ইমাম মাহদির আগমন কেয়ামতের অন্যতম নিদর্শন

Published: 15 November 2021

।। নূর মুহাম্মদ রাহমানী ।।


পৃথিবতে এক সময় কেয়ামত ঘটবে। এ কেয়ামতের পূর্বে বহু ছোট-বড় নিদর্শন প্রকাশ পাবে। নিদর্শনগুলোর মধ্যে বড় একটি নিদর্শন হলো ইমাম মাহদির আবির্ভাব। তিনি একজন একনিষ্ঠ ও ন্যায়পরায়ণ ব্যক্তি যিনি মুসলমানদের খলিফা হবেন। মহানবী (সা.) থেকে প্রমাণিত ভবিষ্যদ্বাণীর আলোকে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের আকিদা-বিশ্বাস হলো শেষ জমানায় প্রতিশ্রুত ইমাম মাহদির আবির্ভাব সত্য। সাহাবী-তাবেয়ি থেকে নিয়ে এখন পর্যন্ত সব স্তরের সংখ্যাগরিষ্ঠ আলেম, ফকিহ ও হাদিসবিশারদগণ ইমাম মাহদির আবির্ভাব নিয়ে আলোচনা করেছেন।
মাহদি অর্থ সুপথপ্রাপ্ত। এটি কোনো নাম নয়; বরং এটি হলো ইমামের উপাধি। কেননা আল্লাহ তায়ালা হকের প্রতি তাকে পথপ্রদর্শন করবেন। তাঁর অপর আরেকটি উপাধি হবে ‘জাবের’। কারণ, তিনি উম্মতের মুহাম্মদির আহত অন্তরে মলম লাগানোর কাজ করবেন কিংবা তিনি জালেমদের ওপর বিজয়ী হয়ে তাদের প্রভাব-প্রতিপত্তিকে খতম করবেন। (আল-ইশাআ, পৃষ্ঠা : ১৯৩)।
বিশ্বস্ত বর্ণনা দ্বারা প্রমাণিত হয়, ইমাম মাহদির নাম মহানবী (সা.)-এর নামের মতো হবে। তাঁর বাবার নাম হবে মহানবী (সা.)-এর বাবার নামে। ইবনে মাসউদ (রা.) থেকে বর্ণিত একটি হাদিসে এসেছে, নবী (সা.) বলেন, ‘যদি কেয়ামত সংঘটিত হওয়ার মাত্র একদিনও অবশিষ্ট থাকে তবুও আল্লাহ তায়ালা ওই দিনকে দীর্ঘ করবেন এবং আমার বংশের এক ব্যক্তিকে প্রেরণ করবেন। তাঁর নাম আমার নামের সঙ্গে এবং তাঁর পিতার নাম আমার পিতার নামের সঙ্গে মিলে যাবে।’ (আবু দাউদ : ৪২৮২)।
বংশগতভাবে তিনি নবী বংশের হবেন। পিতার দিক থেকে তিনি হবেন হাসানি তথা হাসান (রা.)-এর বংশধর। মায়ের দিক থেকে হোসাইনি তথা হোসাইন (রা.)-এর বংশধর। (মিরকাতুল মাফাতিহ : ১০/১৭৪)। আলী (রা.) একবার হাসানকে দেখে বললেন, আমার এ ছেলে সাইয়েদ। রাসুল (সা.) তাকে সাইয়েদ বলে অভিহিত করেছেন। ওর বংশধর থেকে এক ব্যক্তি আসবেন, যার নাম নবীজির নামে হবে। তিনি স্বভাবগত দিক দিয়ে হাসানের মতো হবেন। তবে আকৃতিতে তার মতো হবেন না।’ (আবু দাউদ : ৪২৯০)।
তাঁর ব্যাপারে আব্বাস (রা.)-এর বংশধর হওয়ার কথাও রয়েছে। হাদিসে আছে, একবার রাসুল (সা.) ফাতেমা (রা.)-কে লক্ষ্য করে বললেন, কসম ওই সত্তার, যিনি আমাকে সত্য সহকারে পাঠিয়েছেন, মাহদি হবে এরা দুজন অর্থাৎ হাসান-হোসাইনের পরিবার থেকে এবং আমার চাচা আব্বাস (রা.)-এর বংশ থেকে।’ (আত-তালিকুস সবিহ : ৬/১৯৬)। তাঁর জন্ম হবে মদিনায়। (কিতাবুল ফিতান, পৃষ্ঠা : ২৫২)।
ইমাম মাহদির গঠন-প্রকৃতি : তাঁর গঠন-প্রকৃতি হবে খুবই সুন্দর। হোজাইফা (রা.) থেকে বর্ণিত হাদিসে আছে, তার চেহারা হবে উজ্জ্বল তারকার ন্যায়।’ (কানজুল উম্মাল : ৩৮৬৬৬)। আবু সাঈদ খুদরি (রা.) থেকে বর্ণিত হাদিসে রাসুল (সা.) বলেন, ইমাম মাহদি প্রশস্ত ললাট এবং লম্বা ও সরু নাকের অধিকারী হবে।’ (আবু দাউদ : ৪২৮৫)।
সে সময়কার পরিস্তিতি : ইমাম মাহদি আগমনের সময়কার পরিস্থিতি হবে খুবই ভয়ংকর। আবু হুরাইরা (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী (সা.) বলেছেন, ওই মহান সত্তার কসম, যার হাতে আমার প্রাণ, অবশ্যই মানুষের ওপর এমন একটি জমানা আসবে যখন হত্যাকারী বুঝতে পারবে না কী কারণে হত্যা করেছে এবং নিহত ব্যক্তিও বুঝতে পারবে না কী কারণে তাকে হত্যা করা হয়েছে।’ (মুসলিম: ২৯০৮)।
যে ধন-সম্পদ নিয়ে মানুষের মাঝে মারামারি-কাটাকাটি সে সময় জমিন তার ভেতরের খনিজ সম্পদ ভূপৃষ্ঠে নিক্ষেপ করে দেবে। আবু হুরাইরা (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী (সা.) বলেন, জমিন তার ভূগর্ভস্ত স্বর্ণের টুকরা (খনিজ সম্পদ) স্তম্ভের মতো নিক্ষেপ করে দেবে।’ (তিরমিজি : ২২০৮)।
অতি মূল্যবান সময় দ্রুতগতিতে শেষ হয়ে যাবে। সময়ের বরকত বলতে কিছু থাকবে না। আপতিত বিপদ-মুসিবত এবং ভয়ংকর পরিস্থিতির কারণে তাদের সময় কিভাবে বয়ে যাবে তারা টেরও পাবে না। আনাস ইবনে মালেক (রা.) থেকে বর্ণিত হাদিসে এসেছে, ‘কেয়ামত ওই সময় পর্যন্ত সংঘটিত হবে না যতদিন না জমানা নিকটবর্তী না হবে (এত দ্রুতগতিতে অতিক্রম না হবে) যে, বছর মাসের সমান, মাস সপ্তাহ সমান, সপ্তাহ ঘণ্টা সমান এবং এক ঘণ্টা আগুনের আঙ্গরা জ্বলে ওঠার সমান না হবে।’ (আগুনে লাকড়ী যেমন দ্রুত শেষ হয়ে যায়, তেমনি একটি ঘণ্টাও শেষ হয়ে যাবে)। (তিরমিজি : ২৩৩২)। হাদিসটির ব্যাখ্যায় হাদিসের অমর ভাষ্যকার মোল্লা আলি কারি (রহ.) বলেন, এটা মাহদি, ঈসা (আ.) কিংবা উভয়ের সময়কালে হবে। তিনি আরও বলেন, এ ব্যাখ্যাটিই স্পষ্ট। কেননা এ বিষয়টি দাজ্জালের বের হওয়ার সময় ঘটবে। আর দাজ্জালের আবির্ভাব এ দুনোজনের সময়কালেই হবে। (মিরকাতুল মাফাতিহ : ১০/১৬৯)।
মর্যাদা : ইমাম মাহদি হবেন এ উম্মতের একজন খোদাভীরু শ্রেষ্ঠ ব্যক্তি। আবু উমামা বাহেলি (রা.) থেকে বর্ণিত এক হাদিসে রাসুল (সা.) তাকে নেককার লোক বলে অভিহিত করেছেন। (ইবনে মাজাহ : ৪০৭৭)।
ঈসা (আ.) যখন দামেস্কের উমাইয়া জামে মসজিদে ফজরের নামাজের সময় অবতরণ করবেন, তখন ইমাম মাহদি ইমামতি করবেন। দায়িত্বরত মুসলিম ইমাম নবী ঈসা (আ.)-কে শ্রদ্ধাভরে অনুরোধ করবেন, হে রুহুল্লাহ, আসুন, আমাদের ইমামতি করুন। তিনি বলবেন, না, তোমরা বরং একে অন্যের আমির। এটাই সেই সম্মান, যা আল্লাহ তায়ালা এই উম্মতকে দান করেছেন।’ (মুসলিম : ১৫৬)।
ঈসা (আ.)-এর উপস্থিতিতে ইমাম মাহদির ইমামতি উম্মতে মুহাম্মদির সম্মানের কারণ। পাশাপাশি এটি ঈসা (আ.)-এর পক্ষ থেকে ইমাম মাহদির সত্যায়ন ও সমর্থন। আবু হুরাইরা (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী (সা.) বলেন, ‘কতইনা আনন্দের কথা! যখন ইবনে মারিয়াম (আ.) তোমাদের মাঝে অবতরণ করবেন, আর ইমাম হবেন তোমাদের থেকে।’ (মুসলিম : ২৪৬)।
তবে ইমাম মাহদির ইমামতির কারণে ঈসা (আ.)-এর নবুওতের মর্যাদায় কোনো ব্যত্যয় ঘটবে না। যেমন নাকি মহানবী (সা.) আবু বকর সিদ্দিক ও আবদুর রহমান ইবনে আউফের ইক্তেদা করে নামাজ আদায় করেছেন। এতে মহানবীর নবুওতে কোনো ত্রুটি হয়নি।
বিখ্যাত গবেষক আলেম ইউসুফ লুধিয়ানুবি (রহ.) বলেন, ইমাম মাহদি (রা.) নবী হবেন না। এজন্য তাঁর স্তর পয়গম্বরদের সমান কখনই হবে না। আর ঈসা (আ.) যিনি ইমাম মাহদির সময়কালে অবতরণ করবেন তিনি তো আগ থেকেই নবী। (আপ কে মাসায়েল আওর উনকা হল : ১/২৭৬)।
বাইয়াত গ্রহণ : মানুষ তাঁর দিক-নির্দেশনা অনুযায়ী চলার জন্য তার হাতে হাত রেখে শপথ করতে চাইবে। তিনি গ্রহণ করবেন। উম্মে সালামা (রা.) থেকে বর্ণিত হাদিসে রাসুল (সা.) বলেন, ‘হাজরে আসওয়াদ ও মাকামে ইবরাহিমের মধ্যবর্তী স্থানে মানুষ তার হাতে বাইয়াত গ্রহণ করবেন।’ (আবু দাউদ : ৪২৮৬)।
ইমাম মাহদির সাথী-সঙ্গী : নেককার লোকেরা ইমাম মাহদির পাশে থাকবে। সহযোগিতা করবে। আবদুল্লাহ ইবনে হারেস (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) বলেন, ‘পূর্ব থেকে কিছু লোকের আবির্ভাব হবে যারা ইমাম মাহদির খেলাফতকে সহজ করে দেবে।’ (ইবনে মাজাহ : ৪০৮৮)।
সুবিচার প্রতিষ্ঠা : তিনি মানুষের মাঝে সুবিচার, সুশাসন প্রতিষ্ঠা করবেন। আলী (রা.) থেকে বর্ণিত হাদিসে নবী (সা.) বলেন, ‘যদি জমানার একদিন সময় থাকে তবুও আল্লাহ তায়ালা আমার পরিবারে একজন মানুষ পাঠাবেন যিনি পৃথিবীকে এমনভাবে ন্যায়নিষ্ঠতা ও ইনসাফ দিয়ে ভরে দেবেন যেভাবে এর পূর্বে জুলুম-অত্যাচারে ভরে গিয়েছিল।’ (আবু দাউদ : ৪২৮৩)।
শাহ রফিউদ্দিন (রহ.) বলেন, তার খেলাফতের সময়কাল সাত, আট কিংবা নয় বছর। এক হাদিসে আছে, তিনি সাত বছর খেলাফতের দায়িত্ব পালন করবেন।’ (আবু দাউদ : ৪২৮৫)।
বদান্যতা : তার বদান্যতা হবে ঈর্ষণীয়। তিনি খুব দান-খয়রাত করবেন। আবু সাঈদ খুদরি (রা.) থেকে বর্ণিত হাদিসে আছে, নবী (সা.) বলেন, একলোক ইমাম মাহদির কাছে এসে বলবে, হে মাহদি, আমাকে কিছু দেন! আমাকে কিছু দেন! তখন তিনি তার কাপড়ে আজল ভরে এত পরিমাণ দেবেন যতটুকু সে বহন করতে পারে।’ (তিরমিজি : ২২৩২)। তাঁর থেকেই অন্য একটি বর্ণনায় এসেছে, রাসুল (সা.) বলেন, ‘শেষ জমানায় একজন খলিফা হবে সে ধন-সম্পদ বণ্টণ করবে এবং তা গণনা করবে না।’ (মুসলিম : ২৯১৪)। তার সময়ে আকাশ থেকে মুষলধারে বৃষ্টিবর্ষণ হবে। জমিন সব ধরনের শস্য উদপাদন করবে। মানুষের জীবন হবে খুবই স্বাচ্ছন্দময়।
ইন্তেকাল : বাইয়াত গ্রহণের সময় তাঁর বয়স হবে ৪০ বছর। খেলাফতের ৭ম বছরে দাজ্জাল বের হবে। তাকে হত্যা করার জন্য ঈসা (আ.) আসমান থেকে অবতরণ করবেন। ইমাম মাহদি তাঁর সঙ্গে দুই বছর কাটাবেন এবং ৪৯ বছর বয়সে তিনি ইন্তেকাল করবেন। (আপকে মাসায়েল আওর উনকা হল : ১/২৬৮)।