যুগশ্রেষ্ঠ মুফতি হিসেবে আল্লামা মুফতি মুজাহিদ উদ্দিন চৌধুরী দুবাগী (রহঃ) এর মূল্যায়ন

Published: 6 July 2021

।। মাওলানা হেলাল আহমদ খান ।।

আল্লাহ পাক প্রত্যেক যুগেই উম্মতের জন্য এমন কিছু নেককার মনীষী প্রেরণ করেছেন, যারা মানুষের জন্য নিয়ে আসেন হিদায়াতের আলো, পথভুলা মানুষকে দেখান জান্নাতের পথ। জনসাধারণকে দেন সীরাতে মুস্তাকীম বা সরল সঠিক পথের সন্ধান। তাঁরা হন সমাজের জন্য ইসলামের বাস্তব চিত্র তথা মূর্তপ্রতীক। দ্বীন ইসলামের স্বার্থে যেসব কৃতি পুরুষ, তাঁদের গোটা জীবনকে বিলিয়ে দিয়েছেন, আল্লাহর মা’রিফতে যাদের অন্তরকে আলোকিত করেছেন, খাঁটি মুমিনের অপরিহার্য গুণ তাক্বওয়াকে অবলম্বন করে যারা জীবন কাটিয়েছেন তাঁদের মধ্যে বিংশ শতাব্দির এক অন্যতম রাহবার ছিলেন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ইসলামী চিন্তাবিদ, পীরে কামিল, “ফকীহুন নফস”, হযরত আল্লামা মুফতি মুজাহিদ উদ্দিন চৌধুরী দুবাগী ছাহেব (রহঃ)।

ত্যাগ কুরবানীর মহিমায় ভাস্বর নিবেদিত প্রাণ কথাও কাজে মিল রেখে চলার বিরল গুণের অধিকারী নিরহংকার এই আল্লাহর ওলী মহব্বতে এলাহীর সুধাময় জগতের এক আলোকজ্জল নাম। তাঁর ইলমী খেদমত তথা ক্ষুরধার লিখনী এবং তাত্ত্বিক স্বারগর্ভ পাঠদান আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের বরহক্ব উত্তরসূরীর দায়িত্ব পালন, সমাজ সংস্কার তথা ইউ,কে আল ইসলাহ্ সংগঠন প্রতিষ্ঠা করা, ন্যায়বিচার আর অন্যায়ের বিরুদ্ধে বলিষ্ঠ অবস্থান। এই মুসলিম সমাজে তৈরি করেছিলেন এক নতুন প্রাণ চাঞ্চল্য। তাঁর চারিত্রিক মাধুর্য্যতা অসাময়িক ব্যবহার ধনী গরীব সকলের সাথে আন্তরিক সম্পর্ক সকল মহলে তাকে গ্রহনযোগ্য ও সর্বজন শ্রদ্ধের ব্যক্তি হিসেবে সুপরিচিত করে তুলে। বিশেষতঃ কুতবে আলম হযরত আল্লামা ফুলতলী ছাহেব (রহঃ) এর প্রথমসারির সুযোগ্য খলীফা ও তাঁর আধ্যাত্বিক উত্তরসূরী হওয়াতে আপামর ধর্মপ্রান মানুষের মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দু ছিলেন আল্লামা দুবাগী ছাহেব (রহঃ)। কুরআন হাদিছের রঙ্গে জীবনকে রঙ্গিয়ে তুলতে যে ক’জন দুর্লভ মহামনীষা নিজেকে নিয়োজিত রেখে সফলতা দেখিয়েছেন এবং এক্বামতে দ্বীনের কঠিন পথকে নিজ জীবনের মিশন হিসেবে বরণ করেছেন। আল্লামা দুবাগী ছাহেব (রহঃ) ছিলেন তাদের মধ্যে অন্যতম ।

তিনি একজন যুগশ্রেষ্ট মুফতি ছিলেন, সমানভাবে মুফাসসির ও বিখ্যাত হাদিস বিশারদও ছিলেন। তাঁর জ্ঞানের গভীরতা মাপা সহজ সাধ্য নয়। তাঁর তীক্ষ্ণ বুদ্ধি ও দূরদর্শী চিন্তা-চেতনা, আমাদেরকে হতবাক করে দেয়। নির্লোভ নিরহংকারী একজন আলেমে দ্বীন হিসেবে তিনি আমাদের অনুসরণীয়।

ফতওয়া প্রদানের ক্ষেত্রে আল্লামা দুবাগী ছাহেব (রহঃ) দরখাস্তকারী থেকে প্রশ্নটি লিখিতভাবে নিতেন যাতে করে আবেদক নিজ অবস্থান থেকে সরে যেতে না পারেন। এটা তাঁর তীক্ষ্ণ বুদ্ধির পরিচয় বহন করে। তার পর তিনি হানাফী মাজহাবের অভিমত অনুসারে ফতওয়া দিতেন। ফতওয়া দেয়ার বেলায় তিনি হানাফী মাজহাবের নির্ভরযোগ্য কিতাবের উদ্ধৃতিসহ প্রামাণিক তথ্য দিতেন। বিশেষ করে ফাতওয়ায়ে শামী, ফাতওয়ায়ে তাতারখানিয়া, ফাতওয়ায়ে আলমগীরি, ফাতওয়ায়ে কাজী খাঁন, হেদায়া, শরহে হেদায়া, শরহে বেকায়া, কুদুরী, ফাতওয়ায়ে রেজভীয়া, ফাতওয়ায়ে দেওবন্দ, বাহারে শরীয়তসহ আরো বহু গ্রন্থের হাওলা সহকারে ফতওয়া দিতেন। কেহ কোন দিন তাঁর প্রদত্ত ফতওয়া রদ বা প্রত্যাখ্যান করতে পারেননি।

তাছাড়া মুফতি হওয়ার জন্য এ শাস্ত্রের নানা দিক সম্পর্কে অবগত হওয়া দরকার। মুফতি ও ফতোয়া সম্পর্কে অবহিত হওয়ার জন্য আল্লামা দুবাগী ছাহেব (রহঃ) ঊর্দু ভাষায় ‘মানাছুল মুফতি’ (মুফতিগনের দলিল) নামক অতি প্রয়োজনীয় একটি পুস্তক রচনা করেন, যাহা ১৯৭৬ সালে প্রথম প্রকাশিত হয়। এটি রচনার ক্ষেত্রেও তিনি বহু গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থের বরাত দিয়েছেন। এ শাস্ত্রে পূর্ণ জ্ঞান লাভ না করে ফতোয়া দান করা অনুচিত। বাংলাদেশে থাকাকালীন তিনি মুফতি হিসেবে তখনও মশহুর ছিলেন। বিলেতে আসার পর আন্তর্জাতিক পর্যায়ে তাঁর সুনাম ছড়িয়ে পড়ে। ভারত ও পাকিস্তানের আলিম উলামা তাঁকে “মুফতিয়ে আযম বাংলাদেশ” বলে ডাকত এবং আরবের উলামায়ে কেরাম তাঁকে “ফাদ্বীলাতুস শায়খ” বলে সম্বোধন করত।
আমি অধম ওলি আল্লাহদের সোহবত এবং সান্নিধ্যতাকে খুবই ভালবাসি। যার ফলে দুবাগী ছাহেবের খিদমতে কয়েকবার যাওয়ার সুযোগ হয়েছিল। এছাড়া উনার অনেক মলফুজাত বা লিখনী আমার পড়ারও সুযোগ হয়েছিল। যাতে অনেক অনুপ্রানিত হয়েছি। তারই অভিজ্ঞতায় ও অনেক সোহবতে উপরোল্লিখত সুধারনার সৃষ্টি হয়। আমি অধম উনার একটি কিতাব “মীলাদে বেনযীর” পড়ে উনার যোগ্যতা এবং ইলমী আমানতদারীর ব্যাপারে নিশ্চিত হয়েই মীলাদ ও কিয়াম সম্পর্কে বিগত পঞ্চাঁশ বৎসরের লালিত এক ধ্যান ধারনা থেকে সম্পূর্ণ রুজু বা ইউটার্ন করতে বাধ্য হই। অবশ্য কোন প্রকার আবেগ তাড়িত হয়ে বা অন্ধ বিশ্বাস করে নয় বরং কিতাবের প্রত্যেকটি লাইন এমনকি প্রত্যেকটি শব্দকে যাচাই বাচাঁই করে এবং প্রত্যেকটি উক্তির মাওয়াদ বা হাওয়ালা অনুসন্ধান করে যথাযথ ও সঠিক পাই। তাতে বাধ্য হয়ে দীর্ঘ পঞ্চাঁশ বৎসরের ধ্যান ধারনা ত্যাগ করে মীলাদ ও কিয়ামের পক্ষে ফিরে আসি। প্রসঙ্গে আরেকটি কথা না লিখে পারলাম না।

আমার এ নতুন সিদ্ধান্তের কারণে আমার বহু ছাত্র এবঃ অনেক উলামায়ে কেরাম ও আমার সহযাত্রী হয়েছেন। বলার অপেক্ষা রাখেনা যে, ইহা আমার কোন কৃতিত্ত্ব নয় বরং আল্লাহ্ রাব্বুল আ’লামিন এর বিশেষ অনুগ্রহ এবং আল্লামা মুজাহিদ উদ্দিন চৌধুরী দুবাগী ছাহেবের মকবুলিয়তের নমুনা।

নিয়তির আমোম বিধানে এ জ্ঞান তাপস সত্যের সাধক, আধ্যাত্বিক বুযুর্গ, ইসলামী চিন্তাবিদ, কর্মবীর মহাপুরুষ হযরত আল্লামা মুফতি মুজাহিদ উদ্দিন চৌধুরী দুবাগী ছাহেব (রহঃ) ২০২০ সালে ১০ জুলাই রোজ শুক্রবার জুম্মার পূর্বক্ষনে বার্ধক্য জনিত কারণে তাঁর পরিবার পরিজন অগনিত ভক্তমুরীদ আর দেশবাসীকে শোকহত করে তার মাহবুব মাওলার সান্নিধ্যে গমন করেন। (ইন্না ————- রাজিয়ুন) শায়েখে তরীক্বত ও শরিয়ত এই ক্ষনজন্মা মহাপুরুষকে আল্লাহ তা’য়ালা জান্নাতুল ফেরদাউস দান করুন। আমীন। আর আমাদেরকে তথা মুসলিম উম্মাহকে তাঁর অনন্য কর্মময় জীবন ও নিষ্ঠাপূর্ন আদর্শ থেকে শিক্ষা অর্জনের তৌফিক দান করুন। আমিন।

লেখক : প্রাক্তন ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ, বিয়ানীবাজার কামিল মাদ্রাসা, সিলেট এবং বর্তমান খতীব, উটলি বেই জামে মসজিদ নিউক্যাসেল ইউ,কে।