ফ্রান্সে হাজার হাজার বাংলাদেশির ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত

Published: 28 October 2021

পোস্ট ডেস্ক :


ফ্রান্সের বাংলাদেশ দূতাবাস থেকে গত কয়েক বছর যাবত বাংলাদেশি পাসপোর্ট না মেলায় হাজার হাজার বাংলাদেশি নাগরিকের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত ও অবৈধ ইমিগ্রান্ট হওয়ার শঙ্কা দেখা দিয়েছে।

গত ২৪শে অক্টোবর রোববার প্রবাসী বাংলাদেশিদের আন্তর্জাতিক সংগঠন ‘ভয়েস ফর গ্লোবাল বাংলাদেশিজ ভিএফজিবি’এর নেতৃবৃন্দের সঙ্গে অনুষ্ঠিত ভার্চুয়াল সভায় ফ্রান্স প্রবাসী বাংলাদেশিরা এ অভিযোগ করেন। এ সভায় বিপুল সংখ্যক প্রবাসী বাংলাদেশি ভিএফজিবি’র সঙ্গে জুম মিটিং এ অংশ গ্রহণ করেন ।

 

সভায় সভাপতিত্ব করেন সংগঠনের সভাপতি ড. হাসানাত এম হোসেন এমবিই ও বৈঠকের সমন্বয় করেন ফ্রান্সে ভিএফজিবি প্রতিনিধি সাংবাদিক এএমসি রুমেল।

মিটিং এ যুক্ত হয়ে অনেক ফ্রান্স প্রবাসী বাংলাদেশি অনেক বক্তা তাদের আশঙ্কা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেছেন যে, খুব শীঘ্রই তাদের ফ্রান্সে থাকার বৈধতা শেষ হয়ে যাবে। প্যারিসে বাংলাদেশ দূতাবাস থেকে বাংলাদেশি পাসপোর্ট ইস্যু করা বা ডেলিভারি দেয়া বিলম্বিত করাতে এ সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে। অনেক প্রবাসী ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন যে, তারা দীর্ঘ তিন থেকে পাঁচ বছর ফ্রান্সে আছেন এবং এদেশের আইন অনুযায়ী তিন বছরের আওতায় ২৪টি পে-স্লিপ সংগ্রহ করলে তারা বৈধ হতে পারেন এবং পাঁচ বছর দীর্ঘ দিন এখানে থাকার পর তারা আটটি পে-স্লিপ সংগ্রহ করতে পারলে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ তাদেরকে বৈধতার সুযোগ দিবে। কিন্তু পাসপোর্ট এর অভাবে তারা সেই স্বপ্নটাকে বাস্তবে রূপ দিতে পারছেন না। তাদের কাছে পাসপোর্ট না থাকায় তাদের এই বৈধ হওয়ার স্বপ্নটি দুঃস্বপ্নে পরিণত হয়েছে।

 

অধিকাংশ প্রবাসী বাংলাদেশিদের অভিযোগ, তারা বাংলাদেশ দূতাবাস থেকে পাসপোর্ট না দেয়ার কারণ কি জানতে চাইলে দূতাবাস বলছে, তাদের কিছু করার নেই। এক্ষেত্রে অনেক প্রবাসী পরিবার বাংলাদেশ যোগাযোগ করলে সেখান থেকে বলা হচ্ছে প্যারিস এম্বাসিতে যোগাযোগ করতে। এই যোগাযোগের মধ্যে প্রবাসীদের দিনের পর দিন পার হচ্ছে কিন্তু তারা তাদের পাসপোর্ট হাতে পাচ্ছেন না।

সময়মত পাসপোর্ট না পাওয়াতে অনেক প্রবাসী বাংলাদেশে যেতে পারছেন না। তাদের মায়ের মৃত্যু হয়েছে মায়ের লাশ পর্যন্ত দেখতে পারছেন না। অনেক প্রবাসী তাদের এখানে রেসিডেন্সিয়াল পারমিট রিনিউ করবেন কিন্তু পাসপোর্ট এর জন্য তাদের সেই রেসিডেনশিয়াল পারমিট সংশ্লিষ্ট ফ্রান্স কর্তৃপক্ষ আটকে রেখেছে।

অনেক প্রবাসী আছেন যারা ১৮ বছরের নিচে ফ্রান্সে প্রবেশ করেন। তারা ফ্রান্সে থেকে যান এবং তাদের ক্ষেত্রে ফ্রান্স গভর্মেন্টের অনেক দায় বদ্ধতা থাকে। সে দায়বদ্ধতার জায়গা থেকে সুযোগটা কাজে লাগিয়ে প্রবাসী বাংলাদেশিরা এদেশের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে রেসিডেন্সিয়াল পারমিট এর জন্য এপ্লাই করে থাকেন।

অপ্রাপ্তবয়স্ক বাংলাদেশিদের জন্য ফরাসি সরকারের দায়িত্ব হয়ে যায় অর্থাৎ তাদের বয়স ১৮ হওয়া পর্যন্ত ভাষা কোর্সে ভর্তি করা, চাকরি দেয়া, আশ্রয় দেয়া ইত্যাদি ।

 

সম্প্রতি ১৮ বছর পূর্ণ হয়েছে বা আরও দুই এক মাসের ভিতরে পূর্ণ হবে এমন বেশ কয়েকজন প্রবাসী বাংলাদেশী তারা বলছেন যে- পাসপোর্টটা পেলে তারা খুব দ্রুত ফ্রান্সে বৈধ হতে পারবেন এবং পারমানেন্ট রেসিডেন্সিয়াল পাওয়ার জন্য এপ্লাই করতে পারবেন। অনেক প্রবাসী আবার অভিযোগ করেছেন যে, তারা টেম্পোরারি রেসিডেন্সিয়াল পারমিট নিয়ে বৈধ আছেন কিন্তু বাংলাদেশী পাসপোর্ট নির্ধারিত সময়ে জমা না দেয়াতে এবং ব্যর্থ হওয়াতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ তাদের সেই টেম্পরারি রেসিডেন্স পারমিট বাতিল করে দিচ্ছে। এতে করে তারা আবার অবৈধ হয়ে পড়ার আশঙ্কায় আছেন।

জুম বৈঠকে উপস্থিত সাংবাদিক জনাব ইমরান মাহমুদ বলেন, ফ্রান্সে এ ধরনের ৪ হাজারের বেশি ‘অপ্রাপ্তবয়স্ক’ বাংলাদেশি এখন এই ফাঁদে পড়ে থাকতে পারে। জুম মিটিং এ বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ফরাসি নাগরিক নয়ন এনকে বলেন, দূতাবাসে অনেক সময় ই মেইল করলেও তাৎক্ষণিক রেসপন্স করে না। তারা যে দেশে আছেন সেই দেশের যে কোন বিষয়ে এমপিকে ইমেইল করা হলে বা যোগাযোগের চেষ্টা করা হলে খুব দ্রুত তারা রেস্পন্স পান কিন্তু বাংলাদেশ দূতাবাসের ক্ষেত্রে ঠিক তেমনটা তারা রেসপন্স পান না। বাংলাদেশি সামাজিক সংগঠন ‘বিসিএফ’ সভাপতি এমডি নুর বলেন, ফ্রান্সের বাংলাদেশ দূতাবাস যদি এই বিষয়টাকে গুরুত্ব দিয়ে দেখে এবং সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের দৃষ্টি আকর্ষণ করে তাহলে প্রবাসীরা দ্রুত পাসপোর্ট পাওয়ার পর এই জটিল সমস্যার সহজে সমাধান হতে পারে। আইনি বিষয়ে সহযোগিতা কারণে প্রবাসীদের কাছে অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়ে উঠেছেন ফসে আবেগ রাব্বানী তিনি বাংলা টিভিতে একটি টকশোতে যুক্ত হয়ে বলেন, এই পাসপোর্টগুলো বাংলাদেশ আটকে রাখা হয়েছে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় যোগাযোগ করে এর সুরাহা করা উচিত।

 

অনেকেই মনে করেন এই ৩/৪ হাজার অসহায় প্রবাসীদের সাহায্য করা গেলে বাংলাদেশের ৩/৪ হাজার পরিবার বেঁচে থাকবে এবং প্রেরিত রেমিট্যান্স বাংলাদেশের অর্থনীতিকে আরও মজবুত হবে।

ভিএফজিবি’র পক্ষ থেকে, ড. হাসানাত হোসেন এমবিই ফ্রান্সে পাসপোর্ট জটিলতায় আটকে পড়া প্রবাসীদের বাংলাদেশিদের আশ্বস্ত করেছেন যে, প্যারিস বাংলাদেশ দূতাবাস সহ সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলোর দৃষ্টি আকর্ষণ করবে। অগ্রাধিকারের বিষয় হিসেবে নেয়ার জন্য তাদের অনুরোধ জানিয়ে এই বিষয়টি বাংলাদেশ সরকারের নজরে আনতে ভিএফজিবি যথাসাধ্য চেষ্টা করবে।

ড. হাসানাত হোসেন অংশগ্রহণকারী প্রবাসী বাংলাদেশীদের আশ্বস্ত করে বলেন যে, তিনি বাংলাদেশের ‘বৈদেশিক কল্যাণ’ বিষয়ক মন্ত্রীর সঙ্গে যোগাযোগ করবেন যাতে তিনি দয়া করে এটি দেখেন এবং সমস্যাটি সমাধান করেন। তিনি বিশ্বাস করেন এর আগেও লেবাননের প্রবাসীরা অনেক সমস্যায় জর্জরিত ছিলেন সেখানেও মন্ত্রীর হস্তক্ষেপের মাধ্যমে সমাধান এসেছিল। এখনো তাকে অনুরোধ করলে তিনি ফেলে দিতে পারবেন না। যদি সেটি দেশের স্বার্থে হয়ে থাকে এবং প্রবাসীদের স্বার্থে হয়ে থাকে।

ভয়েস ফর গ্লোবাল বাংলাদেশিজ’র পক্ষে ড: হাসনাত এম হোসেন দুবাই এ অবস্থানরত প্রবাস বিষয়ক মন্ত্রী ইমরান আহমদের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি এ ব্যাপারে বিহিত ব্যবস্থা গ্রহণের আশ্বাস দিয়েছেন। এদিকে পাসপোর্ট সংক্রান্ত বিষয়টি যাচাই করতে মানবজমিনের প্রতিনিধির সঙ্গে কথা হয় প্রবাসীদের এবং তারা নাম না প্রকাশ করার শর্তে অনেক প্রবাসী মানবজমিন প্রতিনিধিকে জানিয়েছেন, একটা পাসপোর্ট পেলে খুব দ্রুত সময়ের মধ্যে এদেশের বৈধতা (রেসিডেন্সিয়াল পারমিট) পাবেন। বাবা-মা দেশে মারা গিয়েছেন তাদের লাশ পর্যন্ত দেখতে যেতে পারেননি। পাসপোর্ট এর জন্য দেশে যেতে পারছেন না। স্ত্রী সন্তানদের এ দেশে আনতে পারছেন না, নিজেরা বিবাহ করতে পারছেন না। ছোট একটা বোন দেশে আছে তার বিয়েতে যেতে পারতেছেন না। হতাশার মধ্যে ভুগছেন অনেকেই বলছেন যে, স্ট্রোক করে মারা যাবেন। অনেকেই বলছেন ইচ্ছে করছে আমাদের সুইসাইড করতে। অনেকে বলছেন, এই জীবন থেকে মুক্তি চাই দীর্ঘদিন ফ্রান্সে আর্থিক কষ্ট করেছি এখন বৈধ হব একটা পাসপোর্ট এর জন্য বৈধ হতে পারছিনা। যে স্বপ্ন নিয়ে এসেছিলাম সেই স্বপ্ন ভেঙ্গে চুরমার হয়ে যাচ্ছে। অনেকে বলছেন, মাঝে মাঝে সুইসাইড করতে ইচ্ছে করে ৪/৫ বছর ধরে পাসপোর্ট এর জন্য অপেক্ষা করছেন সুযোগ সময় আসছে এদেশে বৈধভাবে রেসিডেন্সিয়াল পারমিট পাবার কিন্তু পারছেন না আরো হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়ছেন। অনেকেই পাসপোর্টে সংশোধনের জন্য আবেদন করেছেন তার মধ্যে প্রধান কারণ হচ্ছে (ডেট অফ বার্থ) এর মধ্যে তত্ত্বগত এর নামের বানানের মধ্যে ভুল রয়েছে।

সরজমিনে প্রবাসীদের সমস্যা সম্ভাবনা কথাগুলো শুনে আমাদের মানবজমিন প্রতিনিধি-বাংলাদেশ দূতাবাসে যোগাযোগ করেন। নাম না প্রকাশ করার শর্তে একজন কর্মকর্তা জানান, পাসপোর্ট সংক্রান্ত প্রবাসীদের যে জটিলতার সৃষ্টি হয়েছে সেটি এম্বেসির পক্ষে এই মুহূর্তে সহযোগিতা করা সম্ভব না এগুলা এম্বেসির এখতিয়ারের মধ্যে পড়ে না। এটার জন্য সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় নির্দেশ না দেয়া পর্যন্ত তারা কিছু করতে পারছেন না। তিনি বলেন, দূতাবাসের অনেক দায় বদ্ধতা রয়েছে যার জন্য যদি সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে আসে তাহলে দূতাবাস প্রবাসীদের সহযোগিতা করার জন্য সবসময় প্রস্তুত আছে।