‘চ্যানেল এস’ চেয়ারম্যান ফ্রিডম অব দ্য সিটি অব লণ্ডন’ সম্মাননায় ভূষিত

Published: 5 October 2021

বিশেষ সংবাদদাতা :

সিলেটের ফেঞ্চুগঞ্জের কৃতিসন্তান আহমেদ উস সামাদ চৌধুরী জেপি গ্রেট ব্রিটেনের সম্মানজনক আন্তর্জাতিক পুরস্কার ফ্রিডম অব দ্য সিটি অব লণ্ডন’ সম্মাননা‘পেয়েছেন। আজ ৫ অক্টোবর লণ্ডনের গিল্ডহলে বেলা আড়াইটায় এক অনুষ্ঠানে উচ্চ আন্তর্জাতিক মর্যাদার এ পুরস্কার তাঁকে দেওয়া হয়।

অনুষ্ঠানে ক্লার্ক টু দি চ্যাম্বারলেইন মুরে ক্রেইগের আহবানে ‘ডিক্লেরেশন অব দি ফ্রিম্যান’ পড়তে দেন আহমেদ উস সামাদ চৌধুরীকে। অনুষ্ঠানে লণ্ডনের বিভিন্ন মিডিয়া ব্যক্তিত্ব উপস্থিত ছিলেন। পরে সপরিবারে উপস্থিত আহমেদ উস সামাদ চৌধুরীর হাতে সম্মাননাটি তুলে দেন ক্লার্ক টু দি চ্যাম্বারলেইন মুরে ক্রেইগ।

‘ফ্রিডম অব দ্য সিটি অব লন্ডন’ সম্মাননা পাওয়ার পর আহমেদ উস সামাদ চৌধুরী জেপি বলেন, আমি নিঃস্বার্থভাবে কাজ করেছি। কোনোদিন কোনো পজিশন চাইনি। আমার এই সম্মাননা কমিউনিটির মানুষকে কল্যাণমুলক কাজে উৎসাহিত  করবে-এটাই আমার এ্যাচিভমেন্ট। আমি অত্যন্ত মর্মাহত যে, আমার ভাই প্রয়াত এমপি মাহমুদ উস সামাদ আমার পাশে নেই আজ।  তিনি এ দুনিয়ায় থাকলে এখানে উপস্থিত থাকতেন, খুব খুশি হতেন’।

উল্লেখ্য, এ বিরল সম্মান তাদেরকেই দেয়া হয়, যারা বিভিন্ন ক্ষেত্রে অসাধারণ অবদান  রেখে আসছেন যুগ যুগ ধরে।  এ সম্মানজনক পুরস্কার ব্রিটেনের রাজ পরিবারের ১১ জন সদস্য পেয়েছেন। তাদের মধ্যে কয়েকজন হলেন, প্রিন্স জর্জ-ডিউক অব ক্যামব্রিজ, প্রিন্সেস ডায়না, প্রিন্স চার্লস-প্রিন্স অব ওয়েলস, প্রিন্স এ্যাডওয়ার্ড-আর্ল অব ওয়াসেক্স প্রমুখ। আরও উল্লেখ্য, উচ্চ মর্যাদার এ পুরস্কার ব্রিটেনের বর্তমান রানী এলিজাবেথ দ্বিতীয় এবং তাঁর মা এলিজাবেথ প্রথম দুজনকেই দেওয়া হয়। তাছাড়া ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী উইন্সটন চার্চিল, মার্গারেট থেচারসহ ডিউক অব ওয়েলিংটন, নেলসন ম্যাণ্ডেলো, জওহর লাল নেহেরু, আর্চ বিশপ অব ক্যান্টারবেরি, জাতিসংঘের প্রাক্তন মহসচিব কফি আনান পেয়েছেন এ পুরস্কার।

আহমেদ উস সামাদ চৌধুরীর জন্ম সিলেট জেলার ফেঞ্চুগঞ্জ থানার নূরপুর গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে ১৯৫৬ সালের ১লা জানুয়ারী।  তাঁর পিতা বিশিষ্ট সমাজ সেবক মরহুম দেলোয়ার হোসেন চৌধুরী ও মাতা মরহুমা আছিয়া আক্তার খানম চৌধুরী।

১৯৭২ সালে তিনি যখন বিলেতে আসেন তখন তিনি সবে কৈশোর পার হওয়া দু’চোখে স্বপ্ন ভরা এক টগবগে তরুণ। তাঁর চোখে যে স্বপ্নের ভীড় ছিল তার সাক্ষর মেলে তাঁর পরবর্তী জীবনের সকল কাজে, সকল অর্জনে। নেতৃত্ব যে তাঁর সহজাত তার প্রথম প্রমাণ মেলে যখন তিনি সিটি অফ বাথ কলেজে অধ্যয়নকালে সেখানে ভিপি নির্বাচিত হন। কর্মজীবনে এসে তিনি সেই কলেজেরই গভর্নর নিযুক্ত হন। ক্ষুদ্র জাতি সত্ত্বার প্রবাসী হিসেবে বৃটেনের একটি কলেজে ৭০-এর দশকে এই রকম নেতৃত্ব অর্জন করতে পারা নিঃসন্দেহে এক বিশাল কৃতিত্বের ব্যাপার।

আহমেদ উস সামাদ চৌধুরী খুব অল্প সংখ্যক বাংলাদেশীদের একজন যিনি বৃটেনে এসে অদক্ষ শ্রমিকের জীবন যাপনের দীর্ঘ দিনের রেওয়াজ ভেঙে দিয়ে ব্যবসা ব্যবস্থাপনায় উচ্চ ডিগ্রী নিয়ে নিজের ব্যবসা প্রতিষ্ঠায় মনোনিবেশ করেন এবং সীমাহীন শ্রম, অধ্যাবসায় ও মেধার বদৌলতে এই ভিন দেশে, বলতে গেলে, ব্যবসা-বানিজ্যের এক বিশাল সাম্রাজ্য গড়ে তোলেন। পাশাপাশি তিনি যেভাবে বৃটেনে বাংলাদেশী কমিউনিটির জন্য এবং নিজ দেশের পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর জন্য একের পর এক কাজ ক’রে গেছেন তাতে এটা বোঝা যায়, তিনি সমণ্বিত জীবন-চেতনার অধিকারী একজন মানুষ যিনি মনে করেন সমাজ পেছনে রেখে কেবল নিজের উন্নতিতে কোন গৌরব নেই। তাই আহমেদ উস সামাদ চৌধুরী বৃটেনে বাংলাদেশী কমিউনিটির এমনই একটি উজ্জ্বল নাম যে, তাঁকে বাদ দিয়ে যদি বৃটিশ বাংলাদেশী জীবনের ইতিহাস লেখা হয় তাহলে সে-ইতিহাস অসম্পূর্ণ হবে।

বালক আহমেদ উস সামাদ নিজ গ্রামের দুর্গাপুর প্রাইমারি স্কুলে প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করে ফেঞ্চুগঞ্জ ফার্টিলাইজার ফ্যাক্টরী হাই স্কুলে ও পিপিএম হাইস্কুলে অধ্যয়ন করেন। ১৯৭২ সালের ৬ সেপ্টেম্বর তিনি চলে আসেন যুক্তরাজ্যে। ইংল্যান্ডের ঐতিহ্যবাহী বাথ শহরের সিটি অফ বাথ কলেজ থেকে ও-লেভেল পাশ করার পর ব্যবসা প্রশাসন বিষয়ে প্রথম ভর্তি হন সাউথ বৃস্টল কলেজে এবং পরে এ বিষয়ে উচ্চ ডিগ্রী শেষ করেন সিটি অফ বাথ কলেজে। উভয় কলেজে তিনি স্টুডেন্ট ইউনিয়নে সহ-সভাপতি ও সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। উচ্চ শিক্ষা শেষ ক’রেই আহমেদ চৌধুরী আত্মনিয়োগ করেন ব্যবসা প্রতিষ্ঠায়।

১৯৯১ সাল থেকে ‘কমনওয়েলথ জাজেস এণ্ড ম্যাজিস্ট্রেট এসোসিয়েশন’ এর আজীবন সদস্য আহমেদ উস সামাদ চৌধুরী একজন সমাজ-সংস্কৃতি ও ইতিহাস-ঐতিহ্য সচেতন ব্যক্তিত্ব যিনি নিজস্ব সংস্কৃতি, ক্রীড়া ইত্যাদির উন্নয়নে বিলেতে এবং বাংলাদেশে নিরন্তর কাজ ক’রে যাচ্ছেন। ১৯৯৬ সালে প্রতিষ্ঠার পর থেকেই ‘বৃটেন-বাংলাদেশ মৈত্রী সমিতি’র প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান এর দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলেন তিনি দীর্ঘ দিন।

১৯৯১ সালে সততা, নিষ্ঠা, অভিজ্ঞতা ও প্রজ্ঞার নিরিখে আহমেদ চৌধুরী বৃটেনে বাংলাদেশী কমিউনিটির মধ্য থেকে ‘জাস্টিস অফ পিস’ (জেপি) হিসেবে নিয়োগ পেয়ে বাথ বেঞ্চের একজন মেজিস্ট্রেট হিসেবে অত্যন্ত দক্ষতা ও সুনামের সাথে দায়িত্ব পালন করে আসছেন।

আহমেদ উস সামাদ চৌধুরী জেপি ১৯৮৩ সালের ২৬ মার্চ অর্থাৎ বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবসে কুলাউড়া থানার কাদিরপুর গ্রামের মরহুম রফিকুল হক চৌধুরীর চতুর্থ কন্যা ফাতেমা পারভিন চৌধুরীর সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। অতিথিপরায়ণ, বন্ধুবৎসল, পরোপকারী, সদালাপী এই সুখী দম্পতির তিন পূত্র ফাহিম, ড্যানিয়েল ও তাহমিদ সবাই বাথ নগরীর বিখ্যাত কিংস উড প্রাইভেট স্কুলে পড়াশুনা করেছে। বড় ছেলে বাথ ইউনিভার্সিটি থেকে ইন্টারন্যাশনাল ডিভেলপমেন্ট-এ স্নাকোত্তর ডিগ্রী নিয়ে এখন বিশ্ব বিখ্যাত আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান, প্রাইস ওয়াটার হাউস কুপার-এ কাজ করছে। দ্বিতীয় ছেলে ড্যানিয়েল কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং-এ মাস্টার্স শেষ ক’রে একটি আন্তার্জাতিক অয়েল ও গ্যাস কোম্পানীতে কর্মরত। সবচে ছোট ছেলে শেফিল্ড ইউনিভার্সিটিতে ফরাসী ভাষা ও ইতিহাসের উপর স্নাতক শ্রেণীতে পড়ছে।

১৯৭৫সালে আহমেদ উস সামাদ ব্রিস্টল ইউনিভার্সিটিতে প্রথম এশিয়ান ছাত্র সংসদের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। এছাড়াও তিনি নিজের নামে আর্থিক ঋণ নিয়ে ১৯৯০ চৌধুরী ব্রিস্টলের শহরে বাংগালী কমিউনিটির জন্য প্রতিষ্ঠা করেন বাংলাদেশ হাউস এবং ১৯৯৩ সালে বাংলাদেশ সেন্টার। তিনিই প্রথম বিলেতে ব্রডশিট মাল্টিকালার পত্রিকা  প্রকাশ করেন।

২০০২ সালে ব্রিস্টলে নান্দনিক শাহজালাল ইসলামিক সেন্টার এন্ড মসজিদ প্রতিষ্ঠায় ছিল অসামান্য অবদান। তিনি ১৯৯৫ সালে সাবেক ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ারের নিউ ডিল প্রগ্রামের উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করেছেন।

বিবি পাওয়ার ১০০, এশিয়ান পাওয়ার সহ অন্তত ১৫টি গ্রন্থে তাঁর অবদান ও অর্জন স্বীকৃতি পেয়েছে। বৃটেন, বাংলাদেশ ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ের বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় ও টিভিতে তাঁর সাক্ষাৎকার ও সাফল্যের কথা প্রকাশিত হয়েছে। সম্প্রতি ডিকশনারি অফ ইন্টারন্যাশনাল বায়োগ্রাফির ৩৭তম সংস্করণে পৃথিবীর ৬০০০ শীর্ষ কৃতি মানুষের তালিকায় স্থান হয়েছে বাংলাদেশের, সিলেটের, ফেঞ্চুগঞ্জের এ কৃতি সন্তানের। মৃত্যুর আগে প্রিয় জন্মভূমিকে একটি উন্নত আধুনিক আত্মনির্ভরশীল দেশ হিসেবে দেখে যাওয়াই একমাত্র স্বপ্ন এই স্বপ্নদ্রষ্টা আহমেদ উস সামাদ চৌধুরী জেপি-র। এ কর্মবীর মানুষটি সম্পর্কে সবিস্তারে জানা যাবে