বিদেশে বিনিয়োগের আগে যে প্রস্তুতি নিতে হবে

Published: 19 February 2022

।। ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ।।

একটা দেশের সামগ্রিক উন্নয়নের জন্য অভ্যন্তরীণ ও বহির্বাণিজ্য দুটিই গুরুত্বপূর্ণ। একটি আরেকটির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। এ কারণে উভয় ধরনের বাণিজ্য বিকাশের পথ সরকারকে উন্মুক্ত রাখতে হয়, অবাধ করতে হয়। আবার বাণিজ্য যাতে সামাজিক ও মানবিক কল্যাণ থেকে বিচ্যুত না হয় এবং সার্বিক আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে অবদান রাখতে পারে, সে জন্য প্রয়োজন অনুযায়ী নিয়ন্ত্রণ আরোপও করতে হয়।

বাণিজ্য বাধা দূর করতে আমাদের বিশেষজ্ঞরা নানা পরামর্শ দিয়ে থাকেন, নীতিনির্ধারকরাও নানা উদ্যোগ নেন। কিন্তু বাস্তবায়নটা হয় খুব ধীরলয়ে। ফলে এই সময়ে এসেও আমাদের ব্যবসা ও বিনিয়োগে নানা প্রতিবন্ধকতা বিদ্যমান। এর মধ্যেই নতুন একটি উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। এখন থেকে বিদেশে বিনিয়োগ করতে পারবেন বাংলাদেশিরা। এ ক্ষেত্রে বিদ্যমান সমস্যা ও আসন্ন ঝুঁকি পর্যালোচনা করতে হবে।

আমাদের অভ্যন্তরীণ ও বহির্বাণিজ্যে সমস্যাগুলোর সমাধানে কতগুলো বিষয় বিশেষ বিবেচনায় নিতে হবে। প্রথমত, বহির্বাণিজ্যের জন্য আমাদের অভ্যন্তরীণ উৎপাদনশীলতা যে মাত্রায় থাকার কথা সেটা নেই। দেশের চাহিদা পূরণ করে বিদেশে পাঠানোর সক্ষমতা আমাদের অপেক্ষাকৃত কম। দ্বিতীয়ত, সব ক্ষেত্রে আমরা কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় সক্ষমতা অর্জন করতে পারিনি। তৃতীয়ত, শিল্প-যন্ত্রপাতি ও কাঁচামাল আনতে হয়। এটা ঠিক যে কোনো দেশই শতভাগ স্বয়ংসম্পূর্ণ নয়। তবে ঘাটতির একটা যৌক্তিক পর্যায় থাকতে হয়। এ জন্য অভ্যন্তরীণ উৎপাদনশীলতা বাড়ানোর পাশাপাশি আমদানিনির্ভরতার ক্ষেত্রগুলো কিভাবে আরো কমিয়ে আনা যায় সেদিকে বিশেষ মনোযোগ দেওয়া দরকার। বাইরের দেশগুলোর চাহিদার দিকে লক্ষ রেখে আমাদের রপ্তানি পণ্য উৎপাদন এবং বাজার সৃষ্টি করতে হবে এবং বাইরে থেকে পণ্য সাশ্রয়মূল্যে আমাদের আনতে হবে।

এই কাজগুলো একক কোনো প্রতিষ্ঠান করতে পারবে না। এখানে একটা বহুমাত্রিক ব্যাপার আছে। এ ক্ষেত্রে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, শিল্প মন্ত্রণালয়, অর্থ মন্ত্রণালয় এবং বিনিয়োগ বৃদ্ধির কাজে নিয়োজিত বিডা ও বেপজার মতো প্রতিষ্ঠানের ভূমিকা রয়েছে। এই ভূমিকা পালনে সবাইকে সক্রিয় থাকতে হবে এবং এটা খুব দরকার।

লক্ষ করার বিষয় হচ্ছে, আমাদের রপ্তানি বাণিজ্যের পরিমাণটা কম এবং এর প্রধান অংশই হচ্ছে তৈরি পোশাক (আরএমজি)। আবার রপ্তানির চেয়ে আমাদের আমদানি অনেক বেশি। বলতে গেলে আমরা আমদানিনির্ভর একটি দেশ। কারণ বেশির ভাগ জিনিসই আমাদের আমদানি করতে হয়। খাদ্যদ্রব্য থেকে শুরু করে যন্ত্রপাতি, কাঁচামাল, ইন্টারমিডিয়েট পণ্য এং অনেক সেবা আমাদের আমদানি করতে হয়। সেবার মধ্যে আর্থিক ও চিকিৎসাসেবার ব্যাপারটি রয়েছে। এর মধ্য দিয়ে বিপুল পরিমাণ অর্থ বাইরে চলে যাচ্ছে।

সাম্প্রতিককালে আমাদের রপ্তানি ধারাবাহিকভাবে বাড়ছে। কিন্তু এর তুলনায় আমদানি বেড়েছে প্রচুর পরিমাণে। ফলে আমাদের কারেন্ট অ্যাকাউন্ট ব্যালান্সের ওপর প্রচণ্ড চাপ সৃষ্টি হয়েছে। আমাদের ব্যাল্যান্স এমনিতে নেগেটিভ থাকে। অর্থাৎ আমদানি-রপ্তানির ভারসাম্য সব সময় ঋণাত্মক থাকে। আবার এই মুহূর্তে আমাদের রেমিট্যান্স খুব একটা আসছে না। ফলে কারেন্ট অ্যাকাউন্ট ব্যালান্স ঋণাত্মক থাকছে। সম্প্রতি এটা আরো বাড়ছে।

এই মুহূর্তে কারেন্ট অ্যাকাউন্ট ব্যালান্স ঋণাত্মক হওয়ার মূল কারণ হলো আমদনি বেশি ও রপ্তানি কম। এই ঘাটতি পূরণ করতে সরকারকে হয় বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ব্যয় করতে হবে অথবা সরকারকে ঋণ নিতে হবে। আবার অনবরত কারেন্ট অ্যাকাউন্ট ব্যালান্স ঋণাত্মক থাকলে বৈদেশিক মুদ্রার রেট বেড়ে যায় এবং স্থানীয় মুদ্রা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। যেমন—এই মুহূর্তে আমাদের টাকা মূল্য হারাচ্ছে। আমাদের মনে রাখতে হবে, আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৪৬ বিলিয়ন ডলার আছে বলেই কারেন্ট অ্যাকাউন্ট ঋণাত্মক থাকলে কোনো সমস্যা নেই—এটা বাস্তবসম্মত চিন্তা নয়।

আমাদের বাণিজ্যের আরেকটা বৈশিষ্ট্য হলো আঞ্চলিক বাণিজ্য বৈষম্য। আঞ্চলিক দিক বিবেচনায় নিয়ে ভারত ও চীন আমাদের কাছ থেকে যে পণ্য আমদানি করে তার পরিমাণ বেশি নয়। তার মানে আমাদের এখন থেকে তাদের পণ্য নেওয়ার প্রয়োজন নেই, তা নয়। অবশ্যই আছে। কিন্তু অন্য দেশ থেকে একই পণ্য আনাটাকে তারা সহজ ও সাশ্রয়ী মনে করে।

সুতরাং বোঝাই যাচ্ছে, আমাদের বাণিজ্য প্রসারের অনেক সমস্যা রয়ে গেছে। আমাদের এখানে গড় শুল্ক হার অন্যান্য দেশের তুলনায় বেশি। আমাদের অনেক অশুল্ক প্রতিবন্ধকতা আছে। আমাদের সারচার্জ অনেক। এসব যদি আমরা যৌক্তিক করতে না পারি, তাহলে আমরা বহির্বাণিজ্য সম্প্রসারণ করতে পারব না। আমাদের বাণিজ্য বাড়াতে হলে আমাদের এই নীতিগুলো পুনর্বিবেচনা করতে হবে। আর্থিক খাতে অনেক সংস্কার হয়েছে। কিন্তু বাণিজ্য সম্প্রসারণে খুব বেশি সংস্কার হয়নি।

কারেন্ট অ্যাকাউন্ট ব্যালান্স ছাড়াও সার্বিকভাবে আমাদের দেশে যে ইনফ্লো (বৈদেশিক মুদ্রা সংগ্রহ) আসার কথা, ব্যালান্স অব পেমেন্টের অংশ হিসেবে যে ফিন্যানশিয়াল ফ্লো আসার কথা, সেই এফডিআই অনেক কমে যাচ্ছে। আবার শেয়ারবাজারে বিদেশে বিনিয়োগ তথা ফরেন পোর্টফোলিও ইনভেস্টমেন্ট (এফপিআই) সাম্প্রতিক সময়ে বেশ কম। এখন চিন্তার বিষয় হচ্ছে, এফডিআই ও এফটিআইয়ের লাভের অংশটা যদি বিদেশি বিনিয়োগকারীরা নিয়ে যান, তাহলে নেট বিনিয়োগের পরিমাণটা আরো কমে যাবে। সাম্প্রতিক সময়ে বিদেশি বিনিয়োগের লাভ চলে গেছে অনেক বেশি। এ অবস্থায় এখন আমাদের এফপিআই বাড়াতে হবে। এ জন্য ভালো আইপিও দরকার, ডিএসইসির রুল রেগুলেশন উপযোগী করা দরকার।

অন্যদিকে বিদেশি প্রত্যক্ষ বিনিয়োগ-এফডিআই বাড়াতে হলে আমাদের বিনিয়োগ পরিবেশটা ঠিক করতে হবে। যদিও এক্সপোর্ট প্রসেসিং জোনের (ইপিজেডের) উন্নয়ন চলছে, কিন্তু সেখানেও জমি নিয়ে অনেক ঝামেলা আছে। এখানে কতগুলো প্রাইভেট জোন আছে। সেটা বাদ দিলাম। সেখানেও সুযোগ-সুবিধাগুলো খুব সাশ্রয়ী পাওয়া যাবে কি না নিশ্চিত নয়। এখন বলা হচ্ছে গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বাড়বে, পানির দামও বাড়বে। এর ফলে পানিসংশ্লিষ্ট অনেক জিনিস ও সেবার দামও বাড়বে। বিদেশিরা বিনিয়োগ করতে চাইলে তারা এই বিষয়গুলোও দেখবে। অভ্যন্তরীণ বাণিজ্যের জন্যও এটা নেতিবাচক।

আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আলোকপাত করা দরকার। সম্প্রতি বিদেশে বাংলাদেশিদের বিনিয়োগের পথ খুলে দিয়েছে সরকার। একটি কম্পানির প্রত্যাবাসিত রপ্তানি আয়ের ২০ শতাংশ এবং কম্পানির নিট সম্পদের ২৫ শতাংশ বাইরের দেশে বিনিয়োগ করতে পারবে। এর মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ একটি গুরুত্বপূর্ণ নীতি গ্রহণ করেছে। এটা ক্যাপিটাল অ্যাকাউন্ট কনভার্টিবিলিটির একটা অংশ। যেমন—আমরা নিজেদের উপার্জিত অর্থ বাইরে নিতে পারব না বা গাড়ি-বাড়ি ও অ্যাসেট বিক্রি করতে বাইরে নিতে পারব না। বাইরের দেশে এসব কোনো বাধা নেই। আমেরিকানরা যেখানে-সেখানে বিনিয়োগ করতে পারে। আবার আপনি যদি সেখানে টাকা-পয়সা নিয়ে বিনিয়োগ করতে চান, তারা কোনো বাধাও দেবে না। আমাদের বাস্তবতা হলো বিদেশে বিনিয়োগের সুযোগ দিলে দেশে বিনিয়োগ কমে যেতে পারে।

এই সিদ্ধান্তের যৌক্তিক প্রেক্ষাপটটা ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। দেশে কি বিনিয়োগের ক্ষেত্র বা মুনাফা নেই? এ বিষয়গুলো নীতিনির্ধারকরা ভালো করে দেখেছেন কি না আমি বুঝতে পারছি না। এমনিতেই রপ্তানির সব আয় ফিরে আসে না বলেও অভিযোগ রয়েছে। এখন অতিরিক্ত অর্থ বাইরে চলে গেলে দেশে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে।

বিদেশে বিনিয়োগ বাড়লে দেশে বিনিয়োগ কমে যাবে, কর্মসংস্থানও কমে যাবে। একটা যুক্তি দেওয়া হচ্ছে যে বাইরে বিনিয়োগ হলে বাইরের দেশে বাঙালি যাঁরা আছেন তাঁরা কর্মসংস্থানের সুযোগ পাবেন। প্রশ্ন হচ্ছে, যে দেশে বাঙালি আছেন সে দেশেই বিনিয়োগ করবেন ব্যবসায়ীরা এর নিশ্চয়তা কী? কোনো দেশে বাঙালি থাকলেও তাঁদের দক্ষতা ও সুযোগ আছে কি না নিয়োগ পাওয়ার বিষয়ে সেটাও পর্যালোচনা করতে হবে।

যেহেতু বিদেশে বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত হয়ে গেছে, তাই ঢালাওভাবে যেন বাস্তবায়ন করা না হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। গভীরভাবে নজরদারিও করতে হবে। এখানে ফাঁক আছে। যেমন—কোনো কম্পানি বলতে পারে যে বিনিয়োগ করার পর লোকসান হয়েছে। অতএব টাকা আর দেশে আনার সুযোগ নেই। কিন্তু সত্যি লোকসান হয়েছে কি না সেটা আপনি কী করে জানবেন? আবার লাভ হয়েছে এটাও জানার সুযোগ নেই। তাহলে বিনিয়োগের মুনাফার প্রত্যাবাসন কিভাবে সম্ভব হবে? এমনিতেই অনেক সময় রপ্তানির টাকা প্রত্যাবাসনে অনেক দেরি হয়।

ভারত ১৯৯৭ সালে ক্যাপিটাল অ্যাকাউন্ট কনভার্টিবিলিটি শুরু করেছিল এবং তাও আংশিকভাবে ও আস্তে আস্তে করে। সেখানে বাজেট ঘাটতি কমানোর শর্ত ছিল। বাজেট ঘাটতি ৩ শতাংশে নামিয়ে আনার শর্ত ছিল। আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও ব্যাংকের তারল্য ও ব্যাংকের সুশাসন নিশ্চিত করার শর্ত দেওয়া হয়েছিল। কারণ এর সঙ্গে ব্যাংক জড়িত থাকে। আমাদের দেশে ব্যাংকের যে অবস্থা, তাতে বিদেশে বিনিয়োগের সিদ্ধান্তটি যথাযথভাবে বাস্তবায়ন কী করে সম্ভব হবে বোঝা যাচ্ছে না।

আরেকটি বিষয় হচ্ছে, কর রাজস্ব বাড়াতে হবে। অর্থাৎ আমাদের আয়কর আদায় করার পরিমাণ বাড়াতে হবে। আর্থিক খাতে সংস্কার আনতে হবে। এ ছাড়া বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ন্যূনতম কতটুকু থাকবে জিডিপির তুলনায় সেটাও আমাদের নির্ধারণ করতে হবে। আমাদের এখানে বলা হচ্ছে, ৪৬ বিলিয়ন ডলার অনেক বেশি। প্রকৃতপক্ষে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের একটা অনুপাত থাকতে হয় দেশের অর্থ সরবরাহ ও জিডিপির সঙ্গে। অথচ আমরা এখনো এটাকে সঠিকভাবে হিসাব করিনি। আমরা বলছি, ফরেন রিজার্ভ অনেক বেশি আছে। কিন্তু কিসের ভিত্তিতে সেটা বলছি, সেটা নির্ধারণ করা দরকার।

যাই হোক, আমাদের অভ্যন্তরীণ ও বহির্বাণিজ্যের সঙ্গে উল্লিখিত বিষয়গুলো জড়িত। আমাদের বিদেশি প্রত্যক্ষ বিনিয়োগ আসতে হবে, বিদেশি পোর্টফোলিও বিনিয়োগও আসতে হবে। আমাদের রপ্তানিকারকদের সুবিধা দেখার পাশাপাশি তাঁদের প্রতি নজরদারিও বাড়াতে হবে। তাঁদের রপ্তানি অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু তাঁদের রপ্তানি আয় যেন আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রগুলোকে সহযোগিতা করে, দেশের কল্যাণ নিশ্চিত করে সেটাও দেখতে হবে। অর্থাৎ দেশের শিল্প-বাণিজ্যে তাদের সহযোগিতামূলক ভূমিকা থাকতে হবে। যেখানে আয়-ব্যয়ের ঘাটতি বিরাজমান, সেখানে এ ধরনের নীতি আমাদের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন, সমতাভিত্তিক উন্নয়ন, সর্বোপরি কল্যাণমূলক উন্নয়নে কতটুকু ভূমিকা রাখতে পারব, সেটা ভেবে দেখতে হবে।

লেখক : সাবেক গভর্নর, বাংলাদেশ ব্যাংক ও অধ্যাপক, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়