জলবায়ু পরিবর্তন থেকে রক্ষায় অধিক ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর জন্য আরও তহবিল গুরুত্বপূর্ণ

Published: 1 November 2021

।।শেখ হাসিনা ও প্যাট্রিক ভারকুইজেন।।

জলবায়ুর জরুরি অবস্থা বিশ্বজুড়ে। তারপরও এটি সবাইকে সমানভাবে প্রভাবিত করে না। চারটি মহাদেশের ৪৮টি দেশের গ্রুপ ক্লাইমেট ভালনারেবল ফোরামের (সিভিএফ) মতে, জলবায়ু পরিবর্তন স্রেফ অস্তিত্বের হুমকি। এর মধ্যে কোনো অত্যুক্তি নেই।
সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির কারণে ভানুয়াতু, মালদ্বীপ এবং মার্শাল দ্বীপপুঞ্জের মতো ছোট দ্বীপ রাষ্ট্রগুলো নিমজ্জিত হচ্ছে। লবণাক্ত পানির অনুপ্রবেশের ফলে বাংলাদেশের বিস্তীর্ণ এবং নিচু ব-দ্বীপ অঞ্চল, ১৬০ মিলিয়নেরও বেশি মানুষের আবাসস্থল এবং খাদ্য উৎপাদন অঞ্চল বিষাক্ত হচ্ছে। আর শিগগিরই এই অঞ্চল অনুর্বর বর্জ্যভূমিতে পরিণত হতে পারে। তীব্র তাপমাত্রা এবং খরা মধ্যপ্রাচ্যের বিশাল অংশকে হুমকির মুখে ফেলেছে, যা বিশ্বব্যাপী গড় তাপমাত্রাকে দ্বিগুণ করছে। যে দেশগুলো নিয়ে সিভিএফ তৈরি-তাদের জন্য জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়ে পদক্ষেপ নেওয়া ইতোমধ্যেই জরুরি হয়ে পড়েছে। সহজভাবে বললে, এখন আর বিলম্ব করা যাবে না।
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) মতে, আমাদের অর্থনীতিকে সবুজ করতে আগামী দশকে ৬ ট্রিলিয়ন ডলার থেকে ১০ ট্রিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করা প্রয়োজন। এখন পর্যন্ত সিভিএফ-এর বেশির ভাগ সদস্য স্বল্পোন্নত, নিম্ন বা অগ্রগণ্য মধ্যম আয়ের উন্নয়নশীল দেশ। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় তাদের তহবিল, দক্ষতা-উভয়ই প্রয়োজন রয়েছে।
গ্লাসগোতে জাতিসংঘের জলবায়ু পরিবর্তন সম্মেলনে
(কপ-২৬) সিভিএফ উষ্ণায়নের ওপর ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস সীমা বজায় রাখার জন্য অধিকতর উচ্চাকাঙ্ক্ষার কথা বলবে; যা ঝুঁকিতে থাকা অনেকগুলো দেশের বেঁচে থাকার বিষয়। আমরা অভিযোজনে আরও উচ্চাভিলাষী হওয়ার প্রয়োজনীয়তার ওপর আলোকপাত করছি-কারণ আমরা ইতোমধ্যেই জলবায়ু জরুরি অবস্থার মতো ঝড়ের চোখের নিশানায় বাস করছি। এ কারণে ঝুঁকিতে থাকা দেশগুলো জাতিসংঘের প্রতিটি জলবায়ু সম্মেলনে যোগদানের জন্য দূষণ নির্গমনকারী দেশগুলোকে অনুরোধ করছে।
কিন্তু লক্ষ্য অর্জনে দরিদ্র দেশগুলোর জন্য অর্থায়ন অপরিহার্য। যদিও উন্নয়নশীল দেশগুলোকে বার্ষিক ১০০ বিলিয়ন ডলারের জাতিসংঘের জলবায়ু অর্থায়নের প্রতিশ্রুতি পূরণ হচ্ছে না। এ কারণে উন্নয়নশীল দেশগুলো উদ্বিগ্ন। বার্ষিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা বৃদ্ধির জন্য আমরা ১০০ বিলিয়ন ডলার তহবিল গঠন ও বিতরণ পরিকল্পনার কথা বলছি। যা আমরা কপ-২৬ সম্মেলনে দেখতে পাব বলে আশা করছি।
প্রথমত, আমরা ধনী দেশগুলোকে বলব, তারা যেন ২০১৫ সালের প্যারিস চুক্তিতে দেওয়া প্রতিশ্রুতি পূরণে চেষ্টা করে। তারা যেন উন্নয়নশীল বিশ্বে কার্বন নিঃসরণ হ্রাস এবং জলবায়ু-অভিযোজন প্রকল্পগুলোর জন্য বছরে ১০০ বিলিয়ন ডলার প্রদান করে। যেহেতু জলবায়ু-সংবেদনশীল দেশগুলো উত্তপ্ত বিশ্বে জলবায়ু পরিবর্তনের ধ্বংসাত্মক প্রভাবের মধ্যে টিকে আছে। তাই এই তহবিলের অন্তত অর্ধেক ৫০ বিলিয়ন ডলার বছরে অভিযোজনের জন্য বরাদ্দ করা আবশ্যক? তারপর আমরা এই বিলিয়নগুলোকে ট্রিলিয়নে রূপান্তর করার উপায় নিয়ে কাজ করতে পারি; যাতে দেশগুলো জলবায়ু দুর্বলতা থেকে জলবায়ু সমৃদ্ধির দিকে যেতে পারে।
আমরা জানি, এটি সম্ভব। কারণ জলবায়ু অভিযোজনে বিনিয়োগ করা অর্থের বিনিময় মূল্য বিশাল। গ্লোবাল সেন্টার অন অ্যাডাপটেশনের (জিসিএ) পরিসংখ্যান অনুসারে, প্রাথমিক-সতর্কতা পদ্ধতি, জলবায়ু-স্থিতিস্থাপক অবকাঠামো, উন্নত শুষ্ক কৃষিভূমি, ম্যানগ্রোভ সুরক্ষা এবং জলের স্থিতিস্থাপকতা বৃদ্ধি-গুরুত্বপূর্ণ এই পাঁচটি ক্ষেত্রে ১.৮ ট্রিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করলে ২০৩০ সালের মধ্যে ৭.১ ট্রিলিয়ন ডলার লাভ হতে পারে। এছাড়া সমীক্ষায় দেখা গেছে, অভিযোজনের সুবিধাগুলো প্রায়ই তাদের মূল্যের দ্বিগুণেরও বেশি এবং প্রায়ই পাঁচ গুণেরও বেশি ফেরত দেয়।
দ্বিতীয়ত, এই রিটার্নগুলোকে মাথায় রেখে, আমরা বেসরকারি খাতকে বলব, তারা যেন ছাড় এবং লক্ষ্যযুক্ত তহবিল নিয়ে এগিয়ে যায়।
পেনশন তহবিল, তাদের ৩৫ ট্রিলিয়ন ডলার সম্পদের ব্যবস্থাপনা এবং অন্যান্য ব্যংক ও প্রতিষ্ঠান যারা লাখ লাখ মানুষের সঞ্চয়ের তত্ত্বাবধায়ক, তাদের অবশ্যই জলবায়ু পরিবর্তন স্থিতিস্থাপকতার দিকে বিনিয়োগ করতে হবে। এর অংশ হিসাবে, আমরা আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে উদ্ভাবনী উপকরণ যেমন স্থিতিস্থাপক বন্ড, নির্দিষ্ট স্থিতিস্থাপক প্রকল্পগুলোর জন্য বাজারের নিম্ন হারে ঋণ বা জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য ঋণ প্রদানের জন্য উৎসাহিত করব। তারা যেন গার্হস্থ্য, জলবায়ু পরিবর্তন প্রকল্পে ঋণ দেয়।
তৃতীয়ত, দুর্বল দেশগুলো বলছে যে, প্যারিস চুক্তির অধীনে কার্বন বিনিময় প্রকল্প থেকে রাজস্ব জলবায়ু পরিবর্তনের সবচেয়ে খারাপ পরিণতি ভোগ করা দেশগুলোতে লেনদেনের ওপর কমপক্ষে ৫ শতাংশ শুল্কের স্তরে পরিচালিত হয়। কিন্তু এক্ষেত্রে প্রায়ই তারা কম কাজ করেছে। এটা হলে জলবায়ু ন্যায়বিচার এবং কার্বন নিঃসরণ রোধে আমরা সফল হব না।
অবশেষে, আমরা বলব যে মহামারি পুনরুদ্ধারের সংস্থানগুলোকে জলবায়ু অভিযোজনের কথা মাথায় রেখে ব্যবহার করতে হবে, যার মধ্যে ৬৫০ বিলিয়ন ডলার আইএমএফ স্পেশাল ড্রয়িং রাইটস (এসডিআর) আওতায় নতুনভাবে বরাদ্দ। এই অভূতপূর্ব সম্পদকে স্থিতিস্থাপক অবকাঠামোর দিকে চালিত করা উচিত। যেমন-রাস্তা এবং সেতু যা বন্যা সহ্য করতে পারে। খাদ্য ও পানির নিরাপত্তা বৃদ্ধি করতে পারে। অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের জন্য ধনী-দরিদ্র এবং আরও দুর্বল সদস্য দেশগুলোতে এসডিআর চ্যানেলের বিকল্প অন্বেষণ করা হচ্ছে। নতুন স্থিতিস্থাপক এবং টেকসই ট্রাস্ট বিষয়টি ভালো একটি সূচনা হতে পারে।
উদাহরণস্বরূপ. ঢাকায় জিসিএ’র আঞ্চলিক অফিসের মাধ্যমে বাংলাদেশ অন্যান্য জলবায়ু সংরক্ষিত দেশগুলোর সঙ্গে সেরা অনুশীলন এবং অভিযোজন জ্ঞান ভাগাভাগি করে নিচ্ছে? এর মধ্যে রয়েছে মুজিব জলবায়ু সমৃদ্ধি পরিকল্পনা গ্রহণের অভিজ্ঞতা, যার লক্ষ্য সবুজ প্রবৃদ্ধির জন্য তহবিল ব্যবহার নিশ্চিত করা। জলবায়ু অভিযোজন এবং স্থিতিস্থাপকতা তৈরিতে বাংলাদেশ প্রতিবছর গড়ে তার জিডিপির ২.৫ শতাংশ বা ৫ বিলিয়ন ডলার ব্যয় করে। এছাড়া ৪৫০ মিলিয়ন ডলার ব্যয়ে ১২,০০০টি সাইক্লোন শেল্টার এবং ২,০০,০০০ হেক্টর উপকূলীয় সবুজ বেষ্টনীসহ সারা দেশে প্রায় ৮০০টি অভিযোজন এবং স্থিতিস্থাপক প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়েছে।
এই সহযোগিতার সর্বোচ্চ ব্যবহার করার জন্য, আমাদের আরও অভিযোজন উদ্যোগ প্রয়োজন। উদাহরণস্বরূপ, জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে কৃষকদের সজ্জিত তথা জলবায়ু সমস্যার সময়োপযোগী সমাধানে কৃষি উদ্ভাবন মিশন ফর ক্লাইমেট (এআইএম৪সি) প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। কৃষি উদ্ভাবনে কৃষিতে বিনিয়োগ বৃদ্ধি, সমন্বয় ও সহযোগিতা বৃদ্ধি- এই তিনটিই শুধু এআইএম৪সি’র উদ্দেশ্য নয় বরং এগুলোর সম্প্রসারণকে উৎসাহিত করাই এর কাজ।
কোভিড-১৯ মহামারিতে বিশ্বের দেশগুলো যেভাবে সাড়া দিয়েছে, তাতে এটাই দেখা গেছে যে, বিপদের মুখে একজোট থাকলে কী করা সম্ভব। অস্তিত্বের হুমকি তৈরি করা জলবায়ু সংকট মোকাবিলার জন্য আমাদের একইভাবে উদ্যোগী হতে হবে।
জলবায়ু সংকট মোকাবিলায় বিশ্বের বৃহত্তর উচ্চাকাঙ্ক্ষা প্রয়োজন। ক্লাইমেট ভালনারেবল ফোরামের (সিভিএফ) দেশগুলোকে আরও বেশি তহবিল জোগান দেওয়া হলে জলবায়ু ঝুঁকি থেকে তারা জলবায়ু সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে যাওয়ার সুযোগ পাবে। এটা কেবল জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে থাকা ৪৮ দেশ নয়, হুমকিতে থাকা সব দেশের জন্যই মঙ্গল বয়ে আনবে। বর্তমান বাস্তবতায় এটাই সঠিক পন্থা।
শেখ হাসিনা : বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী এবং প্যাট্রিক ভারকুইজেন : ক্লাইমেট ভালনারেবল ফোরামের চেয়ারম্যান