ফরাসি ক্যাথলিক চার্চের স্বীকারোক্তি: ২,১৬,০০০ শিশুকে যৌন নির্যাতন

Published: 8 October 2021

পোস্ট ডেস্ক :


সংখ্যাটা গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠার মতো। ১৯৫০ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে ফরাসি ক্যাথলিক চার্চের পাদ্রীরা অন্তত ২ লাখ ১৬ হাজার শিশুকে যৌন নির্যাতন করেছেন। দুই বছরব্যাপী এক স্বতন্ত্র তদন্তের পর গত ৫ই অক্টোবর এমনটা জানিয়েছে চার্চটি। এ খবর দিয়েছে দ্য ইকোনমিস্ট।

তদন্ত কমিশনের প্রধান জ্যন-মার্ক স্যুভি জানান, শিশু নির্যাতনকারী পাদ্রীর সংখ্যা ২৯০০ থেকে ৩২০০। পদস্থ নন এমন সদস্যদের বাদ দিয়ে এ সংখ্যা নির্ধারণ করা হয়েছে। তাদের নির্যাতনের শিকার শিশুদের তালিকায় যোগ করা হলে নির্যাতিতের সংখ্যা সংখ্যা ৩ লাখ ৩০ হাজার ছাড়িয়ে যাবে।

তদন্ত প্রতিবেদনে কমিশন লিখেছে, দীর্ঘ সময় ধরে (এসব নির্যাতনের ক্ষেত্রে) ক্যাথলিক চার্চের প্রথম প্রতিক্রিয়া ছিল প্রতিষ্ঠান হিসেবে নিজেকে রক্ষা করা। নির্যাতিতদের প্রতি চার্চ পুরোপুরি, এমনকি নির্মমভাবে অভিন্ন আচরণ করেছে। নির্যাতনের ৯০% শিকারই ছেলে।

তাদের মধ্যে ১০ থেকে ১৩ বছর বয়সীরাও রয়েছে।
স্যুভি চার্চের পৃষ্ঠপোষকতায় ঘটা সকল অপরাধ ও এর ভুলগুলোর জন্য চার্চ কর্তৃপক্ষকে দায় স্বীকারের আহ্বান জানিয়েছেন।

ইতিপূর্বে জার্মানি, আমেরিকা, চিলি ও আয়ারল্যান্ডসহ অন্যান্য দেশেও ক্যাথলিক পাদ্রীদের দ্বারা শিশুদের যৌন নির্যাতনের খবর প্রকাশিত হয়েছে। সেসব দেশের মতো ফরাসি চার্চের অধীনে ঘটা নির্যাতনও একইভাবে ঘটেছে। শিশুদের বিশ্বাসের অপব্যবহার করেছেন পাদ্রীরা। নির্যাতন ঘিরে তথ্য বিকৃত করেছে কর্তৃপক্ষ। গোপন করা হয়েছে ঘটনা। নির্যাতনগুলো ঘিরে জারি ছিল নীরবতা। লজ্জার কারণে অনেকে মুখ খোলেনি।

ফ্রান্সে শিশু নির্যাতন কোনো নির্দিষ্ট অঞ্চল বা একক ডায়োসিস (খ্রিস্টীয় ধর্মাধ্যক্ষের এক্তিয়ারভুক্ত এলাকা) এর মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না। পুরো দেশজুড়েই শিশুদের নির্যাতন করেছেন পাদ্রীরা। ক্যাথলিক চার্চের বৈশ্বিক সদরদপ্তর ভ্যাটিকান সিটি থেকে পোপ ফ্র্যান্সিস নির্যাতিতদের জন্য নিজের ‘গভীর মর্মপীড়া’র কথা প্রকাশ করেছেন।

ফরাসি পাদ্রীদের নির্যাতনের শিকার শিশুদের একজন হচ্ছেন ফ্রাসোয়া ডিভু। ১০ বছর বয়সেই নির্যাতিত হন তিনি। ডিভু জানান, তার মতো নির্যাতনের শিকার অন্যান্য আরও অনেককে খুঁজে পেয়েছেন তিনি। তাদের নিয়ে একটি সংগঠন গঠন করেছেন। তারা জানান, তাদের সঙ্গে যা করা হয়েছে তা সোজা কথায় ‘হেল’ বা নরক।

ডিভুর মতো নির্যাতনের শিকার হওয়া অন্যান্য আরও অনেকের দাবি ও উদ্যোগের কারণেই পাদ্রীদের নির্যাতন নিয়ে তদন্ত করতে বাধ্য হয় ফরাসি ক্যাথলিক চার্চ। ২০১৫ সালেই নিজের নির্যাতনের কথা প্রকাশ করেন ডিভু। অভিযোগ তোলেন লিওঁ শহরের পাদ্রী বার্নার্ড প্রেনাটের বিরুদ্ধে। গত বছর প্রেনাট দোষী সাব্যস্ত হন। ২০১৯ সালে একইরকম অভিযোগের মুখে পদত্যাগ করতে বাধ্য হন কার্ডিনাল ফিলিপ বারবারিন। প্রেনাটের শিশু নির্যাতন ধামাচাপা দেওয়ার অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হন তিনি। যদিও পরবর্তীতে আদালতে ওই রায়ের বিরুদ্ধে আবেদন করলে রায় পাল্টে দেয় আদালত।

ক্যাথলিজমের সঙ্গে ফ্রান্সের সম্পর্ক কিছুটা অস্বাভাবিক। এর মুখ্য কারণ মূলত ‘লাইসিতে’ নামে পরিচিত চার্চের কঠোর ধর্মনিরেপক্ষ বিধান। ১৯০৫ সালে রাষ্ট্র থেকে চার্চের বিচ্ছেদের পর সে বিধানগুলো আরো জোরদার হয়। ক্যাথলিক সব স্কুলই বেসরকারি। সেগুলোয় শিক্ষার্থীর হারও অত্যন্ত কম। অন্যান্য দেশগুলোয় চার্চ-সংশ্লিষ্ট বোর্ডিং স্কুলগু ও প্রভাবশালী সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে বিদ্যমান বিস্তৃত নেটওয়ার্কের কারণে শিশু নির্যাতনের ঘটনা চাপা ছিল বহুদিন। ফ্রান্সে তেমন নেটওয়ার্কও বিদ্যমান না থাকা সত্ত্বেও শিশুরা সুরক্ষিত ছিল না।

ফ্রান্সে ক্যাথলিক চার্চের বর্তমান অবস্থা এর অতীত অবস্থার খোলস-সমান। চার্চের জন্য নতুন যাজক নিয়োগ দেওয়াই এখন কঠিন হয়ে পড়েছে। ২০ বছরে অর্ধেক কমে বর্তমানে ফরাসি চার্চের আওতাধীন যাজকের সংখ্যা মাত্র ১২ হাজারে ঠেকেছে। তাদের মধ্যেও অর্ধেকের বেশি যাজকের বয়সই ৭৫ বছরের বেশি।

উপরন্তু, ফ্রান্সে ধর্মে বিশ্বাসীর সংখ্যাই কমছে। মাত্র ৪৯ শতাংশ ফরাসি সৃষ্টিকর্তায় বিশ্বাস করেন বলে জানিয়েছেন। দুই বছর আগে চার্চে শিশু নির্যাতনের খবর বের হওয়া শুরুর পর এক জরিপে অংশ নেওয়া ৫৬ শতাংশ ফরাসি জানিয়েছেন, ক্যাথলিক চার্চ সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণা রয়েছে তাদের। চলতি সপ্তাহে প্রকাশিত তদন্ত প্রতিবেদন চার্চের সে ভাবমূর্তি আরো ক্ষুণ্ণ করবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।