সাধারণ মানুষের রক্ষাকর্তা কে?

Published: 9 November 2021

।।এ কে এম শাহনাওয়াজ।।

কার্যত সুশাসনবিহীন ও দুর্বল গণতন্ত্রের দেশে সামগ্রিক জনগোষ্ঠীর সবচেয়ে অবহেলিত অংশ হিসাবে বিবেচিত হয় সাধারণ মানুষ। অনেকটা সেন শাসন যুগের শূদ্রের মতো। সেই এগার শতকের মাঝ পর্বের কথা। বল্লাল সেন বাংলার ওপর নিজেদের অন্যায় অধিকার বজায় রাখার জন্য সাধারণ বাঙালির কণ্ঠরোধ করতে চেয়েছিলেন। তাই কঠোরভাবে বর্ণপ্রথা প্রবর্তন করেছিলেন তিনি। এ সূত্রে বিদেশাগত শাসক শ্রেণি সব সুবিধা নিয়ে উচ্চতম ব্রাহ্মণ শ্রেণিভুক্ত হলেন।

দ্বিতীয় ক্ষমতাধর করা হলো বিদেশাগত সামরিক বাহিনীর সদস্যদের। নাম দেওয়া হলো ক্ষত্রিয়। অর্থ আছে বলে দেশি-বিদেশি ভূস্বামী ও বণিকদের কিছু অধিকার দিয়ে বৈশ্য শ্রেণিভুক্ত করা হলো। আর বাদবাকি এ দেশের সাধারণ মানুষকে করা হলো শূদ্র শ্রেণিভুক্ত। যাদের কোনো সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক অধিকার থাকবে না। বলা হতো শূদ্র শ্রেণির কর্তব্য হচ্ছে বিনা বাক্যব্যয়ে ওপরের তিন শ্রেণির সেবা করে যাওয়া। আমাদের এ দেশে সাধারণ মানুষেরও এখন শূদ্রদশা। রাজনৈতিক নেতারা প্রতিপক্ষের সঙ্গে প্রতিদিন রাজনৈতিক ঝগড়া করতে থাকেন আর দলিত-মথিত করতে থাকেন সাধারণ জনগোষ্ঠীকে।

এ সময়ের সবচেয়ে আলোচিত ও জনগণের কষ্টের অভিজ্ঞতার কথাই বলি। ব্যক্তিগত গাড়িতে চলা ভদ্রলোকদের ব্যতিক্রম ধরে বাকি সব সাধারণ মানুষ যাদের রাস্তায় বেরোতে হচ্ছে, কর্মক্ষেত্রে যেতে হচ্ছে, চিকিৎসার জন্য রোগী নিয়ে ছুটতে হচ্ছে হাসপাতালে, বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দেওয়ার জন্য বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে ছুটতে হচ্ছে, কৃষকের তাজা সবজি পাঠাতে হচ্ছে ট্রাকে, পরিবহণ ধর্মঘটে সবাই থমকে গেছে যেন!

এ দেশে সাধারণ মানুষ সব ক্ষেত্রের বিধায়কদের কাছে অচ্ছ্যুৎ বলে পরিবহণ মালিক ও শ্রমিকরা ধুম করে আগাম নোটিশ না দিয়ে তাদের গাড়ির চাকা বন্ধ করে দিল। অবর্ণনীয় দুর্ভোগে পড়ে গেল সাধারণ মানুষ। কষ্টের তিন দিন পার হয়ে গেল। জনগণের দুর্ভোগ লাঘবে সরকারি পদক্ষেপ তখনো দেখা যাচ্ছিল না। সরকারি দায়িত্ববানদের বক্তব্য, সরকারি দায়িত্বশীলরা দেশে-বিদেশে গুরুত্বপূর্ণ কাজে ব্যস্ত আছেন বলে একসঙ্গে বসে সিদ্ধান্ত নিতে পারছেন না।

এজন্য একটু দেরি হচ্ছে। কিন্তু অসহায় সাধারণ মানুষের মুহূর্ত কাটতে চাইছে না। সড়ক পরিবহণের চাকা থেমে গেলেও জলপথ স্বাভাবিক ছিল। গত শনিবার থেকে তারাও ধর্মঘটে অচল করে দিয়েছে সব নৌযান। তবে ৬ নভেম্বর সেতুমন্ত্রীর বক্তব্যে বুঝতে পারি ধর্মঘট প্রত্যাহার হচ্ছে। কারণ, তিনি সহনীয়ভাবে ভাড়া বৃদ্ধির ইঙ্গিত দিয়েছেন। অর্থাৎ জনগণের ঘাড়ে আবার চাপানো হচ্ছে নতুন বোঝা।

ঘটলও তাই। মহোদয়রা ঠিক করে দিলেন লঞ্চ ভাড়া বাড়বে ৩৫ শতাংশ। বাসভাড়া বাড়বে দূরপাল্লায় ২৭ শতাংশ আর মহানগর এলাকায় ২৬.৫০ শতাংশ। সাতপুরোনো স্টাইলেই খেলা শেষ হলো। উভয় পক্ষই সম্ভবত তৃপ্তির ঢেকুর তুলে সভা সমাপ্ত করেছিলেন। ধর্মঘট তুলে নিয়ে জনকল্যাণে সব পক্ষ নিবেদিত হলেন। শুধু প্রশ্ন রয়ে গেল এ বাড়তি ভাড়ার ভর্তুকি জনগণকে কে দেবে?

ধর্মঘট ডাকিয়ে পরিবহণ মালিকদেরও কতটা দোষ দেওয়া যায়! বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো রাতে বৈঠক করে সরকারি সিদ্ধান্ত রাতেই কার্যকর করে ফেলা হলো। বাজারে চাল-তেলের দাম যেমন লাফিয়ে বাড়ে, একই ধারাবাহিকতা বজায় রেখে এক লাফে ডিজেল, কেরোসিন লিটারে ১৫ টাকা বাড়িয়ে দেওয়া হলো। স্বাভাবিকভাবেই এতে আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়তে হচ্ছে পরিবহণ মালিকদের। তাদের বেশিরভাগ সংগঠন ভাড়া বাড়িয়ে সমন্বয় করার দাবিতে ধর্মঘটে নেমে গেল।

অর্থাৎ ভাড়া বৃদ্ধিতে সার্বিক জনগণের ওপর যে তীব্র কশাঘাত নেমে আসবে, তা গৌণ হয়ে বণিক স্বার্থ অটুট রাখার জন্য মাঠে নামল। অতীতের ধারাবাহিকতা বজায় থাকলে সরকারপক্ষ পরিবহণ মালিকদের সঙ্গেই সমঝোতায় আসবে ভাড়া বাড়িয়ে। সাধারণ মানুষের ঘাড়ে আবার একটি ভারি বোঝা চাপবে। কারণ এরা তো সংঘবদ্ধ শক্তি নয়। কেবল আর্তনাদ করবে। সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে পারবে না। এদের কে-ই বা কেয়ার করে।

সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী বিষয়টি নিয়ে সংবাদমাধ্যমে এমন স্মার্ট শব্দ চয়নে কথা বললেন যেন কিছুই হয়নি। যুক্তিও খুব চৌকস। তেলের মূল্যবৃদ্ধি নাকি এমনি আচমকা করতে হয়। ভোক্তার আগেভাগে জানার দরকার নেই। তারা কেবল আদেশ পালন করবে। সরকারি ভাষ্য অনুযায়ী, আগে জানালে অসাধু ব্যবসায়ীরা ডিজেল মজুত করে ফেলবে। তাই সংকটে পড়বে সবাই। এভাবে চালের মূল্যবৃদ্ধি থেকে শুরু করে তেলের মূল্যবৃদ্ধি পর্যন্ত সব ক্ষেত্রে সরকারি পক্ষ নিজেদের অক্ষমতা প্রকাশ করছে।

অর্থাৎ ‘অসাধু ব্যবসায়ী’দের কাছে সরকার কত অসহায়! এ কারণেই বোধহয় সরকার রাজনীতিবিদদের বদলে শক্তিমান বণিকদের সরকার পরিচালনার সঙ্গে যুক্ত রাখছে। এতে সরকারসংশ্লিষ্টদের লাভ কতটা হচ্ছে আমরা জানি না; সাধারণ মানুষের যে নাভিশ্বাস উঠছে, সে শব্দ বিবেকসম্পন্ন মানুষের চোখ-কান এড়াচ্ছে না।

সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী সপ্রতিভভাবে জানালেন, এটাকে ১৫ টাকা বৃদ্ধি বলা যাবে না। আন্তর্জাতিক বাজারে বৃদ্ধি পাওয়া মূল্যের সমন্বয় মাত্র। তিনি হয়তো যথার্থ বলেছেন, কিন্তু বিপন্ন সাধারণ মানুষ তো অর্থনীতির এত মারপ্যাঁচ বোঝে না। তারা দেখে তাদের কষ্টের জীবনযাত্রায় আরেকটি হাতুড়ির ঘা পড়ল। সংবাদমাধ্যমে বিশেষজ্ঞদের বয়ানে শুনলাম, এর আগে আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের মূল্য কমার পরও দেশের বাজারে মূল্য কমানো হয়নি। এতে সরকারের হাজার হাজার কোটি টাকা মুনাফা হয়েছে। এসব টাকা যদি নানা ফুটো দিয়ে বেরিয়ে না যায়, তবে তা দিয়ে এখন সমন্বয় করা যেত। সাধারণ মানুষকে শাস্তি দেওয়া কেন?

পুরোনো ধারা বজায় থাকলে এ বাড়তি ১৫ টাকার দায় সাধারণ মানুষকে নিতে হবে। পরিবহণ মালিকরা ভাড়া বৃদ্ধিতে সরকারি অনুমোদন নিয়ে নেবেন। শুধু তাই নয়, বরাবরের মতো তিন টাকা ক্ষতিপূরণে পাঁচ টাকা আদায় করবেন। আর সবার দায় ও খাই মেটাবে সাধারণ মানুষ। সরকারি পক্ষ সাধারণ মানুষের দিক থেকে মুখ ঘুরিয়ে রাখবে। বণিক পরিবেষ্টিত সরকার কাদের মাথায় ছাতা ধরে তা তো জনগণের কাছে স্পষ্ট। করোনাকালের প্রথম দিকের কথা কি ভুলে গেছে সবাই?

স্বাস্থ্যবিধি মানতে অল্পসংখ্যক যাত্রী উঠাতে হবে বাসে। পোষাবে না বলে মালিকপক্ষ চাপ সৃষ্টি করল। কোনো রিভিউ না করে রাতারাতি সরকার দাবিকৃত ৬০ শতাংশ মূল্যবৃদ্ধি করে দিল। আবার ঘাড় পেতে দিতে হলো সাধারণ মানুষকে। এখন জীবনযাত্রা অনেকটা স্বাভাবিক হয়েছে। স্বাস্থ্যবিধি সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে বসে-দাঁড়িয়ে গাদাগাদি করে যাত্রী নেওয়া হচ্ছে, তাহলে এখন ভাড়া সমন্বয় কোথায়! বণিক স্বার্থ জনগণের কষ্ট নিয়ে কখনো ভাবে না। তাদের লক্ষ্য মুনাফা। কিন্তু সাধারণ মানুষকে রক্ষা করার দায়িত্ব তো থাকে সরকারের। আমরা কিন্তু এখনো বাসভাড়া পুনঃসমন্বয় করার কোনো উদ্যোগ সরকার পক্ষ থেকে নিতে দেখিনি।

আমার এক আত্মীয়-সরকারি চাকরি করা মধ্যবিত্ত। সেদিন আচমকা আমাকে বললেন, আপনি আপনার লেখায় জানিয়ে দেন আমার স্ত্রী আর সংসার পরিচালনা করার দায়িত্ব নিতে চাইছেন না, এখন আমার সংসার চালানোর দায়িত্বটা যাতে সরকার নেয়।

বিষয়টি খোলাসা করলেন। তার চারজনের সংসার। সাকুল্যে বেতন পান ৪০ হাজার টাকা। এ থেকে মাস পয়লা স্ত্রীর হাতে ৩০ হাজার টাকা তুলে দেন। তা দিয়ে সুনিপুণা গৃহিণী ছেলেমেয়ের লেখাপড়া থেকে শুরু করে সংসারের যাবতীয় খরচ চালিয়ে আসছেন। খুব যে স্বাচ্ছন্দ্যে আছেন তা নয়, তবে চলে যাচ্ছে। গত কয়েক মাস ধরে গৃহিণী মাসের বাজার করে এসে হাহুতাশ করছেন। ক্রমাগত দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধিতে তিনি দিশেহারা।

খাবারের মান কমিয়েও ‘সমন্বয়’ করতে পারছেন না। এ মাসে এসে ধপাস করে বসে পড়লেন। বললেন, কমপক্ষে পাঁচ হাজার টাকা না বাড়ালে সংসার চালানো যাবে না। আমার পক্ষে আর সংসার চালানো সম্ভব না। হয় এবার থেকে তুমি সংসার চালাও, না হলে সরকারকে বল আমার সংসারের দায়িত্ব নিতে।

সুশাসন ও গণতান্ত্রিক ধারায় দেশ চললে সরকারকেই অপ্রত্যক্ষভাবে জনগণের সংসার চালানোর দায়িত্ব নিতে হতো; কিন্তু আমাদের দেশের সরকারগুলোর সম্ভবত সাধারণ মানুষের প্রতি তেমন একটা দায়-দায়িত্ব নেই। তারা জনগণকে দাবার ঘুঁটির মতো ব্যবহার করে। নিজেদের চাপমুক্ত রাখতে কেবল তেলা মাথায় তেল দিতে থাকে। কিন্তু আমার ভাবনা, এভাবে কতক্ষণ উটপাখির মতো বালুতে মুখ গুঁজে ভালো থাকা যায়! সরকারি বিধায়করা সৌভাগ্য মনে করলেও আমি মনে করি, সরকারের দুর্ভাগ্য যে তাদের রাজনীতির সামনে প্রতিপক্ষের শক্ত চ্যালেঞ্জ নেই।

আদর্শিক রাজনীতিবিচ্ছিন্ন প্রায় অথর্ব বিরোধী রাজনীতিকদের শুধু তর্জন-গর্জনই সার। মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দেওয়া আওয়ামী লীগের মতো একটি শক্ত শেকড়ের রাজনৈতিক দল যেখানে আদর্শিক রাজনীতি থেকে সরে গিয়ে হালভাঙা নৌকার দশায়, সেখানে ভুঁইফোড় এলিট দল কতদূর এগোতে পারবে? তাই মাঝে মাঝে নিজেদের গায়ে মুক্তিযুদ্ধের পারফিউম ছড়াতে নানা কসরত করে। আভিজাত্যের পোশাক জড়াতে চায় গায়ে।

আওয়ামী লীগের ভুল নীতি ও ব্যর্থতায় ক্ষুব্ধ সাধারণ মানুষের একটি উল্লেখযোগ্য অংশের সমর্থন জিয়াউর রহমান নিতে পেরেছিলেন ঠিকই। বিএনপি দলটিকে বড়ও করেছিলেন। কিন্তু এ কথাও সত্য, কপটতার ভেতর আদর্শ তৈরি হতে পারে না। জিয়াউর রহমান-উত্তর বিএনপি যতই সরকার গঠন করুক না কেন, আদর্শিক রাজনীতি না থাকায় দলছুট নেতাদের পক্ষে দলের মূল মাটির গভীরে প্রথিত করা সম্ভব হয়নি। বরঞ্চ নানা কলঙ্ক গায়ে মাখতে হয়েছে। এ ধারায় এবং বর্তমানে দৃশ্যমান নেতাদের নেতৃত্বে এ দলটি যে ঘুরে দাঁড়াতে পারবে তেমন মনে হয় না। তবে ক্রমাগত ভুলে আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব যদি সুযোগ করে দেয় তো অন্য কথা।

বিএনপির দশা দেখেও আওয়ামী লীগ নেতাদের শেখার আছে। জনবিচ্ছিন্ন হয়ে শুধু কথার ফুলঝুরিতে এবং ঐতিহ্যের গল্প শুনিয়ে সাধারণ মানুষকে কষ্ট থেকে বের করা যাবে না। দেশে অনেক দৃশ্যমান উন্নয়ন হচ্ছে ঠিকই। এতে সরকারের গায়ে নিশ্চয়ই কয়েকটি সোনালি পালক যুক্ত হবে। কিন্তু এ কথা ভুললে চলবে না, যাপিত জীবনে সাধারণ মানুষের কষ্ট এসব উন্নয়ন দিয়ে ঢেকে ফেলা সম্ভব নয়। এভাবেই যদি চলতে থাকে, তখন এ প্রশ্নটিই সামনে আসবে, এ দেশের সাধারণ মানুষকে রক্ষার দায়িত্ব আসলে কার?

ড. এ কে এম শাহনাওয়াজ : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়