কা’বার পথের মেহমান

Published: 10 July 2021

।। জাফর আহমাদ।। 


হজ্ব ইসলামের একটি গুরুত্বপূর্ণ রোকন বা স্তম্ভ। আরবী ভাষায় হজ্ব শব্দের অর্থ যিয়ারতের সংকল্প করা। যেহেতু খানায়ে ক’াবা যিয়ারত করার উদ্দেশ্যে মুসলমানরা পৃথিবীর চারিদিক হতে নির্দিষ্ট কেন্দ্রের দিকে চলে আসে, তাই এর নাম হজ্ব রাখা হয়েছে। কিন্তু এ হজ্বের পেছনে এক সংগ্রামী, চিত্তাকর্ষক ও শিক্ষাপ্রদ ইতিহাস নিহিত রয়েছে। যারা এ বিশ্ব সম্মেলন কেন্দ্রে আল্ল¬াহর মেহমান হিসাবে হাজিরা দিতে যাবেন, তারা যদি গভীর মনযোগ সহকারে সেই ইতিহাস অধ্যয়ন করে যান, তবে হজ্জ্বের প্রকৃত শিক্ষা ও কল্যাণ লাভ করা সহজ হবে। সেই ইতিহাসের শিরোনামগুলোর সারসংক্ষেপ হলো, শিরকের মুলোৎপাঠনকারী মুসলিম মিল্লাতের অবিসংবাদিত সংগ্রামী নেতা ও পিতা হযরত ইবরাহিম আঃ, আল্লাহর প্রতি অবিচল আস্থার পরীক্ষিত এক মহিয়সী নারী হযরত মা হাজেরা ও তার দুগ্ধপোষ্য সন্তান হযরত ইসমাঈল আ:। আর তাঁদেরই দু’আর ফসল মানবতার পরম সুহৃদ মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সংগ্রামী জীবন চরিত। হজ্জের প্রতিটি অনুষ্ঠানের পেছনে এই চারজন ব্যক্তিত্ব তথা হযরত ইবরাহিম আঃ, মা হাজেরা, ইসমাঈল আ: ও মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের চমকপ্রদ ও শিক্ষণীয় ইতিহাস জড়িত।

 

পিতা হযরত ইবরাহিম আঃ ও পুত্র ইসমাঈল আ: মিলে ইসলামী আন্দোলনের বিশ্ববিখ্যাত কেন্দ্র খানায়ে কাবা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। আল্লাহ তা’আলা নিজেই এ কেন্দ্র নির্দিষ্ট করে দেন। খানায়ে কাবা সাধারণ মসজিদের ন্যায় নিছক ইবাদাতের স্থান নয়, প্রথম দিন হতেই এটা দ্বীন ইসলামের বিশ্বব্যাপী আন্দোলনের প্রচার কেন্দ্ররূপে নির্ধারিত হয়েছিল। এ কাবা নির্মানের মুল উদ্দেশ্য ছিল যে, পৃথিবীর দুরবর্তী অঞ্চলসমুহ হতে এক আল্লাহর প্রতি বিশ্বাসী সকল মানুষ এখানে এসে মিলিত হবে এবং সংঘবদ্ধভাবে এক আল্লাহর ইবাদাত করবে, আবার এখান থেকে ইসলামের বিপ্ল¬বী পয়গাম নিয়ে নিজ নিজ এলাকায় ফিরে গিয়ে তা বাস্তবায়নে সচেষ্ট হবে। বিশ্ব মুসলিমের এ সম্মেলনেরই নাম হজ্ব।

 

এ ঘরের লক্ষ্য উদ্দেশ্য সম্পর্কে হযরত ইবরাহীম আঃ দু’আা শুনুন ঃ আল কুরআনে আল্লাহ বলছেন “এবং স্মরণ কর, যখন ইবরাহিম দু’আা করেছিলেনঃ হে আল্লাহ! এ শহরকে শান্তিপূর্ণ বানাও, আমাকে এবং আমার সন্তানকে মূর্তি পুজার শিরক হতে বাঁচাও। হে আল্ল¬াহ! এ মুর্তি গুলো অসংখ্য লোককে গোমরাহ করেছে। অতএব,যে আমার পন্থা অনুসরণ করবে সে আমার, আর যে আমার পন্থার বিপরীতে চলবে-তখন তুমি নিশ্চয়ই বড় ক্ষমাশীল ও দয়াময়। পরওয়ারদিগার! আমি আমার বংশধরদের একটি অংশ তোমার এ মহান ঘরের নিকট,এ ধুসর মরুভূূমিতে এনে পুনর্বাসিত করেছি-এ উদ্দেশ্যে যে, তারা নামায কায়েম করবে। অতএব,হে আল্ল¬াহ! তুমি লোকদের মনে এতদুর উৎসাহ দাও যেন তারা এর দিকে দলে দলে চলে আসে এবং ফল-মুল দ্বারা তাদের জীবিকার ব্যবস্থা কর। হয়ত ইহারা তোমার কৃতজ্ঞ বান্দা হবে।” সুরা ইবরাহীম-৩৫-৩৭

 

এ সম্পর্কে আল্ল¬াহ রাব্বুল আরো বলেনঃ-“এবং স্মরণ কর, যখন ইবরাহীমের জন্য এ ঘরের স্থান ঠিক করেছিলাম-এ কথা বলে যে, এখানে কোন প্রকার শিরক করোনা এবং আমার ঘরকে তওয়াফকারী ও নামাযীদের জন্য পাক-সাফ করে রাখ। আর লোকদেরকে হজ্জ করার জন্য প্রকাশ্যভাবে আহবান জানাও-তারা যেন তোমার নিকট আসে, পায়ে হেটে আসুক কিংবা দুরবর্তী স্থান হতে কৃশকায় উটের পিঠে চড়ে আসুক। এখানে এসে তারা যেন দেখতে পায় তাদের জন্য দ্বীন-দুনিয়ার কল্যাণের ব্যবস্থা রয়েছে এবং নির্দিষ্ট দিনগুলোতে আল্ল¬াহর দেয়া জন্তু গুলোকে আল্ল¬াহর নামে কুরবানী করবে, তা হতে নিজেরাও খাবে এবং দরিদ্র ও অভাবগ্রস্থ লোকদেরকে খেতে দেবে।” সুরা হজ্জ-২৬-২৮

 

এ ঘরের লক্ষ্য উদ্দেশ্য সম্পর্কে পিতা পুত্র মিলে মহান আল্লাহর দরবারে আরো দু’আা করেছিলেন যা আল্ল¬াহ নিজের ভাষায় কুরআনে বলেছেন:-“এবং স্মরণ কর, ইবরাহিম ও ইসমাইল যখন এ ঘরের ভিত্তি স্থাপন কালে দু’আ করছিলেনঃ পরওয়ারদিগার! আমাদের এ চেষ্টা কবুল কর, তুমি সব কিছু জান এবং সবকিছু শুনতে পাও। পরওয়ারদিগার! তুমি আমাদের দু’জনকেই মুসলিম-অর্থাৎ তোমার অনুগত কর এবং আমাদের বংশাবলী হতে এমন একটি জাতি তৈরী কর যারা একান্তভাবে তোমারই অনুগত হবে। আমাদেরকে তোমার ইবাদাত করার পন্থা বলে দাও, আমাদের প্রতি ক্ষমার দৃষ্টি নিক্ষেপ কর, তুমি বড়ই ক্ষমাশীল ও দয়াময়। পরোয়ারদিগার! তুমি সে জাতির প্রতি তাদের মধ্য হতে এমন একজন নবী পাঠাও যিনি তাদেরকে তোমার বাণী পড়ে শোনাবে,তাদেরকে কিতাব ও জ্ঞান শিক্ষা দিবে এবং তাদের চরিত্র সংশোধন করবে। নিশ্চয় তুমি সার্বভৌম ক্ষমতা সম্পন্ন এবং বিজ্ঞ।” সুরা বাকারা-১২৭-১২৯
যে শিরক উচ্ছেদ ও মূর্তি পূজা বন্ধ করার সাধনা ও আন্দোলনে হযরত ইবরাহীম আঃ ও ইসমাইল আঃ সারাটি জীবন অতিবাহিত করেছিলেন, কালের বিবর্তনে এ কাবা ঘরে আবার ৩৬০টি মুর্তি স্থাপন করা হয়। চারদিকে শিরক আর শিরক চলতে থাকে। লাত, মানাত, হুবাল, নসর,ইয়াগুস, উজ্জা,আসাফ, নায়েলা আরো অসংখ্য নামের মূর্তি তৈরী করে পূজা করত। হজ্বকে তারা তীর্থযাত্রার অনুরূপ বানিয়ে তাওহীদ প্রচারের কেন্দ্রস্থল কাবা ঘর হতে মূর্তি পূজার প্রচার শুরু করেছিল এবং পূজারীদের সর্বপ্রকার কলা কৌশল অবলম্বন করে বিভিন্ন স্থান থেকে আগত লোকদের নিকট হতে নযর-নিয়ায আদায় করত। হজ্জের অন্যান্য অনুষ্ঠান গুলোকে বিকৃতরূপ দিয়ে পালন করত। এ ভাবে ইবরাহীম আঃ ও হযরত ইসমাইল আঃ যে মহান কাজ শুরু করেছিলেন এবং যে উদ্দেশ্যে তারা হজ্জ-প্রথার প্রচলন করেছিলেন, তা সবই বিনষ্ট হয়ে যায়।

 

অবশেষে উপরে উল্লেখিত হযরত ইবরাহীম আঃ এর দু’আরই ফসল মানবতার বন্ধু হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মক্কা বিজয়ের মাধ্যমে শিরকের মূলোৎপাঠন করেন এবং মুসলিম মিল্লাতের পিতার হাড়ানো হজ্জের নিদর্শনগুলো পূনরুদ্ধার করেন।
হজ্জের প্রতিটি পদে পদে আল্লাহর স্মরণ-আল্ল¬াহ নামের যিকর, নামায,ইবাদাত ও কুরবানী এবং কা’বা ঘরের তাওয়াফ বা প্রদক্ষিণ। আর এখানে একটিমাত্র আওয়াযই মুখরিত হয়ে উঠে, হেরেম শরীফের প্রাচীর আর পাহাড়ের চড়াই উৎরাইয়ের প্রতিটি পথে উচ্চারিত হয়ঃ ”লাব্বায়িক আল্ল¬াহুম্মা লাব্বায়িক, লা শারিকা লাকা লাব্বায়িক, ইন্নাল হামদা ওয়ান নিয়মাতা লাকা ওয়াল মুলকা লা শারিকা লাকা” অর্থা হে প্রভু তোমার ডাকে আমি উপস্থিত। আমি এসেছি, তোমার কোন শরীক নাই,আমি তোমারই নিকটে এসেছি। সকল প্রশংসা একমাত্র তোমার জন্যে। সব নিয়ামত তোমারই দান, রাজত্ব আর প্রভুত্ব সবই তোমার। তুমি একক-কেউই তোমার শরীক নাই।”

 

কাবার পথের যাত্রীরা কোথায় হাজিরা দিতে যাচ্ছেন আর হাজিরা দিতে গিয়ে কি বলছেন, তা অবশ্যই গভীর মনযোগের সাথে চিন্তা করবেন। এমনিভাবে হজ্বের প্রতিটি অনুষ্ঠান পালন করার সময় কি করা হচ্ছে এবং বলা হচ্ছে তা অনুধাবণ করবেন। আমরা কি প্রকৃতপক্ষেই আমাদের বাস্তব জীবনকে শিরকমুক্ত করতে পেরেছি এবং আল্লাহর কাছে নিজেকে পুর্ণাঙ্গ মুসলিম হিসাবে পেশ করতে পেরেছি ? আত্মজিজ্ঞাসার জবাব যদি না বোধক হয়। তবে আমরা লাব্বায়িক বলে এ বিশ্বসম্মেলন কেন্দ্রে হাজিরা দিব ঠিকই কিন্তু আল্লাহর হাজিরা খাতায় অনুপস্থিত লেখা হবে। যেমননিভাবে আমাদের প্রানহীন নামায মন্দ কাজ হতে বিরত রাখতে পরছেনা, প্রানহীন রোযা তাকওয়ার গুণ সৃষ্টি করতে পারছেনা ও যাকাত আমাদেরকে পবিত্র করতে পারছে না। তেমনিভাবে প্রানহীন হজ্ব আল্ল¬াহর হাজিরা খাতায় অনুপস্থিতিই লেখা হবে। তাই কাবার পথের যাত্রীরা তাদের উপস্থিতিকে নিশ্চিত করার জন্য নিম্ন লিখিত বিষয়গুলো প্রতি নজর দেয়া প্রয়োজন।

 

শিরককে পরিত্যাগ করতে হবে: শিরক একটি জুলুম। শিরকের গুনাহ আল্লাহ মাফ করবেন না। শিরক সমস্ত নেক আমলকে ধ্বংস করে দেয়। এ শিরক বর্তমানে বিভিন্ন রূপ ধারণ করে আমাদের সমাজের রন্দ্রে রন্দ্রে প্রবেশ করেছে। জীবনের সর্বক্ষেত্রে সর্বাবস্থায় এ শিরককে পরিত্যাগ করতে হবে। কারণ শিরক মুক্ত জীবন ও সমাজ গঠণ করার জন্যই হযরত ইবরাহীম আঃ ও হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আজীবন সংগ্রাম করে গেছেন। হজ্জের মূল প্রতিপাদ্য বিষয় হলো শিরক উচ্ছেদ। মহান আল্লাহর সম্মানিত মেহমান হিসাবে তালবিয়া পাঠে আমরা স্বীকৃতিই দিয়ে থাকি। ”আমি উপস্থিত। আমি এসেছি, তোমার কোন শরীক নাই, আমি তোমারই নিকটে এসেছি। তুমি একক-কেহই তোমার শরীক নাই।” এ কথাটিকে বাস্তব জীবনে রূপায়ন করতে হবে।
দ্বিমুখী নীতি পরিহার করে,পরিপূর্ণভাবে আত্মসমর্পণ করতে হবে: জন্মসূত্রে মুসলমান নয় বরং একজন পরিপূর্ণ মুসলিম হতে হবে, সারা জাহানের প্রভুর উদ্দেশ্যে নিজেকে উৎসর্গ করতে হবে, নিজেকে তার নিকট সোপর্দ করতে হবে। জীবনের প্রতিটি কথা ও কাজ কুরআন ও সুন্নাহ অনুযায়ী হতে হবে। শুধু মাত্র পাঁচ ওয়াক্ত নামাযে আল্লাহকে প্রভু হিসাবে স্বীকার করা হলো কিন্তু জীবনের বিশাল অংশকে মানুষের তৈরী আদর্শের হাতে সোপর্দ করলে হবে না। প্রতি নামাযেই অসংখ্যবার বলা হচ্ছে: “আমরা তোমারই গোলামী করি আর তোমারই সাহায্য চাই”। অথচ নামাযের বাইরে তার বিপরীত কাজ করা হচ্ছে। এ এক মিথ্যাচার ছাড়া কি হতে পারে ? আর এ মিথ্যাচারকে হজ্জ পর্যন্ত নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে গিয়ে বলা হয়, তোমার কোন শরীক নাই, রাজত্ব ও প্রভুত্ব তোমরাই।

 

অথচ বাস্তব জীবন তার বিপরীত। এ ধরনের দ্বিমুখী নীতি বা মুনাফেকী আচরণ আমাদের জীবনের সর্বক্ষেত্রে পরিত্যাগ করতে হবে।
হজ্ব চেতনার অনুধাবন:-হজ্জের অনুষ্ঠানগুলো ঐতিহাসিক চেতনাকে সামনে রেখে পালন করতে হবে। আর এ চেতনাকে হযরত ইবরাহীম আঃ ও হযরত ইসমাইল আঃ ন্যায় শিরক উচ্চেদে এবং মানুষকে অসংখ্য মিথ্যা রবের নাগপাশ থেকে মুক্ত করার আপোষহীন সংগ্রামের কাজে ব্যবহার করতে হবে এবং এ সংগ্রাম নিজ নিজ এলাকায় ছড়িয়ে দেয়ার বাধ্যতামূলক দায়িত্ব পালন করতে হবে। তবেই হজ্জের স্বার্থকতা ও সুফল পাওয়া যাবে এবং আল্লাহর হাজিরা খাতায় উপস্থিতি নিশ্চিত করা যাবে।