বাংলাদেশের রাজনীতির উত্থান-পতন ও বর্তমান ধারা

Published: 15 November 2021

।। মোনায়েম সরকার ।।

বর্তমান বিশ্বব্যবস্থায় ‘গণতন্ত্র’ই সর্বাধিক প্রিয়। গণতন্ত্র চায় না বা গণতন্ত্রের জন্য লড়াই করছে না এ রকম দেশের সংখ্যা সারা পৃথিবীতেই নগণ্য। গণতন্ত্র ছাড়া আধুনিক জীবন অকল্পনীয়, মানুষের জীবনকে সুন্দর ও স্বাভাবিকভাবে বিকশিত করার জন্য গণতন্ত্রের বিকল্প নেই। সমাজতন্ত্রের প্রতি শ্রদ্ধা রেখেই বলছি-যতদিন না সাম্যবাদ পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে, ততদিন গণতন্ত্রের অগ্রযাত্রাকে কোনো রাজনৈতিক মতবাদই রুখতে পারবে না।
আমি বাংলাদেশের বিকাশমান গণতন্ত্রের একটা সংক্ষিপ্ত চিত্র তুলে ধরার চেষ্টা করছি। তাই গণতন্ত্রের বৈশ্বিক অবস্থা নিয়ে কথা না বলে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ইতিহাসের বৃত্তেই সীমাবদ্ধ থাকতে চাই। বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষই বিশ্বাস করে, বাংলাদেশের জনগণের ভালো-মন্দ, সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্নার সঙ্গে আওয়ামী লীগের অস্তিত্ব ওতপ্রোতভাবে জড়িত। আওয়ামী লীগের মূল প্রোথিত রয়েছে এদেশের স্বাধীনতাপ্রিয়, মুক্তিকামী জনতার মধ্যে, এদেশের উর্বর মাটির পরতে পরতে। আওয়ামী লীগ পাকিস্তানের সাম্প্রদায়িক ভাবধারার কু-প্রভাব থেকে বাঙালি জাতিকে রক্ষা করে বাঙালি জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে একটি নতুন ভাবাদর্শ সৃষ্টি করেছিল। সেই ভাবাদর্শের নাম হলো-গণতন্ত্র, অসাম্প্রদায়িকতা, দেশপ্রেম, বাঙালি জাতীয়তাবাদ। এ ভাবাদর্শের সাহায্যেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর কবল থেকে উদ্ধার করে বাঙালি জাতিকে গণতান্ত্রিক চেতনায় সমৃদ্ধ ও সমুন্নত করেছেন।
এ দেশের রাজনৈতিক ইতিহাস যারা জানেন, তারা নিশ্চয়ই মনে করতে পারেন, পঁচাত্তরে বঙ্গবন্ধু হত্যা-পরবর্তী জিয়া সরকার ছিল অবৈধ। এ অবৈধ সরকার সারা দেশে সৃষ্টি করে এক দুর্বিষহ আতঙ্ক। তার সীমাহীন নির্যাতনে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী দ্বারা জেলখানা ভরে যায়। কেউ কেউ চলে যান আন্ডারগ্রাউন্ডে। আন্ডারগ্রাউন্ডেও যখন সাঁড়াশি অভিযান চালানো হয়, তখন তারা বাধ্য হয় হাতের মুঠোয় জীবন নিয়ে দেশত্যাগ করতে। জিয়ার শাসনামলে প্রতি রাতে দেশে ‘কারফিউ’ থাকত। জনজীবন ছিল চরম অনিরাপত্তার ভেতর। সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে জিয়া বাংলাদেশে যে কালো আইন তৈরি করে এবং মুজিব হত্যাকাণ্ডের বৈধতাদান করে ঘাতকদের পুরস্কৃত করে, তাতেই কি জিয়ার নির্দয় একনায়কের পরিচয় বহন করে না?
১৯৭০ সালের প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনে জনগণের প্রিয়দল আওয়ামী লীগ পায় ২৮৮ আসন, ১৯৭৩ সালে আওয়ামী লীগ পায় ২৯৩ আসন। ১৯৭৯ সালের নির্বাচনে জেনারেল জিয়া প্রতিষ্ঠিত বিএনপি পায় ২০৭ আসন এবং আওয়ামী লীগ পায় ৩৯ আসন। এটি বৈধ নির্বাচনের ফলাফলের নমুনা? গণতান্ত্রিক বাংলাদেশে জিয়া প্রথম নজিরবিহীন হ্যাঁ/না ভোট প্রচলন করেন আইয়ুব-ইয়াহিয়ার পদাঙ্ক অনুসরণ করে।
১৯৮৬ সালে এরশাদের শাসনামলে যে নির্বাচন হয়, সেই নির্বাচন বিএনপি ষড়যন্ত্রমূলকভাবে সরে দাঁড়ায় এবং খালেদা জিয়া তথাকথিত আপসহীন নেত্রীতে পরিণত হন। এ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিজয়কে ঠেকাতে ৪৮ ঘণ্টা মিডিয়া ক্যু করে জাতীয় পার্টি নির্বাচনের ফলাফল উলটে দেয়। এ নির্বাচনে জাতীয় পার্টি পায় ১৫৩ আসন, ভোট পায় ৪২ দশমিক ১৫ শতাংশ। মিডিয়া ক্যু না হলে নির্বাচনের ফলাফল আওয়ামী লীগের পক্ষেই যেত। ১৯৮৮ সালে আবার এরশাদের অধীনে নীলনকশার নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি কেউই অংশ নেয়নি। এ নির্বাচনে জাতীয় পার্টি ২৫১ আসন, ফ্রিডম পার্টি তথা কিলার পার্টি পায় দুটি আসন আর আ স ম আবদুর রব ১৯ আসন পেয়ে বিরোধীদলীয় নেতা হন।
১৯৯১ সালে সব রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণের মাধ্যমে যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়, তাতে বিএনপি পায় ১৪০, আওয়ামী লীগ ৮৮ এবং জাতীয় পার্টি পায় ৩৫ আসন। এ নির্বাচনের ভোটের সংখ্যা বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, বিএনপির বাক্সে পড়ে ৩০ দশমিক ৮১ শতাংশ ভোট আর আওয়ামী লীগ পায় ৩৩ শতাংশ ভোট, জাতীয় পার্টি পায় ১১ দশমিক ৯২ শতাংশ ভোট। জামায়াত পায় ১৮ আসন। জামায়াত-বিএনপির সিট অ্যালাইন্সের ফলে বিএনপি ১৯৯১ সালে অপ্রত্যাশিতভাবে সরকার গঠন করে।
১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি আবার গণতন্ত্র হুমকির মুখে পড়ে। খালেদা জিয়া ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য নিজের অধীনে আয়োজন করেন ষড়যন্ত্রের নির্বাচন। এ নির্বাচনে বিএনপি পায় ২৭৮ আসন, ফ্রিডম পার্টি পায় একটি এবং স্বতন্ত্র ১০ আসন। কিন্তু খালেদা জিয়া গণআন্দোলনের মুখে শেষ রক্ষা করতে পারলেন না। ১৯৯৬ সালের জুন মাসে তিনি নির্দলীয়-নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অবাধ-সুষ্ঠু নির্বাচন দিতে বাধ্য হন। এ নির্বাচনেই আওয়ামী লীগ ১৪৬ আসন পেয়ে একুশ বছর পর অর্থাৎ পঁচাত্তরের ১৫ আগস্টের পর ক্ষমতায় আসীন হয়। ২০০১ সালের নির্বাচনে বিএনপি পায় ১৯৩ আসন এবং ৪০ দশমিক ৮৬ শতাংশ ভোট, আওয়ামী লীগ পায় ৬২ আসন এবং ৪০ দশমিক ২১ শতাংশ ভোট। অর্থাৎ এ নির্বাচনে বিএনপি ও আওয়ামী লীগ প্রায় সমসংখ্যক ভোট পেলেও আসন সংখ্যায় বিএনপি এগিয়ে থাকে। এবারও জামায়াতকে সঙ্গে নিয়ে জামায়াতের ৪ দশমিক ২৯ শতাংশ ভোট নিয়ে এবং ১৭ আসন নিয়ে বিএনপি এগিয়ে যায়। ২০০১ সালের নির্বাচনে জয়লাভ করে বিএনপি আওয়ামী লীগকে নিশ্চিহ্ন করার নানামুখী ষড়যন্ত্র করে, রাজাকারদের মন্ত্রী বানায়, বাংলা ভাই সৃষ্টি করে এবং দেশজুড়ে জঙ্গিবাদের উত্থান ঘটায়। বিএনপির চক্রান্তে নিহত হতে থাকে আওয়ামী লীগের শত শত নেতাকর্মী।
বিএনপি ১৯৯১ সালে ক্ষমতায় এসে যেমন ক্ষমতা ছাড়তে চায়নি, তেমনি ২০০১ সালে ক্ষমতা পেয়েও তারা মেয়াদপূর্ণ করে ক্ষমতা ছাড়তে টালবাহনা শুরু করে। এরপর আবির্ভূত হয় সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার। তারাও দুই ডক্টর ও দুই সম্পাদকের কূটকৌশলে দুই বছর গণতন্ত্রকে জিম্মি করে রাখে। চেষ্টা চালাতে থাকে দুই নেত্রীকে মাইনাস করার। কিন্তু গণআন্দোলনের মুখে তারাও বাধ্য হয় ২০০৮ সালে অবাধ-সুষ্ঠু নির্বাচন দিতে। এ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ঐতিহাসিক বিজয় অর্জন করে এবং মুজিব ও মুক্তিযুদ্ধের আদর্শে বাংলাদেশকে গড়ে তোলার কাজে মনোনিবেশ করে। দেশে এখন সেই ধারাই অব্যাহত আছে। ওপরের বিশ্লেষণ থেকে একটি বিষয় প্রতীয়মান হয়েছে, যখনই বাংলাদেশে অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ নির্বাচন হয়েছে, তখনই আওয়ামী লীগ জয়ী হয়েছে। এ ধারা ১৯৭০ থেকে শুরু হয়ে আজও পর্যন্ত বিদ্যমান।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পরে দেশে নেমে আসে পাকিস্তানি কায়দায় সামরিক শাসনের ভয়াল দুর্যোগ। বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ নামক এগিয়ে চলা ট্রেনটি ডিরেইলড করে দেওয়া হয়। ২১ বছর খাদের কিনারে লাইনচ্যুত হয়ে পড়ে থাকে ট্রেনটি। জিয়াউর রহমান, যিনি ছিলেন শেখ মুজিব হত্যার অন্যতম বেনিফিশিয়ারি, তিনি দখল করে নেন স্বাধীন বাংলার ক্ষমতা। হত্যা করা হয় প্রাজ্ঞ রাজনীতিবিদ, মুজিবপ্রেমী বুদ্ধিজীবী, দেশপ্রেমিক সেনা অফিসারসহ অসংখ্য বেসামরিক মানুষ। বাকশাল গঠনের পর একটি জানাজায় জিয়া আমার কাছে বাকশালে যোগ দেওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন। যে জিয়া বঙ্গবন্ধুর জীবিত অবস্থায় বঙ্গবন্ধুকে ‘বঙ্গবন্ধু ও জাতির পিতা’ বলে মুখে ফেনা তুলতেন, সেই জিয়ার আমলেই দেখা যায়-বঙ্গবন্ধুর কথা লেখা যায় না, তার জন্য সভা করা যায় না, তার নামটা পর্যন্ত উচ্চারণ করা যায় না। অথচ কী অবাক কাণ্ড, জিয়াউর রহমানই নাকি বহুদলীয় গণতন্ত্রের প্রবক্তা? জিয়ার আমলে বাংলাদেশ হয়ে ওঠে স্বাধীন পূর্ব পাকিস্তান। জিয়া চিহ্নিত রাজাকারদের জেল থেকে মুক্ত করে, দেশ পলাতক রাজাকারদের নাগিরকত্ব দিয়ে দেশে ফিরিয়ে আনেন, তাদের রাজনীতি করার অধিকার ফিরিয়ে দেন, বঙ্গবন্ধুর হত্যার বিচার বন্ধে ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারি করেন এবং বাংলাদেশের মাটি থেকে আওয়ামী লীগকে চিরতরে ধ্বংস করার জন্য সব রকমের ষড়যন্ত্র অব্যাহত রাখেন। একজন ঘাতক যখন হয়ে উঠেন গণতন্ত্রের মুক্তিদাতা, তখন বুঝতে কারও বাকি থাকে না-তার প্রবর্তিত গণতন্ত্র কোনো গণতন্ত্রই নয়।
প্রকৃতপক্ষেই আওয়ামী লীগ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় আস্থাবান। তার প্রমাণ-২০০৮ সালের নির্বাচনে নির্বাচিত হয়ে আওয়ামী লীগ নির্ধারিত সময়ে ক্ষমতা শেষ করে সংলাপের মাধ্যমে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার জন্য বিএনপি নেত্রীকে টেলিফোনে আহ্বান জানালে বিএনপি নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া সে প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন। দেশকে সাংবিধানিক সংকট থেকে মুক্ত করতে অন্যান্য দল নিয়ে নির্বাচন করে আবার ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয় আওয়ামী লীগ। ক্ষমতায় আরোহণের এ বিষয়টিকে অনেকেই আজ বাঁকা চোখে দেখার চেষ্টা করেন; কিন্তু তারা কি হিসাব করে দেখেছেন, বাংলাদেশ আজ সার্বিকভাবে উন্নতির কোন শিখরে গিয়ে দাঁড়িয়েছে?
বাংলাদেশ এখন বিশ্বের বুকে উন্নয়নের রোল মডেল হলেও কয়েকটি বিষয়ে বর্তমান ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারকে নজর দিতে হবে। বাংলাদেশ রাষ্ট্রের স্থপতি বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষ ও স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর মাহেন্দ্রক্ষণে বঙ্গবন্ধুর প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে রচিত ১৯৭২ সালের সংবিধান পুনঃপ্রবর্তন করতে হবে। বাহাত্তরের সংবিধান প্রবর্তিত হলে ধর্মকে অপব্যবহার করে মৌলবাদীগোষ্ঠী সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট করতে পারবে না। সেই সঙ্গে দলের মধ্যে যেসব দুর্বৃত্ত আছে, তাদের বহিষ্কার করে সৎ ও যোগ্য নেতাদের মূল্যায়ন করা দরকার। ব্যবসায়ীদের বেশি প্রাধান্য না দিয়ে রাজনীতিতে রাজনীতিবিদদের জন্য সুযোগ সৃষ্টি করা দরকার। দুর্নীতিবাজদের দমন করে প্রজ্ঞাবান নেতাকর্মী আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে যুক্ত করা এখন সময়ের দাবি। কেন্দ্র থেকে তৃণমূল পর্যন্ত সর্বত্র গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া চলমান রাখতে হবে। যাতে একটি শক্তিশালী বিরোধী দল গড়ে ওঠে, সেই বিষয়েও লক্ষ রাখতে হবে। প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতে একসময় কংগ্রেস ও বামফ্রন্ট দীর্ঘদিন ক্ষমতায় ছিল। যুগের পর যুগ ক্ষমতায় থেকেও আজ তারা ক্ষমতার অনেক দূরে সরে গেছে। দল বেশি দিন ক্ষমতায় থাকলে দুর্নীতির দায়ে একসময় মুখ থুবড়ে পড়ে। এ বিষয়গুলো মাথায় রেখে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় আওয়ামী লীগ দেশের নেতৃত্ব দেবে, এটাই সবার প্রত্যাশা।