কপ-২৬: বেঁচে থাকল ১.৫ ডিগ্রির লক্ষ্য
পোস্ট ডেস্ক :
শেষ পর্যন্ত কেমন হলো গ্লাসগো জলবায়ু সম্মেলন? তরুণ সুইডিশ তারকা জলবায়ুকর্মী গ্রেটা থুনবার্গের ভাষায়, ‘ব্লা ব্লা ব্লা’। বাংলাদেশ সময় গত শনিবার দিবাগত রাত পৌনে ২টায় ১৯৭টি দেশের প্রতিনিধিদের সর্বসম্মতিতে গ্লাসগো জলবায়ু চুক্তি গৃহীত হওয়ার পর টুইটারে এভাবেই প্রতিক্রিয়া জানান গ্রেটা। তাঁর কাছে ‘সঠিক রাস্তায় ছোট পদক্ষেপ’, ‘কিছু উন্নতি হয়েছে’, ‘ধীরে ধীরে জেতা’—এগুলো হেরে যাওয়ারই নামান্তর। কারণ জলবায়ু সংকট থেকে উত্তরণে বৈপ্লবিক পরিবর্তন দরকার, এখনই।
তাহলে কপ-২৬ কি ব্যর্থ?
আসলে গ্লাসগো সম্মেলন সফল না ব্যর্থ, তা এককথায় বলা মুশকিল। কপের মূল লক্ষ্য ছিল তাপমাত্রা বৃদ্ধি ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে সীমিত রাখার আশা বাঁচিয়ে রাখা, সে উদ্দেশ্য সফল। কিন্তু খোদ কপ প্রেসিডেন্ট অলোক শর্মার ভাষায়, ‘আমরা ১.৫ ডিগ্রির লক্ষ্যমাত্রার আশা বাঁচিয়ে রেখেছি, কিন্তু এর নাড়ি বড়ই দুর্বল।’ আর যুক্তরাষ্ট্রের জলবায়ু দূত জন কেরির ভাষায়, ‘গ্লাসগো সম্মেলন জলবায়ু সংকট কোনোভাবে দূর করে ফেলবে—এমনটা হওয়া প্রায় অসম্ভব ছিল। কিন্তু বন্দুক থেকে প্রথম গুলিটি বের হয়েছে।’
তবে ২০১৫ সালের ঐতিহাসিক প্যারিস চুক্তির পর এবারই এমন কিছু দৃশ্যমান অগ্রগতি হয়েছে, যা আগে কখনো দেখা যায়নি। কপ-২৬-এর আগমুহূর্তে জলবায়ুবিষয়ক আন্তঃরাষ্ট্রীয় প্যানেল (আইপিসিসি—ইন্টারগভর্নমেন্টাল প্যানেল অন ক্লাইমেট চেঞ্জ) ও ইন্টারন্যাশনাল এনার্জি এজেন্সি (আইইএ) জোর দিয়ে বলেছিল, ব্যাপকহারে কার্বন নিঃসরণ কমাতে দেশগুলোকে নতুন ও উচ্চাভিলাষী পরিকল্পনা হাতে নিতে হবে। কপে কিছুটা হলেও তার প্রতিফলন দেখা গেছে। প্রধান কার্বন নিঃসরণকারী দেশগুলোকে আগামী ১২ মাসের মধ্যে নতুন পরিকল্পনা জমা দিতে হবে। জাতিসংঘকে ব্যাখ্যা করে বোঝাতে হবে তাদের নীতি ও পরিকল্পনা কীভাবে প্যারিস চুক্তির লক্ষ্য পূরণ করবে।
‘ফেজ আউট’ থেকে ‘ফেজ ডাউন’
কয়লাসহ সব জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার বিশ্বজুড়ে কার্বন নিঃসরণের প্রধান কারণ। তার পরও বিভিন্ন দেশের প্রধান জ্বালানি হলো কয়লা, এর অন্যতম হলো চীন ও ভারত। ভারতের প্রায় ৭০ শতাংশ বিদ্যুত্ই আসে কয়লা থেকে, চীনের প্রায় ৬০ শতাংশ। গ্লাসগো চুক্তির সফলতা এখানেই যে, প্রথমবারের মতো কপ চুক্তিতে কার্বনের প্রধান উৎস কয়লার কথা উল্লেখ করা হয়েছে, ‘ঐতিহাসিক’ প্যারিস চুক্তিতেও যার উল্লেখ নেই। গ্লাসগো চুক্তির তৃতীয় খসড়ায় দেশগুলোকে পর্যায়ক্রমে কয়লার ব্যবহার বন্ধ করে আনার
আহ্বান করা হয়েছিল (ফেজ আউট), কিন্তু ভারত ও চীনের শেষ মুহূর্তের বিরোধিতায় কয়লার ব্যবহার কমিয়ে আনার (ফেজ ডাউন) সিদ্ধান্ত হয়। এতে চরম হতাশা প্রকাশ করে মার্শাল আইল্যান্ড, টুভালু, মালদ্বীপ প্রভৃতি দ্বীপরাষ্ট্র, যারা এখনই জলবায়ু পরিবর্তনের ভয়াবহ প্রভাবগুলোর সঙ্গে নিয়মিত লড়াই করে যাচ্ছে। আবেগ সামলাতে পারেননি খোদ অলোক শর্মা। তিনি সবার কাছে গভীরভাবে দুঃখ প্রকাশ করেন দর-কষাকষির এ পর্যায়ে আসার জন্য। তবে গোটা চুক্তিকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য তিনি আবেদন জানান সব দেশের কাছে। উন্নয়নশীল ও জলবায়ু দুর্যোগপ্রবণ দেশগুলো নতুন করে আর আপত্তি না তুললেও তারা স্পষ্টতই অখুশি। কয়লার ব্যবহার বন্ধ করতে চুক্তির ধারাটিতে পানি ঢেলে দেওয়ায় হতাশা জানায় ছোট দ্বীপরাষ্ট্রগুলো ছাড়াও সুইজারল্যান্ড, মেক্সিকো ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন।
মালদ্বীপের পরিবেশমন্ত্রী শনা অমিনাথ চূড়ান্ত অধিবেশনে বলেন, ‘আমরা জানি জীবাশ্ম জ্বালানির পেছনে ট্রিলিয়ন ডলার খরচ হচ্ছে। আমরা জানি প্রযুক্তি আছে। তার মানে অর্থ বা প্রযুক্তি, কোনোটারই অভাব নেই। আমাদের হাতে মাত্র ৯৮ মাস সময় আছে বৈশ্বিক নিঃসরণ অর্ধেক করার। ১.৫ ডিগ্রি ও ২ ডিগ্রির পার্থক্য আমাদের কাছে মৃত্যুদণ্ডের সমান।’
ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য সাহায্য এলো না
জলবায়ু সংকট কোনো ভবিষ্যতের বিষয় নয়, এটা রীতিমতো চলমান ঘটনা। প্রশান্ত মহাসাগরের মাঝে মার্শাল দ্বীপপুঞ্জ এরই মধ্যে লড়াই করছে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির সঙ্গে, একই কথা প্রযোজ্য প্রতিবেশী মালদ্বীপের ক্ষেত্রে। প্রতিবছর বাংলাদেশের বন্যা আরো শক্তিশালী রূপ নিয়ে আসছে, ঘূর্ণিঝড়গুলো আরো প্রলয়ংকরী রূপ নিয়ে ফিরে ফিরে আসছে। আর কপ-২৬ ব্যর্থ এখানেই। নির্গমন কমানোর ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি থাকলেও জলবায়ু দুর্যোগপ্রবণ এসব দেশকে আর্থিক সহায়তা দিতে তহবিল গঠনে ব্যর্থ কপ। দুর্যোগের সঙ্গে লড়াই করতে দরিদ্রতম দেশগুলোর জন্য তহবিল গঠন করতে রাজি হয়নি ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও যুক্তরাষ্ট্র। যেখানে কভিড মহামারির আঘাতে বিশ্বের প্রতিটি দেশ কমবেশি জর্জরিত, সেখানে জীবন বাঁচানোর এক বৈশ্বিক সংহতি গ্লাসগোতে দেখা যাবে, এমন আশা ছিল অনেকের। সন্দেহ নেই, তাঁরা হতাশ হয়েছেন।
তবে কপ-২৬-এর প্রকৃত পরীক্ষা এখনো বাকি থেকে গেল, আগামী ১২ মাস খুব গুরুত্বপূর্ণ। দেখতে হবে দেশগুলো ১.৫ ডিগ্রির লক্ষ্যমাত্রার সঙ্গে সংগতি রেখে কার্বন নিঃসরণ কমানোর নতুন পরিকল্পনা দেয় কি না। নতুন এসব পরিকল্পনার লক্ষ্য হতে হবে ২০৩০ সালের মধ্যে অন্তত ৪৫ শতাংশ কার্বন নিঃসরণ কমানো।
যেখানে অগ্রগতি হলো
বেশ কিছু জায়গায় গ্লাসগো সম্মেলন অগ্রগতি দেখেছে, যার অন্যতম হলো প্যারিস চুক্তি অনুসারে ২০২৪ সালের মধ্যে সব দেশ তাদের নিঃসরণসংক্রান্ত বিশদ তথ্য জাতিসংঘকে জমা দেবে। এতে করে ভবিষ্যতের নিঃসরণের গতিবিধি এবং কমানোর উপায় পর্যালোচনা করা যাবে। কার্বন মার্কেট নিয়ে বেশ অগ্রগতি আছে, বিশেষত দেশগুলো নিজেদের মধ্যে কীভাবে কাঠামোগত বাণিজ্য এগিয়ে নিয়ে যাবে, তা বেশ স্পষ্ট হয়েছে। তবে অনেকেই একে এখনো অপ্রতুল বলছেন।
কপ-২৬-এর আরেকটি সফলতা হলো ২০২৫ সাল নাগাদ উন্নত দেশগুলো অভিযোজন তহবিলের অর্থ ২০১৯ সালের তুলনায় দ্বিগুণ করতে রাজি হয়েছে। যদিও দরিদ্র দেশগুলোর যে পরিমাণ অর্থ অভিযোজনের জন্য দরকার, তা এর মাধ্যমে পূরণ হবে না। কিন্তু এটা বেশ বড় সাফল্য এ জন্যই যে জলবায়ু অর্থায়নের মাত্র চার ভাগের এক ভাগ এখনো পর্যন্ত অভিযোজন খাতে যায়, আর বাকিটা প্রশমনের জন্য ব্যবহৃত হয়।
খাতওয়ারি বেশ কিছু চুক্তি হয়েছে। এর মধ্যে বন উজাড় বন্ধ, কয়লা থেকে সরে গিয়ে নবায়নযোগ্য শক্তিতে বিনিয়োগ, বিদ্যুত্চালিত গাড়ির ব্যবহার বাড়ানো, মিথেন নিঃসরণ কমানো এবং জীবাশ্ম জ্বালানিতে প্রায় ২৪ বিলিয়ন ডলারের সরকারি অর্থায়ন বন্ধের ঘোষণা নিশ্চিতভাবে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ কার্বন নিঃসরণ কমাবে। তবে তা নির্ভর করছে সরকারগুলো প্রতিশ্রুতি রাখবে কি না, তার ওপর। যদি সরকারগুলো নিজ দেশে নতুন আইন, নীতি ও পরিকল্পনার মাধ্যমে এসব সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করে এবং আগামী বছর মিসরে অনুষ্ঠেয় কপ-২৭-এ উপস্থাপন করে, তাহলেই বোঝা যাবে আসলেই কতটা সাফল্য পেয়েছে কপ-২৬।
পরিবেশবাদী সংগঠন গ্রিনপিসের নির্বাহী পরিচালক জেনিফার মরগান গ্লাসগো চুক্তির প্রতিক্রিয়ায় সাংবাদিকদের বলেন, ‘এটা একটা নমনীয়, দুর্বল চুক্তি। এটা কোনো মতে ১.৫ ডিগ্রির লক্ষ্যকে বাঁচিয়ে রেখেছে, তবে গুরুত্বপূর্ণ হলো কয়লার যুগ শেষ হয়ে আসার একটি সংকেত এতে আছে।’
যা একেবারেই হলো না
উন্নয়নশীল দেশগুলো চেয়েছিল জলবায়ু সংকটের ক্ষয়ক্ষতি নিয়ে নতুন একটি তহবিল এবং তা বাস্তবায়নের সুস্পষ্ট পরিকল্পনা। স্বভাবতই পরবর্তী কপে চোখ থাকবে ক্ষয়ক্ষতি তহবিলের অগ্রগতি কেমন হয় তার ওপর। আন্তর্জাতিক চ্যারিটি সংগঠন ক্রিশ্চিয়ান এইডের তথ্য অনুসারে, আফ্রিকান দেশগুলো তাঁদের বার্ষিক জিডিপির ১০ শতাংশ খরচ করে জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে অভিযোজনের জন্য। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত দুর্যোগের সঙ্গে মোকাবেলা করতে তাদের বার্ষিক জিডিপির ২০ শতাংশ পর্যন্ত খরচ হতে পারে।
প্যারিস চুক্তির অন্যতম রূপকার ও অর্থনীতিবিদ লরেন্স টুবিয়ানা কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘জলবায়ু পরিবর্তনে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্তদের দাবি আমাদের অবশ্যই মেটাতে হবে। যারা এরই মধ্যে ভোগান্তিতে রয়েছে, তাদের সাহায্য করতে এই কপ ব্যর্থ। আমাদের অবশ্যই পরবর্তী কপে ক্ষয়ক্ষতি তহবিলের বিষয়টি চূড়ান্ত করতে হবে।’
এখনো অনেক পথ বাকি
আন্তর্জাতিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ক্লাইমেট অ্যাকশন ট্র্যাকারের মতে, কপ-২৬-এ যেসব চুক্তি হলো সেগুলো বাস্তবায়ন হলে ১.৫ ডিগ্রির পথে আমরা ৯ শতাংশ এগোব, অর্থাৎপ্রায় ২.২ গিগাটন কার্বন ডাই-অক্সাইড নিঃসরণ কমবে। তবে তা অবশ্যই যথেষ্ট নয়। লন্ডনভিত্তিক পরামর্শক প্রতিষ্ঠান সিসটেমিকের মতে, নতুন করে কার্বন-হেভি শিল্পে বিনিয়োগ করা এই সময়ে প্রায় অর্থহীন। বিনিয়োগকারীরাও আর এ ধরনের শিল্পে বিনিয়োগে আগ্রহী নয়, তারা এখন প্রতিযোগিতামূলক সবুজ ও পরিচ্ছন্ন প্রযুক্তিতে বিনিয়োগে আগ্রহী। বল এখন সরকারগুলোর কোর্টে। তাদের নীতি প্রণয়ন, কর্মকাণ্ড, প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন ও সর্বোপরি সদিচ্ছার ওপর নির্ভর করছে ১.৫ ডিগ্রির লক্ষ্য অর্জন করা সম্ভব হবে কি না।
গ্লাসগো সম্মেলন শেষে জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস এক বিবৃতিতে বলেছেন, ‘সাফল্য বা ব্যর্থতা প্রাকৃতিক বিষয় নয়। এটা আমাদের হাতে। উন্নতির পথ সব সময় সোজা হয় না, মাঝেমধ্যে ভিন্ন পথে যেতে হয়, খানাখন্দে পড়তে হয়।’ খ্যাতনামা স্কটিশ সাহিত্যিক রবার্ট লুইস স্টিভেনসনের ভাষায়, ‘কেমন ফসল এলো তা নিয়ে প্রতিটি দিন বিচার করা যায় না, বরং বিচার করতে হয় কেমন বীজ বপন করা হলো, তা দিয়ে। আমাদের ভবিষ্যতে আরো অনেক বীজ বপন করতে হবে। এক দিনে বা এক সম্মেলনে লক্ষ্যে পৌঁছানো যাবে না। কিন্তু আমি জানি, আমরা পারব। আমরা কখনো হাল ছাড়ব না, হেরে যাব না, সামনে এগিয়ে যাব। কপ-২৭ আজ থেকে শুরু।’