মীলাদ শরীফ সম্বন্ধে পাক ভারত উপমহাদেশের প্রখ্যাত উলামায়ে কেরামের অভিমত

Published: 2 November 2021

।। আল্লামা মুফতী মুজাহিদ উদ্দীন চৌধুরী দুবাগী (রহঃ)।।

পাক ভারত উপমহাদেশের প্রখ্যাত উলামায়ে কেরাম মীলাদ শরীফের মাহফিল অনুষ্ঠান করাতেন। বিশেষতঃ দেওবন্দের আকাবির অর্থাৎ শীর্ষস্থানীয় খ্যাতনামা বহু উলামায়ে কেরাম মীলাদ মাহফিল অনুষ্ঠান করা এবং গুরুত্ব সহকারে এগুলোতে অংশ গ্রহণের কথা উল্লেখ আছে।
হযরত আব্দুল হক মুহাদ্দিসে দেহলভী (রঃ)
আয় আল্লাহ! আমার এমন কোন আমল নেই যে আমল আপনার দরবারে পেশ করতে পারি। কেননা আমার সকল কর্ম নিয়তের দোষে বিনষ্ট হয়ে গেছে। তবে আপনার খাস মেহেরবাণীতে এমন একটি আমল সম্পাদন করে আসছি যে আমলটি আপনার দরবারে পেশ করার মত, তা হলো আমি মীলাদ মাহফিলে দাঁড়িয়ে সালাম পেশ করি এবং যার পর নেই বিনয় সহকারে মহব্বতের সাথে খালিস নিয়তে আপনার হাবীবের (সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সালাম) উপর দুরূদ ও সালাম পাঠ করে থাকি।
আয় আল্লাহ! এমন কোন স্থান আছে যেখানে মীলাদে পাক হতে অধিক বরকত ও মঙ্গল আপনার পক্ষ থেকে নাযিল হয়। তাই হে আরহামুর রাহিমীন! আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি যে, আমার এ আমল কখনও বৃথা যাবে না। বরং তোমার কাছে গ্রহণীয় হবে। তাছাড়া যে ব্যক্তি দুরূদ ও ছালাম পড়ে তার অছীলা নিয়ে দোয়া করবে তার দোয়া কখনও ফিরিয়ে দেয়া হবে না। (আখবারুল আখইয়ার ৬২৪ পৃঃ)
হযরত শাহ আব্দুর রহীম মুহাদ্দিসে দেহলভী (রঃ)
হযরত শাহ্ ওয়ালী উল্লাহ মুহাদ্দিসে দেহলভী (রঃ) লিখেছেন:- আমার শ্রদ্ধেয় ওয়ালিদ মুহতারাম আমার কাছে বর্ণনা করেছেন যে, আমি প্রতি বৎসর হুযূরে পাক সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সালামের জন্ম দিবসে তাঁর রূহ পাকে সওয়াব রেসানীর উদ্দেশ্যে সর্বদা খানা পিনার আয়োজন করতাম। এক বছর এমন হলো যে, অভাবের দরুন এ তারিখে আহারের জন্য কোন কিছু সংগ্রহ করতে না পারায় কেবল মাত্র কিছু পাকানো চানাবুট জনগণের মধ্যে বন্টন করে দিলাম।
অতঃপর আমি স্বপ্নে দেখলাম যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাকে অত্যন্ত আনন্দিত এবং নূরানী চেহারা নিয়ে তাশরিফ রেখেছেন এবং সে চানাবুটগুলো তাঁর সম্মুখে রাখা আছে। (আদ্দুররুস সামীন ফীমুবাশশারা তিন্নাবিয়্যিল আমীন লিশ্ শাহ ওয়ালী উল্লাহ মুহাদ্দিসে দেহলভী (রঃ) ৮ পৃঃ)
হযরত শাহ্ ওয়ালী উল্লাহ মুহাদ্দিসে দেহলভী (রঃ)
তিনি মীলাদ শরীফে শরীক হওয়ার কথা বর্ণনা করে লিখেছেন:- আমি ইতঃপূর্বে একবার হুজুরে পাকের জন্ম দিবসে সে ঘরে উপস্থিত ছিলাম যেখানে হুযূর সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জন্ম গ্রহণ করেছিলেন। উপস্থিত জনতা হুযূর সাল্লালাহ আলাইহি ওয়া সাল্লামের উপর দুরূদ শরীফ পাঠ করেছিলেন, তাঁর জন্মের সময় এবং নবুওয়ত প্রকাশের পূর্বেকার যে সমস্ত অলৌকিক ঘটনাবলী সংঘটিত হয়েছিল তৎসমুদয়ের উল্লেখ করছিলেন, এমতাবস্থায় হঠাৎ করে দেখতে পেলাম কতগুলো নূর চমকাচ্ছে। আমি বলতে পারিনা উক্ত নূরগুলো আমার চর্ম চক্ষু দ্বারা দেখেছি না অন্তর চক্ষু দিয়ে দেখেছি। এ দু’ অবস্থার মধ্যে প্রকৃত ব্যাপার কি ছিল, সে সম্বন্ধে আল্লাহপাকই অধিকতর জ্ঞানী। আমি এ নূরগুলোর প্রতি ধ্যান করলে বুঝতে পারলাম যে, ইহা সে সমস্থ ফেরেশতার নূর যারা এ ধরনের মাহফিলে উপস্থিত হয়ে থাকেন। (ফুয়ূদুল-হারামাইন)।
উক্ত ঘটনা দ্বারা বুঝা গেল যে, ওলিকুল শিরোমণি হযরত শাহ ওয়ালী উল্লাহ মুহাদ্দিসে দেহলভী (রঃ) মীলাদ শরীফকে প্রাণ দিয়ে ভালবাসতেন এবং মীলাদ মাহফিলে শরীক হতেন। এমন কি হুযূরে পাকের জন্ম দিবসে পবিত্র মক্কা নগরে মীলাদ অনুষ্ঠানে শরীক হয়েছিলেন।
হয়রত শাহ আব্দুল আযীয মুহাদ্দিসে দেহলভী (রঃ)
হযরত শাহ্ আব্দুল আযীয মুহাদ্দিসে দেহলভী (রঃ) মীলাদ শরীফের অনুষ্ঠান প্রতি বৎসর করতেন। শাহ্ সাহেব মুরাদাবাদের আলী মুহাম্মদ খানের নামে যে পত্র লিখেছিলেন, সে পত্রতে বাৎসরিক মীলাদ মাহফিলের বিবরণ উল্লেখ করেছেন। মীলাদ মাহফিলের প্রসঙ্গে বাকি রইল। এর ব্যাখ্যা এই যে, ১২ ইং রবিউল আউয়াল তারিখে আগের ন্যায় জনসাধারণ এসে সম্মিলিত হন এবং দুরূদ শরীফ পড়তে লাগেন। আমি ফকীর উপস্থিত হয়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের শান সম্পর্কিত হাদীস, নবীজীর জন্ম বৃত্তান্ত, দুধ পান, বদন মুবারকের আকৃতি এবং হুযূরের জীবনের কতগুলো আশ্চর্য ঘটনাবলী আলোচনা করি। তারপর প্রস্তুতকৃত খানা বা শিন্নির উপর ফাতিহা পাঠ করতঃ তা হাজিরানে মজলিসের মধ্যে বন্টন করা হয়। (শাহ্ মাওলানা আব্দুল হক এলাহাবাদী কর্তৃক লিখিত “আদ্দুররুল মুনাজ্জাম” তারিখে মীলাদ ৫২ পৃঃ)।
হযরত শাহ্ আব্দুল আযিয মুহাদ্দিসে দেহলভী (রঃ)- এর প্রতিনিধি হযরত শাহ্ মুহাম্মদ ইছহাক মুহাদ্দিসে দেহলভী (রঃ) কর্তৃক লিখিত “মিয়াতে মাসাইল” নামক কিতাবের ১৫নং মাসআলায় লিখেছেন-মীলাদ শরীফের উপর উরূসের কিয়াছ করা শুদ্ধ নয়। যেহেতু মীলাদ শরীফে খাইরুল বাশার রাসূলুল্লাহ সাল্লালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জন্ম বৃত্তান্ত আলোচনা করা হয়। তা খুশীর কারণ আর খুশীর জন্য জমায়েত হওয়া বিদআত ও মন্দ কাজ থেকে মুক্ত হলে জাইয আছে। আর আসলে হুযূর সাল্লালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জন্মের খুশীর মত আর খুশী নেই।
হযরত মাওলানা শাহ আব্দুল গণি মুহাদ্দিসে দেহলভী (রঃ)
মুহাজিরে মাদানী মীলাদ শরীফের মাহফিলে উপস্থিত হতেন, যেমন তাঁর একান্ত বাধ্য ছাত্র শাহ আব্দুল হক এলাহাবাদী (রঃ) লিখেন:- আমাদের শায়খ ও মুর্শিদ উমদাতুল মুফাসসিরীন জুবদাতুল মুহাদ্দিসীন জনাব হযরত মাওলানা শাহ আব্দুল গণি সাহেব নক্শবন্দী মুজাদ্দিদীকে আমি দেখেছি ১২ ইং রবিউল আউয়াল মদীনা শরীফে মসজিদে নববীর মীলাদ শরীফের মাহফিলে অংশ গ্রহণ করেছেন এবং মসজিদে নববীর চত্বরে বসে একজনের পর একজন ইমাম রওজা শরীফের দিকে মুখ করে নবী কারীম সাল্লালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জন্মের কাহিনী বয়ান করছিলেন তা মনযোগের সাথে শুনছেন এবং ক্বিয়ামের সময় সকলের সঙ্গে কিয়ামও করেছেন এ মাহফিলের অবস্থা কয়ফিয়ত ভাষায় ব্যক্ত করার মত নয়। (আদ্দুররুল মুনাজ্জাম)
হযরত মাওলানা মুফতী আজম আলহাজ শাহ মুহাম্মদ মাজহারুল্লাহ (রঃ)
তিনি ১২ই রবিউল আউয়ালের রাত্রে বাৎসরিক মীলাদুন্নবীর (রাসূলুল্লাহ সাল্লালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) মাহফিল অনুষ্ঠান করাতেন। যা স্বীয় মছলকের জন্য পাক ভারতের মধ্যে একক মাহফিল ছিল, যেখানে শরীয়তের পুরোপুরি আদবসমূহ লক্ষ্য রাখা যেত, এত বরকতময় অনুষ্ঠান রাজধানী দিল্লীর অন্তর্গত ফতেহপুরী জামে মসজিদে এশার নামাজান্তে শুরু হত এবং ফজরের নামায পর্যন্ত জারী থাকত। ফজরের নামাজান্তে অনুমান দশ মন শিন্নি বিতরণ করা যেত যদ্ধারা মেহমানদেরও সংখ্যা ভালরূপে অনুমান করা যেতে পারে। ১২ই রবিউল আওয়াল তারিখের সকাল ১০ টা হতে ভোজনালয় শুরু হয়ে তৃতীয় প্রহর পর্যন্ত প্রায় চল্লিশ পঞ্চাশ মন খাওয়া আহার করা যেত। আবার জোহরের নামাযের পর দ্বিতীয় অধিবেশন আরম্ভ হয়ে বিকাল আসর পর্যন্ত জারী থাকত। (মাওয়াইযে মাযহারী ১৫৯ পৃঃ)
এখানে লক্ষ্যণীয় বিষয় এই যে, এত বড় মুফ্তীয়ে আজম এত প্রচুর পরিমাণ টাকা পয়সা খরচ করে পরম জাক-জমকে এবং সমারোহের সাথে মীলাদুন্নবীর মাহফিল উদযাপন করলেন। যদি এ মাহফিল নাজাইয বা বিদআত হতো, তবে কি এত বড় যুগশ্রেষ্ঠ বুজুর্গ ব্যক্তিত্ব হতে কি এ ধরনের নাজাইয কাজ প্রকাশ পাওয়ার কল্পনা করা যেত?
হযরত মাওলানা হাছন আলী লকনভী (রঃ)
রাসূলুল্লাহ সাল্লালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উদ্দেশ্যে মীলাদ শরীফের মাহফিল অনুষ্ঠিত করা একটি উত্তম বরং মুস্তাহাব কাজ এবং নেকীর কারণ। মীলাদ অনুষ্ঠানের দলীলসমূহ কিতাবাদির মধ্যে পূর্ববর্তী ও পরবর্তী মহানুভব মুহাদ্দিসীন ও উলামায়ে কেরাম লিখেছেন। (আদ্দুররুল মুনাজ্জাম)
হযরত মাওলানা ফজুলুর রহমান গঞ্জমুরাদাবাদী (রঃ)
খাজা নূরুল হাছান (রঃ) তদীয় “রিসালায়ে আসরারে মহব্বত” নামক কিতাবের মধ্যে লিখেছেন:- কুতবুল আকতাব হযরত মাওলানা ফজলুর রহমান গঞ্জমুরাদাবাদী (রঃ) বলেন যে, আমার উস্তাদ হয়রত মুহাম্মদ ইছহাক দেহলভী (রঃ) এর সঙ্গে মীলাদ শরীফে যেতাম।
হযরত মাওলানা মুফ্তী ছা’দুল্লাহ মুরাদাবাদী (রঃ)
যদি রাসূলুল্লাহ সাল্লালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দুনিয়ার শুভাগমন উপলক্ষে উত্তম নিয়ত সহাকারে এবং খুশী প্রকাশার্থে মাহফিল করে হযরতের জীবনীর বিভিন্ন দিক আলোচনা করে মু’জিযা বা অলৌকিক ঘটনাবলী উল্লেখ করে খয়রাত করতঃ দান দক্ষিণা করা হয়। আর তাতে শীরয়ত বিরোধী কোন কাজ শামীল না হয় তবে নিশ্চয়ই তা মুস্তাহাব কার্যাবলীর মধ্যে গণ্য হবে।
অতএব, মীলাদুন্নবীর দিবসকে ঈদের দিনের ন্যায় গণ্য করে এতে আনন্দ প্রকাশ করা জাইয আছে। (ফাতাওয়া ছায়দিয়া)
হয়রত সৈয়দ আহমদ শহীদ বেরেলভী (রঃ)
হযরত সৈয়দ আহমদ শহীদ বেরেলভী (রঃ) এর জীবনী পাঠ করলে মালুম হয় যে, তিনি মীলাদ শরীফ পাঠ করেছেন। যেমন তাঁর একজন শিষ্য সৈয়দ মুহাম্মদ আলী সাহেব “মাখযনে আহমদী” নামক কিতাবে হযরতের আরব সফরের সম্পূর্ণ বিবরণ উল্লেখ করে লিখেছেন:-লস্কা নামক স্থান খবুই ভীতিপ্রদ, যেখানে জিন ভূত, দেও দানবরা পথিকদেরকে বড়ই উপদ্রব করতো যখন হযরত সৈয়দ সাহেবের জাহাজ সেখানে গিয়ে পৌছল। তখন হযরত কিবলাহ সমস্ত রাত্রি জাগ্রত থেকে হিজবুল বাহার পড়তে থাকেন। আল্লাহ তা’লার খাস রহমত এবং তাঁর যিকির আযকারের অসীলায় জিন ভূতের আক্রমণ হতে মুক্তি লাভ করলেন এবং ভোর বেলায় আল্লাহর নিয়ামতের শুকরিয়া আদায় করণার্থে মীলাদ শরীফ পাঠ করেন।
পরিশেষে যখন প্রভাত হতে লাগল এবং জাহাজখানি নির্বিঘ্নে ভীতিপ্রদ স্থানটি পার হয়ে গেল। প্রভাতে ক্যাপ্টেন কয়েক পেয়ালা হালুয়া সহকারে স্বীয় কক্ষ হতে বের হলো এবং মীলাদ পাঠ করে শিন্নি বিতরণ করা হলো। (মাখযনে আহমদী)
হয়রত শাহ মুহাম্মদ ইছহাক মুহাদ্দিসে দেহলভী (রঃ)
তিনি লিখেছেন, মীলাদ শরীফের উপর উরূসের কিয়াছ করা শুদ্ধ নয়। কারণ মীলাদ শরীফের মধ্যে রাসূলুল্লাহ সাল্লালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জন্ম বৃত্তান্ত আলোচনা করা হয়। আর তা খুশীর কারণ।
বিদআত ও শরীয়ত বিরোধী এবং নাজাইয কাজ হতে মুক্ত হলে খুশী এবং আনন্দের জন্য একত্রিত হওয়া কোন বাধা নেই।
বস্তুতঃ হুযূর সাল্লালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বেলাদত শরীফের খুশীর ন্যায় খুশী আর কিছুতেই নেই। (মিয়াত মাসাইল মাসআলা নং ১৫)
হযরত হাজী ইমদাদুল্লাহ মুহাজিরে মক্কী (রঃ)
আল্লাহর পরিপূর্ণ ইলমে হক্বিক্বতের দলীল, যুগের সিদ্দীক বা সত্যবাদী, যামানার সার অভিজ্ঞ, ইলমে মা’রিফতের রহস্যবলীর উম্মোচনকারী, আধ্যাত্মিক দরিয়ার তাৎপর্যাবলীর ডুবুরী, আধ্যাত্মিক জ্ঞানের মুক্তাসমুহের দরিয়া, আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের পরিষদ, আল্লাহর দরবারের মকবুল বান্দা, শাহ হাজী ইমদাদুল্লাহ মুহাজিরে মক্কী (রঃ)। (ফাতওয়া দারুল উলুম দেওবন্দ ১ খ. ৫৪ পৃ.)
শুধু পাক ভারত উপমহাদেশের নয় বরং শায়খুল আরব ওয়াল আজম, মুরশিদে কামিল অলিকুল শিরোমণি হযরত হাজী ইমদাদুল্লাহ মুহাজিরে মক্কী (রঃ) এ সমস্ত উচ্চমর্যাদা সম্পন্ন ব্যক্তিত্বের মধ্যে হন যাঁরা বিশেষতঃ পাকভারত উপমহাদেশের মধ্যে এসব উল্লেখযোগ্য কার্যাবলী বাস্তবায়িত করেছেন যার তুলনা নেই। আজকাল পাক ভারতে মুসলমানদের মধ্যে যে পরিমাণ ইসলাম অবশিষ্ট আছে তা তাঁরই রেহানীকৃত অনুগ্রহের পরিণাম। তিনি ছিলেন ইসলাম ধর্ম তথা শরীয়ত ও মারিফাতের উজ্জ্বল প্রদীপী। হিন্দুস্থানের প্রায়ই বিশেষ করে দেওবন্দের আকাবির অর্থাৎ পূর্বতন বড় বড় উলামা ও বুজুর্গানে দ্বীন তাঁর মুরীদ এবং খলীফা। যেমনঃ হযরত মাওলানা রশীদ আহমদ গাংগুহী (রঃ), হযরত মাওলানা মুহাম্মদ কাছিম নানুতভী (রঃ) হযরত মাওলানা ইয়াকুব নানুতভী (রঃ), হযরত মাওলানা জুলফিকার আলী, হযরত মৌলানা আশরাফ আলী থানভী (রঃ) প্রমুখ যারা পরবর্তীতে স্ব স্ব রীতি এবং নীতির উপর ইসলামের ঐ সমস্ত মহীয়ান গরীয়ান খেদমত সম্পাদিত করেছেন যার নযীর দুনিয়া পেশ করতে অক্ষম। (কুল্লিয়াতে ইমদাদিয়া)
শায়খুল আরব ওয়াল আজম হযরত হাজী ইমদাদুল্লাহ মুহাজিরে মক্কী (রঃ) ইরশাদ করেছেন যে, আমার নীতি হচ্ছে “আমি মীলাদ মাহফিলে যোগদান করি, বরং বরকতের ওসীলা মনে করে আমি নিজেই প্রতি বছর এ আয়োজন করে থাকি এবং কিয়ামে আনন্দ ও তৃপ্তি পেয়ে থাকি ”।(ইসলাহুর রুছুল ১০৮-১০৯ পৃঃ, মাজালিছে হাকিমুল উম্মত ১৬০-১৬২ পৃঃ)
অতএব তাঁর অভিমতকে আমাদের সবার শিরোধার্য মনে করা আবশ্যক।
হযরত মাওলানা কাছিম নানূতবী (রঃ)
দেওবন্দ মাদ্রাসার প্রবর্তক হযরত মাওলানা কাছিম নানূতবীর জামাতা হযরত মাওলানা আব্দুল্লাহ সাহেব “দুররুল মুনাজ্জাম” কিতাবের অভিমত লিখতে মাওঃ কাছিম নানূতবী (রঃ) এবং হযরত মাওলানা ইয়াকুব নানূতবী (রঃ) যিনি দেওবন্দ মাদ্রাসার প্রধান মুহাদ্দিস ছিলেন তাঁদের সম্বন্ধে লিখেছেন:-যুব্দাতুল উলামা উস্তাদগণের উস্তাদ মাওলানা মুহাম্মদ ইয়াকূব সাহেব প্রধান শিক্ষক মাদ্রাসায়ে আরবিয়া দেওবন্দ, বহুবার দেওবন্দেই মীলাদ শরীফে শরীক হয়েছেন। সকলে কিয়াম করার সময় তিনিও কিয়াম করেছেন এবং ফরমালেন এর আমল যেরূপ হওয়ার ছিল সেরূপ নেই। তবুও যখন নবীজীর জন্ম আলোচনার সময় সারা মহফিল দাঁড়িয়ে যাবে তখন কিয়াম ব্যতীত বসে থাকা বেআদবী থেকে খালি নয়। হযরত মাওলানা সাহেবের এ কথা ও আমলের উপর তাঁর অনেক ছাত্র এবং শহরবাসী অনেকই সাক্ষী রয়েছেন।
এছাড়া খান্দানে মুস্তফা জামে শরীয়ত ও তরকীত হাজী সৈয়দ মোঃ আবিদ (মুহতামীম মাদ্রাসায়ে দেওবন্দ) ও মাওলানাকে নিয়ে তাঁর নিজ বাসভবনে “বেলাদত শরীফ” ওয়াজের মাধ্যমে উদ্যাপন করেছেন এবং শিন্নিও বিতরণ করেছেন। কাহ্ফুল ফুদ্বালা অর্থাৎ আলিম ফাজিলগণের আশ্রম মাওলানা কাছিম সাহেব নাজিম অত্র মাদ্রাসা তাঁর নিকট হতেও এ কথা অনেক বার শুনা গেছে যে হুযূর সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জন্মের আলোচনা হলো খায়র ও বরকত হাসিল করার অসিলা বা মাধ্যম। স্বয়ং মাওলানা ও কোন কোন স্থানে মীলাদ মাহফিলে শরীক হয়েছেন। কেননা পীর ওয়াজিদ আলী সাহেব যিনি মাওলানা সাহেবের মুরীদ এবং মীলাদ পাঠক ছিলেন। তিনি এ ঘটনাটির প্রত্যক্ষদর্শী। (দুররুল মুনাজ্জাম)
হযরত মাওলানা খলীল আহমদ সাহারানপুরী (রঃ)
প্রশ্নঃ হযরত রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মীলাদ শরীফের আলোচনা শরীয়তের দৃষ্টিতে হারাম না অন্য কিছু?
উত্তরঃ কখনও নয়, আমরা তো দূরের কথা কোনও মুসলমান এরূপ নয় যে নাকি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মীলাদ শরীফের আলোচনা বরং তাঁর জুতা মুবারকের ধূলি-ঘূর্ণি এবং তাঁর ছওয়ারীর গাধার প্রস্রাবের আলোচনা পর্যন্ত মন্দ বিদআত বা হারাম বলবে। বরং যে সমস্ত জিনিসের সঙ্গে রাসূলে পাকের সামান্যতম সম্পর্ক আছে, এ সমস্তের আলোচনা আমাদের জন্য একান্ত মনোনীত এবং শ্রেষ্ঠতম শ্রেণীর মুস্তাহাব। এতে মীলাদ শরীফের যিকির হোক অথবা তাঁর পেশাব (মোবারক) পায়খানা (মোবারক) উঠাবসা এবং জাগ্রত ও ঘুমন্তের আলোচনা হোক। যেমন আমাদের “বারাহিনে ক্বাতিয়া” নামক পুস্তিকায় বিভিন্ন জায়গায় স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে।
আর আমাদের মাশায়েখগণের ফাতওয়ায় লিখিত আছে, উদাহরণস্বরূপ হযরত শাহ মুহাম্মদ ইছহাক দেহলভী মুহাজিরে মক্কীর ছাত্র মাওলানা আহমদ আলী মুহাদ্দিস সাহারনপুরীর ফাতওয়া আরবীতে তরজমা করে আমরা নকল করছি, তাহলে সকলের রচনাবলীর নমুনা তৈরি হয়ে যাবে।
মাওলানা সাহেবকে কেহ জিজ্ঞেস করছিল যে, মীলাদ শরীফের মাহফিল কিরূপে জাইয এবং কিরূপে নাজাইয?
মাওলানা সাহেব তদুত্তরে লিখেছেন যে, হযরত রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মীলাদ শরীফের যিকির সহীহ্ শুদ্ধ রিওয়ায়েত সহকারে এ সমস্ত সময়ে করা যে সময় কোন ফরজ ওয়াজিব ইবাদত করার সময় নয় এবং এমতাবস্থায় করা যা সাহাবায়ে কেরাম এবং তাবিঈন তাবেতাবিঈনের নীতির খেলাফ না হয়। যাদের উত্তম হওয়ার সাক্ষ্য স্বয়ং হুযূরে পাক দান করেছেন। এ সমস্ত ধর্মীয় বিশ্বাস যেগুলো ধারণা প্রসূত না হয়। এ সমস্ত আদব সহকারে উদযাপন করা যা সাহাবায়ে কেরামের নৈতিকতার বিপরীত না হয়, যে সম্পর্কে রাসুলে কারীম রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন যে, আমি এবং আমার সাহাবীগণ যে পথে প্রতিষ্ঠিত (এর বিপরীত কিছু যেন না করা) যে সব মাহফিল শরীয়ত বিরোধী কাজ হতে মুক্ত হয় এবং খালিস নিয়তে কেবল আল্লাহর সন্তুষ্টির নিমিত্তে করা হয় তবে তা খায়র ও বরকতের কারণ মনে করবে।
এ ধরনের মাহফিলও অন্যান্য নেক যিকরের মাহফিলের ন্যায় এ মাহফিলও নেকীর মাহফিলে গণ্য হবে। ওটা কোন ওয়াক্তের সঙ্গে বৈশিষ্ট্য নয়। যখন মুখাবয়ব এরূপ হবে, তখন আমাদের জানামতে কোন মুসলমানও তাকে নাজাইয বা বিদআত হওয়ার হুকুম দিবে না।
এ দ্বারা বুঝা গেল যে, আমরা মীলাদ শরীফের অস্বীকারকারী নই বরং ঐ সমস্ত নাজাইয বিষয়াদির অস্বীকারকারী যেগুলো এর সঙ্গে সংযুক্ত হয়ে গেছে। যেমন হিন্দুস্তানের মীলাদ শরীফের মাহফিল সমূহে তিনি স্বচক্ষে দেখেছেন যে, জাল এবং বাজে রেওয়ায়তসমূহ বয়ান হয়। পুরুষ-নারীর বে শামাল আড্ডা মিশ্রণ হয়। আলোকসজ্জা এবং অন্যান্য সাজ সজ্জার মধ্যে ইছরাফ বা অপব্যয় করা এবং যে ব্যক্তি মাহফিলকে জরুরী মনে না করে উপস্থিত না হয় তাকে নিয়ে ঠাট্টা বিদ্রুপ এবং অবিশ্বাসী সাব্যস্ত করা হয়। এতদ্ব্যতীত শরীয়ত বিরোধী কাজ হতে খালি হওয়া হয়তঃ কোন মীলাদ মাহফিলেই সম্ভবপর নয়। যদি মীলাদ শরীফের মাহফিল শরীয়ত বিরোধী কাজ হতে মুক্ত হয় তবে কখনও আমরা বলব না যে, মীলাদ শরীফ নাজাইয এবং বিদআত এবং কোন মুসলমানের দিকে এ ধরনের খারাপ কথার ধারণা করা কিরূপে সম্ভব হতে পারে?
সুতরাং আমাদের উপর এ অপবাদ বিপথগামী প্রতারকদের অপবাদ। আল্লাহ তা’লা এদেরকে লজ্জিত করুন এবং জলে স্থলে নরম এবং শক্ত জমীনে অভিশপ্ত করুন। (আল মুহান্নাদ আলাল মুফান্নাদ। ফাতওয়া খালীলিয়া ১ম খন্ড, ৪৩৬ পৃঃ)
উপরোক্ত বর্ণনা দ্বারা প্রতীয়মান হল, যে হযরত মাওলানা খলীল আহমদ সাহারানপুরী মীলাদ শরীফের মাহফিল অত্যন্ত পছন্দসই এবং উচ্চ দরজার মুস্তাহাব বলে মত পোষণ করেছেন। যদি এতে নর-নারীর মিশ্রণ না হয় এবং আলোক সজ্জা এবং সাজ সজ্জা করে অপব্যয় করা না হয়। মোট কথা আল্লাহর মর্জির খেলাফ যদি কোন কাজ করা বা কথা বলা না হয় তাহলে এ ধরনের মীলাদ মাহফিল উদযাপন করতে কোন নিষেধ নেই। বরং বহু বড় সাওয়াবের কাজ।
হযরত মাওলানা আশরাফ আলী থানভী (রঃ)
তদীয় ইসলাহুর রাসুল নামক কিতাবে বর্ণনা করেছেন যে কোন স্থানে একত্রিত হয়ে সেখানে কোন কিতাব পাঠ করে বা বক্তৃতার মাধ্যমে নবীকুল শিরোমণি হযরত মুহাম্মদ সাল্লালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর জন্ম, জীবন, আদর্শ, দৈনন্দিন চাল-চলন, মু’জিযা ও কৃতিত্ব ইত্যাদি সম্পর্কিত বিশুদ্ধ বর্ণনাসমূহ আলোচনা করা। আলোচনা প্রসঙ্গে-সৎকাজের আদেশ, মন্দ কাজের নিষেধ ইত্যাদি হুকুম-আহকাম ব্যক্ত করার প্রয়োজন দেখা দিলে তা বলতে কুণ্ঠিত না হওয়া অথবা শরীয়তের বিধি-বিধান শিক্ষাদানের উদ্দেশ্যে আয়োজিত মাহফিলে নবী কারীম সাল্লালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জীবনী আলোচনা করা। এ প্রকারের মীলাদ মাহফিল নির্ভেজাল জাইয বরং মুস্তাহাব ও সুন্নাত। এভাবেই নবী কারীম সাল্লালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম স্বীয় জীবন ও মর্যাদার আলোচনা করে গেছেন। সাহাবায়ে কেরাম (রাঃ) থেকে মিলাদের এ পদ্ধতির বর্ণনা পাওয়া যায়। মুহাদ্দেসীনে কেরাম একে আজ পর্যন্ত যথারীতি প্রচলিত রেখেছেন। কিয়ামত পর্যন্ত এ বিশুদ্ধ নিয়ম অনুসৃত হয়ে যাবে।
বর্ণিত মাওলানা সাহেব উক্ত বর্ণনার কয়েক লাইন পর আবার উল্লেখ করেছেন।
এতে নির্ভরযোগ্য ও দ্বীনদার বর্ণনাকারীগণ সহীহ্ ও নির্ভরযোগ্য বর্ণনাসমূহ ব্যক্ত করে থাকেন, এতে যে পয়সা ব্যয় করা হয় তাও হালাল পন্থায় অর্জিত এর আয়োজন ও ব্যবস্থাপনায় অপব্যয় করা হয় না, এতে উপস্থিত লোকজনের পরনে শরীয়ত সম্মত পোশাক পরিচ্ছদ থাকে, কারো কাছ থেকে শরীয়ত বিরোধী কার্যকলাপ প্রকাশ পেলে বক্তা নির্দ্বিধায় তা সংশোধন করতে প্রয়াসী হন, বক্তাগণ যথাপ্রয়োজনীয় হুকুম-আহকাম বর্ণনা করতে কুণ্ঠিত হন না, এতে গানের সুরে কবিতা আবৃত্তি করা হয় না, বক্তার আলোচ্য বিষয় শরীয়তের সীমা লংঘন করে না, মাহফিলের প্রচারকার্যে অতিরিক্ত গুরুত্বারোপ করা হয় না, মাহফিলে উপস্থিত হওয়ার কারণে অন্য জরুরী ইবাদত আদায়ে অসুবিধা হয় না, সাওয়াব লাভের আশা এবং রাসূলুল্লাহ সাল্লালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মহব্বতের উদ্দেশ্য নিয়ে এ মাহফিল আয়োজিত হয় এবং অন্যান্য যাবতীয় দোষত্রুটি থেকে এ মাহফিল সম্পূর্ণ মুক্ত থাকে। সাথে সাথে আদতে শরীয়ত বিরোধী নয় এমন সব কার্যকলাপ, যেমন- শিন্নি বিতরণ, আতর ব্যবহার, বসার জন্য বিছানা বিছানো ইত্যাদিও পালন করা হয়। তবে তথায় অনুমতি দেয়া যাবে। (ইসলাহুর রুছুল ১০৮-১০৯ পৃঃ, মাজালিছে হাকিমুল উম্মত ১৬০-১৬২ পৃঃ)
উপরি উল্লিখিত বর্ণনা দ্বারা প্রমাণিত হলো যে, হযরত মাওলানা আশরাফ আলী থানভী সাহেব মীলাদ শরীফ জাইয বরং সুন্নাত বলে মত পোষণ করেছেন। যদি তাতে আল্লাহর মর্জির খেলাফ এবং শরীয়ত বিরোধী কোন কাজ না হয়। তিনি আরো বলেছেন যে, সাহাবায়ে কেরাম (রাঃ) থেকে মীলাদ শরীফের এ পদ্ধতি পাওয়া যায়। তাছাড়া মুহাদ্দিসীনে কেরাম একে আজ পর্যন্ত যথারীতি প্রচলিত রেখেছেন এবং কিয়ামত পর্যন্ত এ বিশুদ্ধ নিয়ম অনুসৃত হয়ে থাকবে।
আলহামদুলিল্লাহ! আমরা নিশ্চিত যে, আমাদের বাংলাদেশের কোন মীলাদ মাহফিলে আল্লাহর মর্জির খেলাফ কোন কাজ করা হয় না। বরং বাংলাদেশের মীলাদ শরীফে সর্বপ্রথম তিলাওয়াতে কালাম পাঠ করা হয়, তারপর দুরূদ শরীফ, না’তে রাসুল, তাওয়াল্লদ শরীফ তথা রাসূলে পাক সাল্লালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জন্ম বৃত্তান্ত আলোচনা করা হয়। তৎপর কিয়াম করে মুনাজাতান্তে শিন্নি বা তাবারুক বিতরণ করতঃ অনুষ্ঠানের কাজ শেষ করা হয়।
পাঠক লক্ষ্য করুন যে, আমাদের বাংলাদেশের মীলাদ মাহফিলে কোন কাজটি শরীয়ত বিরোধী হলো? ইনশাল্লাহু তাআলা কেউই বলতে পারবে না যে, অমুক কাজটি গর্হিত হয়েছে। অতএব, বাংলাদেশের প্রচলিত মীলাদ শরীফ ভেজালমুক্ত এবং সুন্নাত মোতাবেক হয়ে থাকে।