শীতকে বরণ করতে রংপুরে পিঠা উৎসব

Published: 1 November 2021

মোঃ মমিনুর রহমান, রংপুর :

শুরু হয়েছে হেমন্তকাল। উত্তরাঞ্চলে এবার যেন অনেক আগেই শীত অনুভূত হতে শুরু করেছে।মধ্যরাত থেকে ভোররাত পর্যন্ত কুয়াশার সঙ্গে কিছুটা শীত অনুভব করা যায়। তবে বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে শীতের আর কোন তীব্রতা থাকে না। তারপরও শীতের এই আমেজকে ভিন্ন মাত্রা এনে দেয় পিঠা। পিঠা বাঙালি সংস্কৃতির এক অংশ। শীতের সকালে পিঠা খাওয়া গ্রামের চিরায়ত দৃশ্য হলেও এমন দৃশ্য এখন শহরেও চোখে পড়ে। ব্যস্ত নগর জীবনে যারা পিঠা তৈরি করতে সময় পান না তারা হরহামেশাই ভিড় করেন পাড়া-মহল্লা, বিভিন্ন রাস্তার পাশের পিঠার দোকানগুলোয়। রংপুর শহরের রাস্তার পাশের টং দোকানে বসেন মৌসুমি পিঠা বিক্রেতারা।

 

পিঠার স্বাদ নিতে অনেকেই ভিড় জমান এসব দোকানে। রংপুরের লালবাগ,খামার মোড়, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন ফুটপাতে নিয়মিতই বসে পিঠার দোকান। এসব দোকানে কয়েক ধরনের চিতই এবং ভাপা পিঠা পাওয়া যায়। সন্ধ্যা থেকেই এসব দোকানে ভিড় বাড়তে থাকে। অনেকে কিনে বাসায়ও নিয়ে যান। ঝামেলা কমাতে বাসায় নিয়ে দুধ ও গুড়ে ভিজিয়ে নেন চিতই পিঠা। এ রকম আরো মৌসুমি পিঠার দোকান রয়েছে রংপুর নগরীর শাপলা, গ্রান্ড হোটেল মোড়, জাহাজ কোম্পানী, সাতমাথা,পায়রা চত্বর,সিটি বাজার,পৌর বাজার, মেডিকেল মোড়সহ বিভিন্ন স্থানে।

 

দেখা যায় চালের গুঁড়া, নারকেল, খেজুরের গুড় দিয়ে বানানো হয় ভাপা পিঠা। গোল আকারের এ পিঠা পাতলা কাপড় দিয়ে পেঁচিয়ে ঢাকনা দেয়া হাঁড়ির ফুটন্ত

পানিতে ভাপ দিয়ে তৈরি করা হয়। এ কারণেই এর নাম ভাপা পিঠা। চালের গুঁড়া পানিতে গুলিয়ে মাটির হাঁড়িতে বিশেষ উপায়ে তৈরি করা হয় চিতই পিঠা। অতি সাধারণ এই পিঠাটি গুড় বা ঝাল শুঁটকি ভর্তা দিয়ে খেতে খুবই মজা। তবে চিতই পিঠা বিক্রি হয় হরেক রকমের ভর্তা দিয়ে।

কারমাইকেল কলেজের সামনে এক পিঠা বিক্রেতার সঙ্গে কথা হয়। তিনি বলেন, শীতের কিছুটা আগে ও শীতের সময় তিন মাস পিঠার চাহিদা থাকে। কয়েকদিন থেকে ভাপা ও চিতই পিঠা বিক্রি করছি। আর তিনমাস হয়তো পিঠা বিক্রি করা যাবে। চাল ও গুড়ের দাম বাড়লেও পিঠার দাম একই আছে বলেও জানান তিনি।

 

অন্য সময় কী করেন প্রশ্নে এই নারী পিঠা বিক্রেতা বললেন, বাসাবাড়িতে কাজ করি। তবে সবসময় তো কাজ পাই না। তাই ছোট মেয়েকে নিয়ে রাস্তায় এই কাজ করে সংসার চলছে। শীত শেষ হলে হয়তো কিছু একটা করে চলবো, আল্লাহ যেভাবে রাখে।

 

শাপলা এলাকায় ভ্রাম্যমান পিঠা বিক্রেতা আনিস বলেন, আমরা খেটে খাওয়া মানুষ। যখনই কোনোকিছু করে আয় করার সুযোগ আসে তখনই তাই করতে হয়। শীতের সময় কমবেশি সবাই পিঠা খায়। তাই পিঠা বিক্রি করি। যা আয় হয় বউ, ছেলে-মেয়ে নিয়ে চলে যাচ্ছে।

 

একই সাথে কথা হয় আরেক পিঠা বিক্রেতা সুজন বলেন, আমি গরমের সময় দিনমজুরির কাজ করি। শীতের মৌসুমে পিঠা বিক্রি করি। এতে বাড়তি আয় করে ভালভাবে ছেলে-মেয়ে পরিবার পরিজন নিয়ে ভালই আছি।
বেগম রোকেয়া বিশ^বিদ্যালয় সংলগ্ন ফুটপাতের পিঠা বিক্রেতা শহিদুলের সঙ্গে কথা হয়। তিনি বলেন, আমার এখানে দুই ধরনের ভাপা পিঠা তৈরি করা হয়। ঝালের ভাপা আর গুড়ের ভাপা পিঠা। বিকেল থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত ১শ থেকে ১শ৫০ টা পিঠা বিক্রি করা যায়। প্রতিদিন একইরকম বিক্রি হয় না। কোনোদিন একশটি পিঠাও বিক্রি করা কঠিনে হয়ে যায়। এখন তো সবখানেই পিঠা পাওয়া যায়।

 

রিক্সাচালক বজলুল বলেন, সন্ধ্যায় অল্প টাকায় পেট ভরতে এই পিঠার বিকল্প নাই। এই পথ দিয়ে যাওয়ার সময় পিঠা খেয়ে যাই। দশ টাকা করে একটা পিঠা। এক যুবক বলেন, বিকেলে ঘুরতে এসেছি এখানে। সন্ধ্যায় পিঠা বিক্রি করছে দেখে খেতে এসেছি। শীতের সময়টাতে এই পিঠা বেশ জনপ্রিয়।

 

সাতমাথায় রশিদুলের তৈরি পিঠা দাঁড়িয়ে খাচ্ছেন নাসমিয়া নেহা, এশা ও আদিত্য। তারা বলেন, মামার হাতের পিঠা খুব মজা। নেহা একটি প্রাইভেট কলেজের দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্রী কোম্প। প্রতিদিন এপথ দিয়ে যাতায়াত করেন। তাই যাতায়াতের সময় খালার হাতের বানানো পিঠার স্বাদ গ্রহণ করেন। ইশা, আদিত্য বলেন, এখানে পাশেই একটি কোচিং সেন্টারে আমরা পড়ি। ক্লাস শেষে বাসায় ফেরার পথে মামার হাতের পিঠা খেয়ে যাই। আসমা বলেন, আমার মা এমন মজার পিঠা বানাতে পারেনা। তাই আমি কিনেই খাই। পিঠাগুলো আমার খুব পছন্দের।

 

আবার কেউ আসছেন পরিবারের সদস্যদের নিয়ে পিঠা খেতে, নগরীর জিএল রায় রোডে পিঠা খেতে আসা মুজাহিদ বলেন, শীত চলে আসতিছে একটু ঠান্ডা অনুভব হয় সন্ধ্যা থেকে। আর পিঠাও বিক্রিও শুরু হয়েছে, তাই বন্ধুদের নিয়ে পিঠা খেতে এসেছি। ভালো লাগছে। তবে মনে হচ্ছে এখনও পুরাপরি স্বাদ পাচ্ছিনা। গত বছর এই ধরণের পিঠা এবারও একই দামে বিক্রি হচ্ছে। নগরীর জাহাজ কোম্পানিতে পিঠা খেতে আসা সুমন নামের এক কলেজ ছাত্র বলেন, সন্ধ্যার সময় কিছু খেতে ইচ্ছা করে।তাই অন্য কিছু না খেয়ে বন্ধুদের নিয়ে ভাপা পিঠা খেতে আসি। এবছরে আমি আজ প্রথম পিঠা খেলাম, খুব ভালো লাগলো।

এসময় যত রকমেরই পিঠা তৈরি হোক না কেন ভাপা পিঠার সাথে অন্য কোন পিঠার তুলনাই হয় না। এই পিঠা বিক্রি করেই শীতের সময় অনেকে সংসার চালান। গ্রামের হাট বাজার গুলির বিভিন্ন মোড়ে মোড়ে দোকান নিয়ে বসে পড়েছেন মৌসুমী পিঠা ব্যবসায়ীরা। অনেকেই মৌসুমী এই ব্যবসার সাথে জড়িয়ে পড়েছেন। তেমন একটা পুঁজি লাগে না বলে সহজেই এ ব্যবসা শুরু করা যায়। তাই তো অনেকেই মৌসুমী ব্যবসা হিসাবে এটা বেচে নেন। এছাড়া এসব ভ্রাম্যমান দোকানগুলোতে দেখা যায় পিঠা পাগল লোকজনদের উপচে পড়া ভিড়। বিক্রেতারাও আনন্দের সাথে ভাপা পিঠা বিক্রি করে থাকে।

রংপুর নগরীর ফুটপাতের পাশের সাধারণ দোকানগুলোতে প্রতিটি চিতই পিঠা পাঁচ টাকা। আর ভাপা পিঠা আকার অনুসারে ৫ থেকে ১০ টাকায়। অন্যান্য পিঠার দাম ১৫ থেকে ৫০ টাকা পর্যন্ত।রিকশাচালক, দিনমজুর, শিশু-কিশোর, চাকরিজীবী, শিক্ষার্থী সব শ্রেণি-পেশার মানুষ পিঠার দোকানে ভিড় করে। অনেকে কর্মস্থল থেকে ফেরার পথে সন্ধ্যায় পিঠা নিয়ে যান বাড়িতে।