বাংলাদেশের রিজার্ভ আসলে কতো?

Published: 30 October 2022

রুমিন ফারহানা


মাত্রই ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ের আঘাতে কিছুটা বিপর্যস্ত হয়েছে দেশ। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী বলছেন, প্রকৃত ক্ষতির প্রতিবেদন পেতে নাকি ৭ থেকে ১৫ দিন সময় লাগবে। তবে এর মধ্যেই সরকারিভাবে যে খবর পাওয়া গেছে সেটি অনুযায়ী সিত্রাংয়ের প্রভাবে দেশের ৪১৯টি ইউনিয়ন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এসব ইউনিয়নে আনুমানিক ১০ হাজার ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এ ছাড়া ৬ হাজার হেক্টর ফসলের জমি নষ্ট হয়েছে এবং ১ হাজার মাছের ঘের ভেসে গেছে। এর মধ্যে ঝড়ের তাণ্ডবে মারা গেছেন ২১ জন। দুর্যোগ, ঝড়ো হাওয়া ও তুমুল বৃষ্টিতে পানিবন্দি হয়ে পড়েছিল কয়েক হাজার মানুষ। চট্টগ্রাম বন্দর বন্ধ ছিল। আশ্রয়কেন্দ্রে ঠাঁই নিয়েছিল বহু মানুষ। কিন্তু সেখানে খাবার, পানি, টয়লেটসহ সমস্যার অন্ত নেই।

যদিও সিত্রাং আগেভাগে ঘোষণা দিয়েই এসেছে, তারপরও আর সব বারের মতোই প্রস্তুতিহীন ছিল আশ্রয়কেন্দ্রগুলো। যেহেতু খুবই সাধারণ মানুষ ঠাঁই নেয় এই কেন্দ্রগুলোতে, তাই তাদের বিষয়ে খুব বেশি চিন্তিত না হলেও চলে সরকারের। গত ১৫ বছরে অন্তত তাই দেখেছি আমরা।
অবশ্য এ দেশে গত ১৫ বছরে সরকার সাধারণ মানুষের কোনো সমস্যা নিয়েই বা মাথা ঘামিয়েছে? প্রাকৃতিক দুর্যোগ হোক কিংবা মানবসৃষ্ট, সাধারণ মানুষের দুর্দশায় কখনোই পাওয়া যায়নি সরকারকে। এই যেমন কয়েক মাস আগেই যখন বন্যার পানিতে ভাসছিল সিলেট, তখনো দেখেছি সরকারের উদাসীনতা। আগাম ঘোষণা দিয়ে আসার পরও দেখা গেছে ক্ষয়ক্ষতি কমানোর তেমন কোনো প্রস্তুতিই ছিল না সরকারের তরফে। সিলেট আর সুনামগঞ্জের বন্যায় প্রাথমিকভাবে সরকারের বরাদ্দ ছিল ৬০ লাখ টাকা যেখানে বন্যাকবলিত মানুষের সংখ্যা ছিল কমপক্ষে ৫০ লাখ। অর্থাৎ মাথাপিছু বরাদ্দ ছিল ১ টাকা ২০ পয়সা। সেই সময় যখন ডুবছিল মানুষ, ভাসছিল পানিতে, হাহাকার করছিল সহায় সম্বল হারিয়ে তখন দেখেছি বরিশালে জয়বাংলা কনসার্টের বিশাল আয়োজন। সরকারি দলের এক অতি প্রভাবশালী উপদেষ্টা ও সাংসদ চার্টার্ড বিমানে চড়ে সেখানে গিয়ে সরকারের উন্নয়নের ফিরিস্তি শুনিয়ে এসেছিলেন। কনসার্টের নাচ, গান আরও বেশি উপভোগ্য করার জন্য ভারতীয় শিল্পী মিমি চক্রবর্তীকে উড়িয়ে আনা হয়েছিল ভারত থেকে। সে বাবদ রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে কত খরচ হয়েছে সে হিসাব আর জানা যায়নি।

করোনার সময়ও একই ধরনের চিত্র দেখা গেছে। সরকারি প্রেসনোট অনুযায়ী করোনার প্রথম লকডাউনের ৩ মাসে একজন মানুষ গড়ে চাল পেয়েছিল ২.৬২ কেজি। প্রতিদিনের হিসাবে এর পরিমাণ ১৪.৫৫ গ্রাম। ৩ মাসে আর্থিক সাহায্য পেয়েছিল ২০.৫৮ টাকা, প্রতিদিনের হিসাব করলে এর পরিমাণ দাঁড়ায় ১১.৩৮ পয়সা। একজন প্রান্তিক মানুষ প্রতিদিন ১৪ গ্রাম চাল আর ১১ পয়সা দিয়ে কি করবে সে আলাপ তুলেই রাখি। কথায় কথায় সিঙ্গাপুর, ইউরোপ হওয়া সরকার কেন যেন সাধারণ মানুষের দুর্ভোগে পাশে দাঁড়ানোর সময়টাতেই ভীষণ কৃপণ হয়ে ওঠে। অথচ এই সরকারই যখন মেগা প্রকল্প বা অবকাঠামো নির্মাণের কথা বলে তখন ন্যূনতম কোনো আর্থিক সংকটের আভাস পাওয়া যায় না। আসলে সাধারণ মানুষের দুর্ভোগে পাশে দাঁড়ানোর ঠেকা সরকারের নাই। ক্ষমতায় আসতে কিংবা ক্ষমতায় থাকতে মানুষের ম্যান্ডেট তাদের লাগে না। কিন্তু বড় বড় প্রকল্পের অবিশ্বাস্য বরাদ্দ আর ঋণ থেকে হাজার কোটি টাকা লুটে নেয়া যায় সহজেই। যে অলিগার্ক বা গোষ্ঠী এই সরকারকে টিকিয়ে রেখেছে তাদের তুষ্ট রাখা যায় এই প্রকল্প দিয়েই। এতদিন পর্যন্ত সরকারের একটাই স্লোগান ছিল আর তা হলো উন্নয়ন। সেই উন্নয়নের বয়ানে জায়গা হয়নি গণতন্ত্র, ভোটাধিকার, মানবাধিকার, সুশাসন, ন্যায়বিচার, বা সাধারণ মানুষের জীবনমানের উন্নয়নের কোনো কথা।

এই উন্নয়ন মানেই ছিল প্রবৃদ্ধি, মাথাপিছু আয়, বিশ্বের সবচেয়ে ব্যয়বহুল মেগা প্রকল্প, রিজার্ভ আর বিদ্যুৎ। কিন্তু জানি না হঠাৎ কি হলে? দেখা যাচ্ছে তীব্র আর্থিক সংকটে ডুবছে দেশ। শোনা যাচ্ছে রিজার্ভ সংকট, মূল্যস্ফীতি, টাকার বিপরীতে ডলারের অবিশ্বাস্য দাম বৃদ্ধিসহ নানা অর্থনৈতিক সংকটের কথা। সংকট এমন জায়গায় গিয়ে পৌঁছেছে যে, প্রধানমন্ত্রীর বিদ্যুৎ ও জ্বালানি উপদেষ্টা তৌফিক ই এলাহী বলতে বাধ্য হচ্ছেন ‘আমাদের রিজার্ভের যে অবস্থা, আমরা জানি না সামনে কি হবে। এলএনজি এখন আমরা আনছি না। এ সময়ে ২৫ ডলার হিসাব ধরেও যদি এলএনজি আমদানি করতে যাই, চাহিদা মেটাতে অন্তত ৬ মাস কেনার মতো অবস্থা আছে কিনা- জানি না। আমাদের এখন সাশ্রয়ী হওয়া ছাড়া উপায় নেই। প্রয়োজনে দিনের বেলা বিদ্যুৎ ব্যবহার বন্ধই করে দিতে হবে।’ গ্যাস, বিদ্যুৎ অর্থাৎ জ্বালানি খাতের অবস্থা কতটা নাজুক সেটা শিল্প খাতের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিদের কথা থেকেই স্পষ্ট। শিল্প খাতে জ্বালানি সংকটের প্রভাব হ্রাস নিয়ে এক আলোচনা সভায় দেশের বিভিন্ন খাতের শীর্ষ ব্যবসায়ী নেতারা বলেছেন, গ্যাস-বিদ্যুতের সংকটে দিনের প্রায়অর্ধেক সময় তাদেরকার খানাবন্ধ রাখতে হচ্ছে। ফলে উৎপাদন কমছে। রপ্তানির ক্রয়াদেশও কমে যাচ্ছে। এতে দুশ্চিন্তা বাড়ছে কর্মসংস্থান নিয়েই। ব্যবসায়ী নেতারা এখন চান প্রয়োজনীয় বিদ্যুৎ।

প্রয়োজনে দ্রুত তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আমদানি করে সরকারকে শিল্প কারখানায় সরবরাহ করতে হবে। আবার কেউ বলছেন, বাসাবাড়ি, সার কারখানাও বিদ্যুৎ উৎপাদনে গ্যাসের ব্যবহার কমিয়ে শিল্পে গ্যাস সরবরাহ বাড়াতে। বিসিআইয়ের সভাপতি আনোয়ার-উল আলম চৌধুরী বলেন, বর্তমানে যে সংকট চলছে, তা দ্রুত সমাধান করতে না পারলে মন্দা শুরু হতে পারে। এফবিসিসিআই এর সভাপতি বলেন, সাহস নিয়ে ব্যবসায়ীরা শিল্প খাতে অনেক বিনিয়োগ করেছেন। কিন্তু বিদ্যুৎ-জ্বালানি সংকটের কারণে আজকে সবার ডোবার মতো অবস্থা হয়েছে। এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি একে আজাদ বলেন, চলতি বছরের শুরুতে চীন-ভিয়েতনাম থেকে ব্যবসা বাংলাদেশে চলেএসে ৩৮ শতাংশের প্তানি প্রবৃদ্ধি হয়েছিল। আর এখন রপ্তানি সাড়ে ৭ শতাংশে নেতিবাচক হয়েছে। গ্যাস সংকটের কারণে শিল্প কারখানায় রাতের পালায় উৎপাদন বন্ধ থাকছে।

এমনিতে বাজার খারাপ, তার সঙ্গে চলছে গ্যাস-সংকট। এই অবস্থাকে ‘মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা’ বলে অভিহিত করেছেন বস্ত্রকল মালিকদের সংগঠন বিটিএমএ’র সভাপতি মোহাম্মদ আলী। বস্ত্রকলগুলোতে দৈনিক ১২ ঘণ্টা গ্যাস থাকে না বলে জানিয়েছেন তিনি। মোহাম্মদ আলী বলেন, ‘আমাদের সময় ও সম্পদের অপচয় হচ্ছে। সব মিলিয়ে বস্ত্রকল খাত অত্যন্ত নাজুক অবস্থার মধ্যে আছে।’ গ্যাস-বিদ্যুতের সংকটের কারণে গত কয়েক মাসে ১০ থেকে ৩৫ শতাংশ উৎপাদন খরচ বেড়েছে। এ ছাড়া প্রতিযোগী দেশগুলোর তুলনায় ক্রয়াদেশ, উৎপাদন ও রপ্তানিতে বাংলাদেশ পিছিয়ে পড়ছে বলে জানান মেট্রোপলিটন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি, ঢাকার (এমসিসিআই) সভাপতি মো. সাইফুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘আমাদের মতো সংকটে ভুগছে না সেসব দেশ। ফলে তারা ক্রেতাদের আস্থা পাচ্ছে , আর আমরা আস্থা হারাচ্ছি।’ ব্যবসায়ীদের এসব কথার উত্তরে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের এই প্রভাবশালী উপদেষ্টা সাফ জানিয়ে দেন স্পট মার্কেট থেকে কিনতে ছয় মাসে অন্তত ১ দশমিক ২বিলিয়ন ডলার লাগতে পারে। কিন্তু আমাদের রিজার্ভের যে অবস্থা, তাতে এই সিদ্ধান্তে যাওয়া ঝুঁকিপূর্ণ হবে। আগামী ছয় মাসে রিজার্ভ বাড়ারও সম্ভাবনা নেই।

এভাবে এলএনজি কেনা সম্ভব নয়। এ প্রসঙ্গে মনে পড়লো বেশি দিন আগের কথা নয়, অর্থনৈতিক সংকট তার করাল থাবা বসিয়েছে মাত্র, সরকারি দলের এক এমপিকে অর্থনীতি নিয়ে প্রশ্ন করায় তিনি লাইভ শোতে বলেছিলেন অর্থনীতি নিয়ে আমার সঙ্গে তার আলোচনা করাটাই নাকি তার জন্য অসম্মানজনক। শেয়ার বাজার নাড়াচাড়ায় (পড়ুন নয় ছয়ে) তার দীর্ঘ অভিজ্ঞতার কথা সর্বজনবিদিত। সম্ভবত সে কারণেই তিনি ছিলেন প্রয়োজনের চেয়ে বেশি আত্মবিশ্বাসী। বাংলাদেশের বর্তমানে রিজার্ভ কত তাকে বারবার এই প্রশ্ন করেও কোনো উত্তর পাইনি আমি। করোনার সময় উঠা ৪৮ বিলিয়ন ডলার রিজার্ভ এখন সরকারি বয়ান মতেই ৩৫ বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে। কিন্তু আইএমএফ বলছে, এর মধ্যে প্রায় ৮ বিলিয়ন ডলার রিজার্ভ থেকে বাদ দিতে হবে ইডিএফ লোনসহ আরও কিছু লোন বাবদ। তা হলে হাতে থাকে ২৭ বিলিয়ন ডলার। কিছুদিন আগেও মাসে আমদানি ব্যয় ৮ বিলিয়ন ডলারে গিয়ে ঠেকে ছিল, সরকার রাশ টানার পর যার পরিমাণ এখন ৬ বিলিয়ন ডলার। সুতরাং এই রিজার্ভ দিয়ে আগামী চার থেকে সাড়ে চার মাসের আমদানির খরচ মেটানো যাবে। অন্যদিকে রপ্তানি আয় এবং রেমিট্যান্সের অবস্থাও ভালো নয়।

বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ আশঙ্কাজনক। আগামী বছর শেষে বাংলাদেশের বিদেশি ঋণের পরিমাণ ১১৫ বিলিয়ন ডলার ছাড়াবে। আর ২০২৪ সাল শেষে বিদেশি ঋণের পরিমাণ দাঁড়াবে ১৩০ বিলিয়ন ডলারে। দেশের বৈদেশিক মুদ্রা বাজার নিয়ে করা এক পর্যবেক্ষণে সরকারি বেসরকারি খাতের বিদেশি ঋণ নিয়ে এ পূর্বাভাস দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলছে, ২০২১ সালে সুদসহ দেশের বৈদেশিক ঋণ পরিশোধের পরিমাণ ছিল ১১ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলার। গত বছরের ততুলনায় চলতি বছর বাংলাদেশকে দ্বিগুণ বিদেশি ঋণ পরিশোধ করতে হবে। ২০২২ সাল শেষে বিদেশি ঋণ পরিশোধের পরিমাণ গিয়ে ঠেকবে ২৩ দশমিক ৪ বিলিয়ন ডলারে। এর মধ্যে দেশের বেসরকারি খাতকে প্রায় ১৮ বিলিয়ন ডলার পরিশোধ করতে হবে। বাকি ৫ বিলিয়ন ডলার পরিশোধ করবে সরকার। তবেআগামী দুইবছর বিদেশি ঋণ পরিশোধের চাপ কিছুটা কমবে বলেমনে করছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এ সময়েও প্রতি বছর সুদসহ ২০ বিলিয়ন ডলারবিদেশি ঋণপরিশোধ করতে হবে বাংলাদেশকে।

একদিকে আমদানি রপ্তানির নামে ওভার এবং আন্ডার ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে টাকা পাচার, অন্যদিকে রপ্তানি আয় আর রেমিট্যান্সের নিম্নগতি সঙ্গে মাত্রাতিরিক্ত বৈদেশিক ঋণ পুরো বিষয়টিকে জটিল করে তুলেছে। সঙ্গে যুক্ত হয়েছে সরকারের তথ্য গোপনের প্রবনতা। সরকার রিজার্ভের যে তথ্য দিচ্ছে সেটি কতটা সঠিক তা নিয়েও আছে নানান প্রশ্ন। কারণ বিদ্যুৎ গ্যাসের এই ভয়াবহ সংকটের সময়ও সরকার জ্বালানি তেল ডিজেল বা এলএনজি আমদানি করতে পারছে না। প্রধানমন্ত্রীর বিদ্যুৎ ও জ্বালানি উপদেষ্টা শিল্প উদ্যোক্তাদের স্পষ্ট জানিয়ে দিচ্ছে রিজার্ভের এই অবস্থায় স্পট মার্কেট থেকে জ্বালানি আমদানি সম্ভব নয়। যে মন্ত্রী ভুলেও কখনো কথা বলেন না সেই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পর্যন্ত বলে ফেললেন বিদ্যুতের সংকট সহসা কাটছে না। কারণ জ্বালানি আমদানির মতো পর্যাপ্ত রিজার্ভ নেই। এই সব আলামত দেখে তাই প্রশ্ন জাগে আমাদের রিজার্ভ আসলে কতো?