪. অসহায় লোকদের বোঝা বহন করেন।
হযরত আয়েশা রা: থেকে বর্ণিত দীর্ঘ হাদিসের কিয়দাংশে উল্লে¬খ করা হয়েছে যে, মানবতার মহান বন্ধু মুহাম্মাদুর রাসুলুল্ল¬াহ সাল্ল¬াল্লাহু আলাইহিস ওয়া সাল্ল¬াম-এর ওপর প্রথম যখন অহীর সূচনা হয়, তখন তিনি জিবরীল আমীনের জবাবে ‘পড়তে পারি না’ বলার পর হযরত জিবরাঈল আমীন তাঁকে বুকের সাথে ভয়ানক জোরে চাপ দেন। এতে তিনি ভয় পেয়ে যান এবং কাঁপতে কাঁপতে বাড়ী ফিরেন। মুহাম্মদ সাল্ল¬াল্লাহু আলাইহিস ওয়া সাল্ল¬াম তাঁর প্রাণপ্রিয় সাহায্যকারী প্রিয়তমা স্ত্রী হযরত খাদীজার রা: কাছে পুরো ঘটনা শুনিয়ে দিলেন এবং বললেন, হে খাদীজা! আমার কি হয়ে গেলো? আমার নিজের জানের ভয় হচ্ছে। হযরত খাদীজা বললেন:‘মোটেই না। বরং খুশি হয়ে যান। আল্ল¬াহর কসম! আল্ল¬াহ কখনো আপনাকে অপমাণিত করবেন না। * আপনি আত্মীয়ের সাথে ভালো ব্যবহার করেন। *সত্য কথা বলেন। *আপনি আমানত পরিশোধ করে দেন।* অসহায় লোকদের বোঝা বহন করেন।
আত্মীয়ের সাথে ভাল ব্যবহার:
ইসলাম আত্মীয়তার সম্পর্ককে অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে মূল্যায়ন করেছে। অন্যান্য ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর ন্যায় আত্মীয়-স্বজনদের অত্যধিক গুরুত্ব প্রদান করেছে বিধায় ইসলামকে বলা হয় মানবতার মুক্তির একমাত্র মহান জীবন ব্যবস্থা। আল কুরআন জুড়ে বিভিন্ন ভঙ্গিতে আত্মীয়-স্বজনদের বর্ণনা এসেছে। আল্লাহ তা’আলা বলেন,“এবং আত্মীয়তা ও নিকট সম্পর্ক বিনষ্ট করা থেকে বিরত থাকো। নিশ্চিতভাবে জেনো রাখো, আল্ল¬াহ তোমাদের ওপর কড়া নজর রাখছেন।”( নিসাঃ ১) “আল্ল¬াহ ন্যায়নীতি, পরোপকার ও আত্মীয়-স্বজনদেরকে দান করার হুকুম দেন।”(সুরা আন নহল ঃ ৯০) “তোমরা আল্ল¬াহর ইবাদাত কর, তার সাথে কাউকে শরীক করোনা, এবং পিতামাতার সাথে ভালো ব্যবহার করো, আরো সদ্ব্যবহার কর আত্মীয়স্বজনদের সাথে, এতীমদের সাথে, দরিদ্রদের সাথে, আত্মীয় প্রতিবেশীদের সাথে, অনাত্মীয় প্রতিবেশীদের সাথে, সফরসংগীর সাথে,পথিকের সাথে এবং দাস-দাসীর সাথে। আল্ল¬¬াহ দাম্ভিক ও গর্বিত লোককে পছন্দ করেন না।”(নিসা ঃ ৩৬)
উল্লে¬খিত আয়াতসমুহে আত্মীয়-স্বজনদেরকে দান করা এবং তাদের সাথে সদাচরণ করা তাদের সাথে ইহ্সান করার একটি বিশেষ ধরন নির্ধারণ করে। এগুলোর অর্থ শুধু এই নয় যে, মানুষ নিজের আত্মীয়দের সাথে সদ্ব্যবহার করবে, দুঃখে ও আনন্দে তাদের সাথে শরীক হবে এবং বৈধ সীমানার মধ্যে তাদের সাহায্যকারী ও সহায়ক হবে। বরং এ-ও এর অর্থের অন্তরভুক্ত যে, প্রত্যেক সামর্থবান ব্যক্তি নিজের ধন-সম্পদের ওপর শুধুমাত্র নিজের ও নিজের সন্তান-সন্তুতির অধিকার আছে বলে মনে করবে না বরং একই সংগে নিজের আত্মীয়-স্বজনদের অধিকারও স্বীকার করবে। আল্ল¬াহর শরী’আত প্রত্যেক পরিবারের সচ্ছল ব্যক্তিবর্গের ওপর এ দায়িত্ব অর্পণ করেছে যে, তাদের পরিবারের অভাবী লোকেরা যেন অভূক্ত ও বস্ত্রহীন না থাকে। তার দৃষ্টিতে কোন সমাজের এর চেয়ে বড় দূর্গতি আর হতেই পারে না যে, তার মধ্যে বসবাসকারী এক ব্যক্তি প্রাচুর্যের মধ্যে অবস্থান করে বিলাসী জীবন যাপন করবে এবং তারই পরিবারের সদস্য তার নিজের জ্ঞাতি ভাইয়েরা ভাত-কাপড়ের অভাবে মানবেতর জীবন যাপন করতে থাকবে।
আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন করা মহাপাপ এবং একে ঈমানের সাথে জুড়ে দেয়া হয়েছে। আত্মীয়কে আরবী ভাষায় রাহেম কলা হয়। আল্ল¬াহ তা’আলার একটি গুণবাচক নাম হলো রহমান। রহমান ও রাহেম একই ধাতু হতে নির্গত। হযরত আয়েশা রাঃ হতে বর্ণিত। নবী সাল্ল¬াল্লাহু আলাইহিস ওয়া সাল্ল¬াম বলেছেন, রক্ত সম্পর্কিত আত্মীয়তা (রহমানের সাথে মিলিত) ঢাল স্বরূপ। যে ব্যক্তি এর সাথে সাথে সম্পর্ক জুড়ে রাখে আমি তার সাথে সম্পর্ক জুড়ে রাখি। আর যে লোক এর সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে। আমি তার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করি। (বুখারী) হযরত যুবাইর ইবনে মুতয়ীম রাঃ থেকে বর্ণিত। তিনি নবী করিমকে সঃ বলতে শুনেছেন আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্নকারী জান্নাতে প্রবেশ করবে না।(বুখারী-মুসলিম)
কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় আমাদের দেশ পাশ্চাত্যের অনুসরণ করতে গিয়ে আত্মীয়-স্বজন তো দূরের কথা আল্ল¬াহ তা’আলার পরে যারা সবচেয়ে বেশী সম্মান ও সদ্ব্যবহার পাওয়ার কথা, তারা আজ বৃদ্ধাশ্রমে স্থান পাচ্ছে। পাশ্চাত্যের পারিবারিক ব্যবস্থার দুষ্টচক্র এসে আমাদের সমাজ ও সভ্যাতাকে গ্রাস করেছে। ফলে মানুষের মধ্যে দয়া-মায়া আজ অনেকটা উড়ে গেছে। এ কারণেই কেউ এখন আর আত্মীয়-স্বজনের খোঁজ-খবর রাখেন না। এমন আত্মীয়-স্বজন আছেন, যারা হয়তো টাকা-পয়সার হিতাকাঙী নয়, তারা শুধুমাত্র একটু দেখা-সাক্ষাৎ, একটু খোঁজ-খবর নেয়ার আশায় উদগ্রীব হয়ে থাকে। কিন্তু আমাদের অনেকেই এতটুকু সময় ও সুযোগ দেয়ার মানসিকতা পোষণ করি না। এ ধরণের সমাজ দ্বারা আমরা কতটুকু সফলতা লাভ করতে পারি। হযরত আব্দুল¬াহ ইবনে আবি আওফা রাঃ থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, আমি রাসুলুল্ল¬াহ সাল্ল¬াল্লাহু আলাইহিস ওয়া সাল্ল¬ামকে বলতে শুনেছি, যেই সম্প্রদায়ের মধ্যে আত্মীয়তার বন্ধন ছিন্নকারী লোক আছে সেই সম্প্রদায়ের ওপর আল্ল¬াহর রহমত নাযিল হয় না।(বায়হাকী)
সদা সত্য কথা বলা:
আল্ল¬াহ সত্য, রাসুল সত্য, আল কুরআন সত্য, আখিরাত সত্য। এই সত্যগুলো এ কথার নির্দেশ দেয় যে ‘তুমি সদা সত্য কথা বলবে, সত্য বিনে মিথ্যে কভু বলিবে না।, কারণ মিথ্যা সকল গুনাহর উৎস। মিথ্যা একটি সুষ্পষ্ট জুলুম। সে যেই ক্ষেত্রেই হোক না কেন, সংশ্লি¬ষ্ট ক্ষেত্রে যা সত্য, সেটিই হক এবং সেটিই তার প্রকৃতি। মিথ্যা হককে খর্ব করে। মিথ্যার কারনে সত্য তার সুন্দর প্রকৃতি অনুযায়ী প্রস্ফুটিত হতে পারে না। এ সত্যের আলো থেকে অন্যেরাও বঞ্চিত হয়। যেমন আল্লাহ এক ও একক। তিনি লা-শারীক, তার কোন শরীক নেই। এটি একটি সত্য ও স্বাভাবিক কথা এবং এটি প্রকৃতির দাবীও। এটি আল্ল¬াহর হক। এ হক থেকে বঞ্চিত করা জুলুম। যারা আল্লাহর সাথে অন্য কোন শক্তিকে শরীক করে তারা মিথ্যার আশ্রয় গ্রহণ করে সত্যকে আড়াল করলো।
আমানত পরিশোধ করে দেয়া:
আমানত ব্যাপক অর্থবোধক একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পরিভাষা। সাধারণ অর্থে আমানত হলো কারো কাছে কোন কিছু গচ্ছিত রাখা এবং নির্ধারিত তারিখে সেই গচ্ছিত মাল সংশ্লি¬ষ্ট ব্যক্তিকে ফেরত দেয়া। কিন্তু ব্যাপক অর্থে আমানত হলো একটি দায়িত্ব ও কর্তব্যের নাম। একজন সৎ, যোগ্য, আমানতদার, যিনি আল্ল¬াহকে এবং আখিরাতের জবাবদিহিতাকে ভয় করেন, হালাল-হারাম বাচাই করে চলেন, মানবতার মুক্তি-কল্যান এবং দেশ ও জাতির উন্নয়নের মাধ্যমে যিনি আখিরাতের মুক্তি তালাশ করেন। যিনি আল্লাহকে একমাত্র প্রভু, রাসুল সাল্ল¬াল্লাহু আলাইহিস ওয়া সাল্ল¬ামকে একমাত্র অনুসরনীয়, অনুকরণীয় এবং আল-কুরআনকে একমাত্র সব সমস্যার সমাধান হিসাবে গ্রহণ করেছেন, তিনিই তো যুক্তিসঙ্গত কারণে জাতির কর্ণধারের দায়িত্ব পাওয়া উচিৎ। এবং এ ধরনের যথার্থ উপযোগী লোকের নিকট পবিত্র আমানত তথা দেশ ও জাতির দায়িত্ব অর্পণ করা আমাদের কর্তব্য।
অসহায় লোকদের বোঝা বহন করা:
মানুষ নৈতিক জীব এ জন্যই সে মানুষ। মানুষ তার আছে মনুষত্ব, মানবিক মূল্যবোধ, প্রেম, প্রীতি ও ভালবাসা। মানুষ তার আছে উন্নত পর্যায়ের চিন্তা, উপলব্ধি জ্ঞান, বিবেক-বুদ্ধি ও উন্নত চরিত্র যা অন্য কোন প্রাণীদের নাই। কিন্তু এ মানুষই যখন মনুষত্য, মানবিক মূল্যবোধকে বিসর্জন দেয় তখন সে হিংস্র পশুদেরকেও ছাড়িয়ে যায়। সে তখন নিজের সম্প্রদায়ভুক্ত মানুষদেরকে নির্যাতন করে। তার ক্রোধ, জিঘাংসা এমন ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করে, যা দেখে রীতিমত শিহরিত হতে হয়। এরাই দূর্বল অসহায় কাজের মেয়েটির অকথ্য নির্যাতন চালায়।
মনে রাখা প্রয়োজন আল্ল¬াহই আমাকে ধন-সম্পদ দিয়েছেন, তাঁরই অনুগ্রহে আমরা লেখা-পড়া শিখে বা ব্যবসা-বাণিজ্য করে সমাজের এ পর্যায়ে এসেছি। তিনি আমাদেরকে অসহায় অধীনস্তদের মালিক বানিয়েছেন। এমনটিও তো হতে পারতো যে, আল্ল¬¬াহ আমাদেরকে তাদের অধীনস্ত করে দিয়েছেন। সুতরাং এদের প্রতি সহায় হোন। আপনার একটু ভালবাসা ওদের অন্তরের অন্তস্থলকে এতটাই সিক্ত করবে যে, সে আপনার একান্ত আপন ও বাধ্যগত হয়ে যাবে। সারা জীবন আপনার কল্যাণ কামনাই করে যাবে। রাসুল সাল্ল¬াল্লাহু আলাইহিস ওয়া সাল্ল¬াম বলেছেন ঃ “চাকর চাকরাণী বা দাসদাসীকে প্রয়োজনীয় খাদ্যবস্ত্র দিতে হবে এবং তার ক্ষমতার অতিরিক্ত দায়িত্ব তার ওপর চাপানো যাবে না। নিতাণÍÍই যদি চাপাতে হয়, তবে তার সাথে নিজে কাজ করতে হবে। আল্ল¬াহর সৃষ্টিকে কষ্ট দিও না। তিনি তোমাদেরকে তাদের মালিক বানিয়েছেন, যদি চাইতেন তবে তাদেরকে তোমাদের মালিক বানাতে পারতেন।”(সহীহ মুসলিম) শ্রমিক আর এক অবহেলিত জনমানুষের নাম। এদের অবহেলার পিরিস্তি এতটাই বিস্তৃৃত যা গুণে গুণে বলা খুবই কঠিণ। সমাজে এমন কিছু মানবিক মূল্যবোধ বিবর্জিত লোকও দেখা যায়, যারা বড় বড় মিল-ইন্ডাষ্ট্রিজের মালিক। বেহুদা কাজে টাকা পয়সা ঠিকই খরচ করে থাকে। বিভিন্ন পার্টি ও আয়োজনে লক্ষ লক্ষ টাকা ব্যয় হয়। খ্যাতি, সুনাম অথবা আবেগের বশবর্তি হয়ে ক্লাব, নাটক বা অন্যান্য প্রতিষ্ঠানে লক্ষ লক্ষ টাকার ডোনেশন প্রদান করেন। কিন্তু খোঁজ নিয়ে দেখা যাবে যে নিজের মিল-ইন্ডাষ্ট্রির স্বল্পভেতনভোগী সাধারণ শ্রমিকটির বেতন মাসের পর মাস বাকি পড়ে আছে। তার বিবেকের কঠিণ দরজায় ছোট্র এ শ্রমিকটির করুণ কষ্টের যাতনা কড়া নাড়তে পারে না। এটি একটি বদ অভ্যাস। এ ধরনের আচরণ ইসলামে গ্রহণ যোগ্য নয়। কারণ শ্রমিকের গা-এর ঘাম শুকানোর আগেই মজুরী পরিশোধের তাগিদ দিয়েছেন মানবতার বন্ধু মুহাম্মাদুর রাসুল সাল্ল¬াল্লাহু আলাইহিস ওয়া সাল্ল¬াম ।
জাফর আহমাদ, ম্যানেজার, আইবিবিএল, জিন্দাবাজার, সিলেট।