মনের মণিকোঠায় স্মৃতির নীলখামে প্রবাসীর বাংলাদেশ

Published: 12 February 2022

শফি আহমেদ

কন কনে শীতের আঁচরে আবৃত সারা বিলাত। কোথাও তুষারের কাশবনে রূপকথার খেয়ালি কন্যা এক ঝলক ‘স্নো হোয়াইট’ দেখার সময় বুঝি এখনি। বসন্তের আগমনের দিন এখনো আসেনি। তাতে কি হিমতলে বসে থাকলেও রঙ তুলিতে অনড়। ইচ্ছে যখন প্রবল ইনশাহআল্লাহ ফল মিলবে। এটা শুধু সময়ের ব্যাপার। এখানেই শীতের আঁচর কেটে রঙের মেলা বসবে। বসন্ত আসবে। এ আসা তড়িৎ হোক। এখানে পাতাঝরা গাছ গুলোর পাখিদের এমন বাসনা আমরা সহজেই অনুভব করতে পারি। কারণ বলা যেতে পারে এমন আকাঙ্খা আমাদের সকলেরই।

বহুল আকাঙ্খিত বিলাতের বসন্ত উদ্ঘোম পুরোটাই যেন অবলোকন করা যায়। মোবাইলে লাইভ চিত্র ধারণ করা যায়। এতটুকু সময় নিয়ে আগে ভাগেই বাংলাদেশ থেকে আমার এক বড় কুটুম, সিলেটের সাংস্কৃতিক অঙ্গনের এক তরুণ মেধাবী কৰ্মীক, প্রভাষক আনোয়ার হুসেন উচ্চ শিক্ষার তাগিদে, স্কলারশিপ নিয়ে ইংল্যান্ডের বাগান বলে খ্যাত কেন্টে পাড়ি দিলেন। আসলেন ভগ্নিপতি আনসার আলী ও বোন কানিজ ফাতিমা ফাতেহার ঘরে।

 

আজ জুম্মা নামাজ পড়ে মরিসন সুপারমার্কেটে ঢুকেছি। এরই মধ্যে গৃহিণী ফোন করলেন। আনোয়ারের ফুফুতো বড়বোন আয়েশা আহমেদ বলিলেন আনোয়ারকে শুভেচ্ছা জানাতে সবচেয়ে বর্ণাঢ্য ফুলগুচ্ছ এন। তাকে আমেরিকা থেকে ফোন করে বোন আম্বিয়া ও ভগ্নিপতি আব্দুস সালাম ও সায় জানালেন। হ্যা আমারও ইচ্ছা তাই। শিউলি, কামিনী আর ছাতিম ফুলের গুচ্ছ হাত ভরে দিব। কিন্তু সব দেশে কি আর সবুজ-শ্যামল প্রকৃতিতে মল্লিকা ম-ম করে? দিনে কাঠ গোলাপ আর রাতে রজনীগন্ধা ফোটে?

 

সৃজনশীল আনোয়ার ইতিমধ্যেই শিক্ষকতায় চমক দেখিয়েছেন। বয়স এক কুড়ি দশ হওয়ার আগেই দেশের প্রথম সারির পত্রিকা প্রথম আলোর পাতায় জায়গা করে নিতে পেরেছেন। পত্রিকাটিতে ফলাও করে বর্ণিত হয়েছে তার সুকীর্তি। এই প্রথম তিনি চিরচেনা ধানসিঁড়ি তটিনীর পার ছেড়ে, সাত সমুদ্র তেরো নদী পেরিয়ে টেমস নদীর ঘাটে খেয়া লাগলেন।

 

তার অনুভূতি কথা জানতে গিয়ে মন ছুঁটে যায় সেই প্রবাসীর মনের মনিকোঠায়, স্মৃতির নীলখামে ভরে রাখা বাংলাদেশে। একজন প্রবাসী বাংলাদেশির জন্য এমনটাই বোধহয় স্বাভাবিক। তার সোনার হরিণ ধরার ঠিকানা যেখানেই হোক। বিশ্বের সবচেয়ে দামী লন্ডন রয়েল বারা অব কেনসিংটন এন্ড চেলসি অথবা নিউ ইয়র্ক মানহাট্টন। সে দিন মাধবীর পাশে চুপটি করে বসে থাকা যে বনলতা চোখেই পড়েনি প্রবাসে তাই মহি রূপে ভেসে উঠে স্মৃতিপটে। আনোয়ারের ও এর ব্যতিক্রম হলনা।

 

বিলাতে শীতকালের আল বিদা তড়িৎ হওয়াটাই বাঞ্ছনীয়। কিন্তু বাংলাদেশের বেলা আমরা এর বিপরীত চিত্র দেখতে পাই। বসন্ত কোকিল গেয়ে ওঠার আগে শীতের নরম শিশির আরেকটুক দীর্ঘস্থায়ী হোক। শিরশির করে বনের গাছ গুলোর পাতার ফাক দিয়ে শীতের হাওয়া আর কতক্ষণ বয়ে যাক। এমন মনোভাব সেখানে সর্বজনীন।

 

যদি বলি শীত বিদায় বিলেতে তড়িৎ কাম্য হলেও বাংলাদেশে শীতকাল পানে চুনের মত। বড় বেশি বলা হবে কী? কারণ শরতে শিশিরে রিনিঝিনি জমে না উঠলে ষড়ঋতুর বাংলার ঋতু তৃপ্তি মিটেনা। যেমন বিয়েবাড়ি খাওয়ার শেষে পানে চুন দিয়ে সুপারি না খেলে উৎসবের তৃপ্তি মিলেনা।

 

সেখানে শিশিরের শিউলি, শরতের শিউলি, শীতের শিউলি- কত নামে ডেকে ঋতুরগঙ্গশালায় শীত কাল হোক আরেকটুক দীঘল। একমুঠ মিষ্টি রোদ মাখা শীতের সকালে ঘাসের ডগাই আটকে থাকা শিশিরবিন্দুগুলোও মুক্তো দানার মতো দ্যুতি ছড়াক এক প্রহর থেকে অরেক প্রহরে। এমন উমেদ যেন জায়গা করে নিয়েছে বাংলার আপামর জনতার মনের মণিকোঠায়। গাছের নরম-কচি পাতার ফাঁকে ফাঁকে উঁকি দেওয়া শীতের মিষ্টি রোদের সকালে আরো কতটা দিন ভোরের দোয়ার খোলতে সবারই যে মন চায়।

 

ষড়ঋতুর বাংলার ঋতুরাজ্ বসন্তের নৈসর্গিক ফাল্গুনের সাতকাহন। আমরা বারবার শুনে থাকি। এ যেন ধ্রুপদী রাগে গাওয়া মসলিন সুতোয় বাঁধা আসমানী সালসাবিলা পারের এক চিলতে নক্শীকাঁথার রূপকথা। যা আমাদের কর্ণ কুহুরে, মনের ঝর্ণাতলে বারবার দোল দেয়। তেমনি শ্রাবনের আকাশ জুড়ে রঙধনু আর ঘনঘটার লোকোচুরি খেলা শেষে রঙে পাকা, ঝমঝমাঝম ঝরা বৃষ্টির গানে আমরা শুনি সিন্ধুতলার শুরময়ূরীর মনমোহিনী কুহু কেকা মুরালি।

 

শরৎ-হেমন্তে বাংলার মায়াবী মাটি যেন আরো মমতাময়ী হয়ে উঠে নীরবে, নিবিড় নিভৃতে। মাটিতে সোনালি রোদ্দুরের পরশ। ঘাসের ডগায় শিশিরবিন্দুতে শীতের নরম নীরব হালকা নামা। শিউলি ফোটার আলতো ছোঁয়া। স্রোতস্বিনী নদীর ধারে সফেদ কাশফুলের দোল দুলুনি। জলাশয়ের শালুক পাতায় জল টুপটুপ আর মাঝে মাঝে আকাশে ইলেশগুঁড়ি বৃষ্টি ছিটা। শরদিন্দু ছোঁয়ায় আনাচ-কানাচে রঙ লাগা দিনে শজিনার ফুল। রাতে বিলে অথবা বাড়ির ছোট্ট পুকুরে ফুটা পদ্ম ঘিরে নীরবে নিভৃতে জোছনার থা থা থৈ থৈ, থা থা থৈ থৈ না দেখলে নয়।

 

শব্দমালার কাব্য এই গীতাঞ্জলি বিশ্ব সভায় তুলে ধরা যায়না। আমার মনে হয় কবি ঠাকুরের ইংরেজি (বাংলা নয়) গীতাঞ্জলিতেও এটা খুজেঁ পাবেন না। এটা চোখের আড়াল হলে ভাসায় বর্ণনা করা যায়না। বিরহের অনলে জ্বলতে হয়। আমরা জানি প্রবাসীর মন নৈসর্গিক বাংলায় বার বার ফিরে যেতে চায়। সেই মায়াবী নীড়ে ফিরার আগে আনোয়ারের সূর্যোদয়ের পাখি উড়ুক নতুন শিখরে।