হাউজে কাউসার কি এবং কাদের জন্য

Published: 15 October 2021

।। জাফর আহমাদ ।।


বিভীষিকাময় হাশরের মাঠ, আল্লাহর আরশের ছায়া ছাড়া আর কোথাও সামান্যতম ছায়ার ব্যবস্থা নেই, তৃষ্ণার্থ মানুষ পানির জন্য হাহাকার, উর্দ্ধাশাসে বিক্ষিপ্ত মানুষ একটু পানি চাই, পানি চাই পানি….পানি, বুক ফেটে গেল। সেদিন একটি পানির পোয়ারার সাকির দায়িত্ব পালন করবেন রাহমাতুললির আলামীন মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম, নাম তার হাউজে কাউসার। যা একটি পানির পোয়ারা। আল্লাহ তা’আলা বলেন,“(হে নবী!) আমি তোমাকে কাউসার দান করেছি। কাজেই তুমি নিজের রবেরই জন্য সালাত পড়ো ও কুরবানী করো, তোমার দুশমনই শিঁকড় কাটা।”(সুরা আল কাউসার)

কাউসার সম্পর্কে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর অনেকগুলো হাদীস রয়েছে। ”সেটি একটি হাউজ। আমার উম্মত কিয়ামতের দিন তার কাছে থাকবে।”(মুসলিম, কিতাবুস সালাত, আবু দাউদ, কিতাবুস সুন্নাহ) “আমি তোমাদের সবার আগে সেখানে পৌঁছে যাবো।”(বুখারী, কিতাবুর রিকাক ও কিতাবুল ফিতান, মুসলিম কিতাবুল ফাযায়েল ও কিতাবুল তাহারাত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা: আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা: ও আবু হোরায়রা রা: বর্ণিত রেওয়ায়েত সমূহ)

“আমি তোমাদের আগে পৌঁছে যাবো, তোমাদের জন্য সাক্ষ্য দেবো এবং আল্লাহর কসম, আমি এ মহুর্তে আমার হাউজ দেখতে পাচ্ছি।”( বুখারী, কিতাবল জানায়েয, কিতাবুল মাগাযী ও কিতাবুর রিকাক)

সাহল ইবনে সাদ, আবু সাঈদ খুদরী ও আবু হুরায়রা রাদিআল্লাহু আনহুম থেকে বর্ণিত হাদীসে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,“ আমি তোমাদের আগে হাউজে গিয়ে তোমাদের জন্য অপেক্ষা করবো। যে আমার কাছে যাবে সে পান করবে, আর যে পান করবে সে আর কখনো পিপাসার্ত হবে না। অনেক মানুষ আমার কাছে আসবে, যাদেরকে আমি চিনতে পারবো এবং তারাও আমাকে চিনতে পারবে, কিন্তু তাদেরকে আমার কাছে আসতে দেয়া হবে না, বাধা দেয়া হবে। আমি বলব: এরা তো আমারই উম্মত। তখন উত্তরে বলা হবে : আপনি জানেন না, এরা আপনার পরে কি সব নব উদ্ভাবন করেছিল। অন্য বর্ণনায়: আপনার পরে তারা কি আমল করেছে তা আপনি জানেন না। অন্য বর্ণনায়: আপনার পরে এরা কি উদ্ভাবন করেছিল সে বিষয়ে আপনার কোন জ্ঞান নেই। তখন আমি বলব: যারা আমার পরে পরিবর্তন করেছে তারা দুর হয়ে যাক! তারা দুর হয়ে যাক।”(বুখারী, কিতাবর রিকাক, ফিতান মুসলিম, কিতাবুল ফাযাইল)

অন্য হাদীসে আবু হুরাইরা রা: বলেন,“রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম একদিন গোরস্থানে গিয়ে বললেন:‘হে বাড়ির মু’মিন বাসিন্দাদের বাড়ির লোকেরা! আপনাদের উপর সালাম। আমরাও আল্লাহর মর্জিতে আপনাদের কাছে পৌঁছে যাবো।’ আমার ইচ্ছা হয় যে, আমরা আমাদের ভাইদেরকে দেখি। সাহাবীগণ বললেন,ইয়া রাসুলুল্লাহ! আমরা কি আপনার ভাই নই? তিনি বললেন, তোমরা আমার সাহাবী, সঙ্গী, আমাদের ভাইয়েরা হচ্ছেন তারা যারা এখনো আসেনি। সাহাবীগণ প্রশ্ন করলেন: ইয়া রাসুলুল্লাহ, আপনার উম্মতের যারা এখনো আসেনি তাদেরকে কিভাবে চিনতে পাবেন? তিনি বললেন, আচ্ছা বলোতো, অনেক কালো ঘোড়ার পালের মধ্যে কারো যদি কিছু সাদা মুখ ও সাদা পা ওয়ালা ঘোড়া থাকে তাহলে কি সে তার ওই ঘোড়াগুলোকে চিনতে পারবে না? সাহাবীগণ উত্তরে বলেন: ইয়া রাসুলুল্লাহ, সে অবশ্যই তার ঘোড়াগুলোকে চিনতে পারবে। তিনি তখন বললেন, আমার পরবর্তী যুগের উম্মতগণ ওযুর কারণে মুখ ও হাত সমুজ্জল নুরে চমকিত অবস্থায় আসবে। আমি তাদের জন্য আগে থেকেই হাউজে গিয়ে অপেক্ষা করবো। সাবধান! তোমরা শুনে রাখ!! অনেক মানুষকে পথহারা উটের মত আমার হাউজ থেকে দূর করে দেয়া হবে। আমি তাদেরকে ডেকে ডেকে বলব: এদিকে এসো। তখন বলা হবে: এরা আপনার পরে পরিবর্তন করেছিল। তখন আমি বলবো: দুর হও, দুর হও।(মুসলিম, কিতাবুত তাহারাত)
সুপ্রিয় পাঠক! এ হাদীসগুলো থেকে কি বুঝা গেল? এ হাদীসগুলো থেকে বুঝা গেল অনেক নিয়মিত অযু ও নামায আদায়কারী মুসলমানও দ্বীনের মধ্যে পরিবর্তন ও নব উদ্ভাবন করার কারণে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর হাউজে কাউসারের পানি থেকে বঞ্চিত হবে। একজন বেদুঈন তার নিজের উটের জন্য যে খাবার বা পানির ব্যবস্থা করেছে সেখানে অন্য কোন পথহারা মালিকবীহিন উট খাবার খাবার বা পানি খেতে আসলে তাকে তাড়িয়ে দেয়। ঠিক তেমনিভাবে এ সকল মুসলমানকে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর হাউজে কাউসার থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হবে।

নব উদ্ভাবন মানে বিদা’আত। এই বিদা’আত বর্তমানে অত্যন্ত সুপরিকল্পিতভাবে ‘ভালো কাজের অবয়বে’ আমাদের ইবাদাতসমূহে প্রবেশ করেছে। যাকে অনেক আলিম বিদা’আতে হাসানা নামে অবহিত করেন। যিনি প্রথম বিদা’আতের শ্রেনীবিভাগ করেছিলেন তিনি হয়ত কোন নেক নিয়্যাতে করেছিলেন। কিন্তু বর্তমানে এই বিদা’আত আমাদের ইবাদাতসমূহে এমনভাবে আসন গেড়েছে যে, কেউ যদি তা পরিত্যাগ করে তবে তাকে নাস্তানাবূদ করা হয়।

আমাদের প্রতিটি ইবাদাতে বেদা’আতকে পরিত্যাগ করে সুন্নাত অনুযায়ী ইবাদাতগুলো পরিপালন করা হলে আল্লাহ কবুল করবেন এবং কিয়ামতের বিভীষিকাময় দিনে হাউজে কাউসারের পানি পাওয়ার সম্ভবনাও তৈরী হবে এবং একই সাথে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর শাফায়াতও নসীব হবে। অন্যথায় উপরের হাদীসগুলোর বর্ণনা তো দেখলেন। আল্লাহ আমাদের ঐ দলে অন্তরভুক্ত না করুন।

নিচের হাদীসে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাদেরকে সাবধান করে দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, “ আমার আগে যে কোন উম্মতের মধ্যে যখনই আল্লাহ কোন নবী প্রেরণ করেছেন তখনই তাঁর উম্মতের মধ্যে কিছু একান্ত আপন সাহায্যকারী সহচর ও সঙ্গী তৈরি হয়। যাঁরা তাঁর সুন্নাত আঁকড়ে ধরে থাকে এবং তাঁর নির্দেশ মেনে চলে। অত:পর তাঁদের পরে উম্মতের মধ্যে এমন কিছু খারাপ শ্রেনীর মানুষ পয়দা হয় যারা যা বলে তা করে না, আর যা করতে তাদেরকে নির্দেশ দেয়া হয়নি তাই করে। যে ব্যক্তি এদের বিরূদ্ধে হাত দিয়ে জিহাদ করবে সে মূ’মিন। যে ব্যক্তি জিহবা দিয়ে এদের বিরূদ্ধে জিহাদ করবে সেও মু’মিন। যে ব্যক্তি অন্তর দিয়ে এদের বিরুদ্ধে জিহাদ করবে সেও মু’মিন। এরপরে আর সরিষা পরিমাণ ঈমানও থাকবে না।”( সহীহ মুসলিম, কিতাবুল ইমান)
হাদীসে চিত্রায়িত রূপ কি আমাদের রূপের সাথে মিলে যায় না? আমরা মুখে সুন্নাত সুন্নাত বলে মহব্বত প্রদর্শন করি, কিন্তু অধিকাংশ কর্ম করি খেলাফে সুন্নাত অনুসারে। মুখে নবী প্রেমের বুলি আওড়াই কিন্তু কাজে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর অনুসরণ করি না।