কাবার গিলাফের ক্যালিগ্রাফার বাংলাদেশের মুখতার এখন সৌদি নাগরিক
পোস্ট ডেস্ক :
বিভিন্ন পেশার দক্ষ বিদেশি নাগরিকদের সৌদি আরবে নাগরিকত্ব দেওয়ার ঘোষণার পর প্রথম দিনেই নাগরিকত্ব পেয়েছেন প্রবাসী বাংলাদেশি শায়খ মুখতার আলম শিকদার। মক্কার পবিত্র কাবাঘরের গিলাফ (কিসওয়াহ) প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠানে দীর্ঘ ২০ বছর ধরে প্রধান ক্যালিগ্রাফার হিসেবে কাজ করছেন তিনি।
গত বৃহস্পতিবার (১১ নভেম্বর) সৌদি বাদশাহ সালমান বিন আবদুল আজিজের এক রাজকীয় নির্দেশনায় বিভিন্ন পেশার বিশিষ্ট ব্যক্তিদেরকে নাগরিকত্ব দেওয়ার কথা জানানো হয়। এদের মধ্যে প্রথম দিন ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব, ইতিহাসবিদ, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ও চিকিৎসক, বিনিয়োগকারক, প্রযুক্তিবিদ, ক্রীড়াবিদসহ পাঁচ বিদেশি নাগরিক আছেন। সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান ঘোষিত ‘ভিশন-২০৩০’-এর অংশ হিসেবে বিভিন্ন পেশার দক্ষ বিদেশিদের নাগরিকত্ব দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় সৌদি সরকার।
সৌদি গেজেট থেকে জানা যায়, প্রথম দিনের ঘোষণায় নাগরিকত্ব পাওয়া বিশিষ্ট ব্যক্তিদের মধ্যে আছেন, পবিত্র কাবার গিলাফের (কিসওয়া) প্রধান ক্যালিগ্রাফার মুখতার আলিম, ইতিহাসবিদ ড. আমিন সিদো ও ড. আবদুল করিম আল সামমাক, প্রখ্যাত গবেষক ড. মুহাম্মদ আল বাকাই এবং প্রখ্যাত নাট্যশিল্পী সামান আল আনি।
বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত শায়খ মুখতার আলমের নাগরিকত্ব লাভ উপলক্ষে মক্কা-মদিনার পবিত্র দুই মসজিদের পরিচালনা পর্ষদের প্রধান শায়খ ড. আবদুর রহমান আল-সুদাইস তাঁকে উষ্ণ অভ্যর্থনা ও অভিনন্দন জানান। সাক্ষাতকালে শায়খ সুদাইস তাঁকে আরবি ক্যালিগ্রাফির বিষয়ক অ্যাকাডেমিক পাঠদান ও পবিত্র কাবার গিলাফের ক্যালিগ্রাফারদের জন্য একটি ইনস্টিটিউট গঠনের অনুরোধ জানান।
প্রতিবেদনে মুখতার আলমের পরিচয়ে বলা হয়, মুখতার আলম বর্তমানে মক্কার পবিত্র কাবার গিলাফ (কিসওয়া) তৈরির কারখানায় প্রধান ক্যালিগ্রাফার হিসেবে কাজ করছেন। সৌদি আরব ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন প্রদর্শনীতে তাঁর প্রধান ক্যালিগ্রাফিগুলো প্রদর্শিত হয়েছে। ক্যালিগ্রাফি বিষয়ক বিভিন্ন প্রশিক্ষণে তিনি গুরুত্বপূর্ণ পাঠদান করেন। মক্কার পবিত্র মসজিদুল হারাম পরিচালিত প্রতিষ্ঠানে ক্যালিগ্রাফি বিষয়ক তার পাঠ শোখানো হয়।
মুখতার আলম মক্কার বিখ্যাত উম্মুল কোরা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা সম্পন্ন করে বর্তমানে পিএইচডি গবেষণা করছেন। এক সময় তিনি একই বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেছেন এবং ডিপ্লোমা, স্নাতকোত্তর ও পিএইচডি ডিগ্রিধারীদের সার্টিফিকেটের ক্যালিগ্রাফার হিসেবেও কাজ করেছেন। এ ছাড়া বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা থেকে অসংখ্য পুরস্কার ও প্রশংসা সনদ পেয়েছেন তিনি।
শৈশব থেকেই ক্যালিগ্রাফির প্রতি আগ্রহী ছিলেন শায়খ মুখতার। তৃতীয় শ্রেণি পড়ার সময় থেকে এর চর্চা শুরু করেন । এমনকি চতুর্থ শ্রেণিতে পড়া অবস্থায় তিনি অন্যদের ক্যালিগ্রাফি শেখাতেন। তা ছাড়া সেই ছোটবেলা থেকেই বিভিন্ন স্থানে ক্যালিগ্রাফি শেখাতেন ও ক্লাস করাতেন। জীবনের দীর্ঘ ২০ বছর ক্যালিগ্রাফি পেশায় যুক্ত থেকে অবশেষে পবিত্র কাবার গিলাফ প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠানের প্রধান ক্যালিগ্রাফি হিসেবে নিযুক্ত হন এবং সেখানেও ইতিমধ্যে ২০ বছর কাটিয়েছেন।
শায়খ মুখতার আলম জানান, ১৩৮৭ হিজরি (১৯৬৭ সাল) তিনি সৌদি আরব আসেন। শৈশবের সময় তিনি পবিত্র মসজিদুল হারামের প্রাঙ্গণে কাটিয়েছেন। এখানেই তিনি মাত্র ৯ মাসে পবিত্র কোরআন হিফজ সম্পন্ন করেন। একদিন তাঁর এক বন্ধু বলল, তুমি খুবই মেধাবি। অল্প সময়ে কোরআন হিফজ করেছ। তুমি তো হস্তলিপি শেখার মজলিসে বসতে পার। তাহলে অল্প সময়েও অনেক ভালো করবে। এরপর থেকে তিনি নিয়মিত মসজিদুল হারামের হস্তলিপি সুন্দর করার বিভিন্ন মজলিসে অংশগ্রহণ শুরু করেন। আর ধীরে ধীরে ক্যালিগ্রাফি শিল্পচর্চায় এগিয়ে যান।
কিং আবদুল আজিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. আবু উমর ফারুক আহমদ জানান, শায়খ মুখতার আলম শিকদার ১৯৬২ সালে চট্টগ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার পৈত্রিক বাড়ি চট্টগ্রামের লোহাগাড়া উপজেলার আধুনগর ইউনিয়নের রশীদের ঘোনা গ্রামে। ১৩৯৮ হিজরি সনে তিনি পবিত্র কোরআন হিফজ সম্পন্ন করেন। ১৪১৩ হিজরি তিনি মক্কার উম্মুল কুরা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিল্পকলা বিষয়ে স্নাতক করেন। ১৪২২ হিজরি তিনি স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন। ১৪১৬ সাল থেকে তিনি একই বিশ্ববিদ্যালয়ে শিল্পকলা বিষয়ে শিক্ষকতা করেন। ১৪২৩ হিজরি থেকে তিনি পবিত্র কাবাঘরের গিলাফ (কিসওয়াহ) প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠানে কাজ করছেন। আরবি ক্যালিগ্রাফি পেশায় তিনি দীর্ঘ ৪০ বছর যাবৎ কাজ করছেন।
মুখতারের বাবার নাম মুফিজুর রহমান বিন ইসমাঈল শিকদার। মায়ের নাম শিরিন বেগম। তার বাবা কর্মজীবনের শুরুতে কিছুদিন ঐতিহ্যবাহী চুনতি হাকীমিয়া আলিয়া মাদরাসার শিক্ষক ছিলেন। পরবর্তীকালে তিনি সৌদি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনে ফার্মাসিস্ট হিসেবে বিভিন্ন হাসপাতালে দীর্ঘকাল দায়িত্ব পালন করেন। ২০১৮ সালে বাংলাদেশে তিনি মারা যান। মূলত বাবার কর্মসূত্রে পরিবারের সদস্যরা দীর্ঘ সময় সৌদিতে আছেন। বর্তমানে শায়খ মুখতার তার মা, স্ত্রী ও চার মেয়েকে নিয়ে মক্কায় বসবাস করেন। মুখতারের চার ভাই ও এক বোন।