মুক্তিযুদ্ধের চেতনা সমুন্নত রাখতে হবে

Published: 16 December 2022

ড. নিয়াজ আহম্মেদ


দীর্ঘ ৯ মাস যুদ্ধ, ৩০ লাখ শহীদ ও অসংখ্য মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে আমরা পেয়েছি একটি স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র বাংলাদেশ। যাঁদের রক্তের বিনিময়ে আমাদের দেশ, মহান বিজয়ের মাসে তাঁদের প্রতি রইল রক্তিম সালাম ও শুভেচ্ছা। যুদ্ধে অনেকে জীবন দিয়েছেন, আবার অনেকে বেঁচে আছেন কেউ বা পঙ্গু হয়ে। যাঁরা মারা গেছেন তাঁদের সন্তানদের দুঃখ-কষ্টের শেষ নেই।

আবার তাঁদের মধ্যে যাঁরা বাবাকে কখনো দেখতে পাননি তাঁদের কষ্ট অনেকের তুলনায় ঢের বেশি। বাবার স্মৃতি নিয়ে বেঁচে আছেন শুধু মা কিংবা অন্যের কাছে শুনে। বাবা বেঁচে থাকলে ছেলে কিংবা মেয়েটি ভালো লেখাপড়া শিখে বড় চাকরি করতেন, কিন্তু তা তো সম্ভব হয়নি। দেশ ও দেশের মানুষের প্রতি তাঁদের আত্মত্যাগ আমরা কজনই বা মনে রেখেছি। তাঁদের ত্যাগকে আমরা কিভাবে মূল্যায়ন করি। এ প্রশ্ন আজ আমাদের সামনে বড় হয়ে দেখা দিয়েছে। এর উত্তরও আমাদের পেতে হবে। কেননা আমাদের যাবতীয় অর্জনের পেছনে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। যে চেতনাকে ধারণ করে তরুণ-যুবা-বৃদ্ধ ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন যুদ্ধে, সেই চেতনাকে সামনে রেখেই আমরা তৈরি করেছি আমাদের সংবিধান। যার মূলমন্ত্র একটি অসাম্প্রদায়িক শোষণমুক্ত ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশ। আমাদের যাবতীয় প্রেরণার উৎস। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাস, আমরা সেই চেতনার জায়গায় আজও পুরোপুরি পৌঁছতে পারিনি।

গত ৫০ বছরেরও বেশি সময়ে আমরা স্বাধীন। এই সময়ে আমাদের অনেক উন্নয়ন হয়েছে। কিন্তু আমাদের ব্যর্থতাও কম নয়। আমাদের বড় ব্যর্থতা আমরা পুরোপুরি সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে পারিনি। আমরা একটি সম্পূর্ণ দুর্নীতিমুক্ত সমাজ তৈরি করতে পারিনি। আমাদের মধ্যে জবাবদিহি নেই। আর এসবের পেছনে বড় যে শক্তি কাজ করে তা হলো মুক্তিযুদ্ধের চেতনার অভাব। আমরা যত বেশি এই চেতনা থেকে দূরে সরে যাব তত বেশি সমস্যায় পড়ব। উন্নয়নকে ধারণ, লালন ও বিকশিত করতে হলেও চেতনা দরকার। মোদ্দাকথা, আমাদের সব কিছুর পেছনে কাজ করতে হবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার। স্বাধীনতার পর আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা পদে পদে বাধাগ্রস্ত হয়েছে। যার শুরুটা পঁচাত্তরের ১৫ আগস্টের পর থেকে। দীর্ঘ সময় আমাদের চেতনা থেকে দূরে সরিয়ে রাখা হয়েছিল। ১৯৯৬ সালে আমরা আশার আলো দেখতে পাই। কিন্তু ২০০১ সালে আমাদের বড় বিপর্যয় ঘটে। দেশ সম্পূর্ণভাবে বিপরীত মেরুতে চলে যায়। ২০০৯ সাল থেকে দীর্ঘ সময় আবার রাষ্ট্রক্ষমতায় বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। কিন্তু এখনো আমরা পুরোপুরি মুক্তিযুদ্ধের চেতনাসম্পন্ন সমাজ তৈরি করতে পারিনি।

মুক্তিযুদ্ধের সময় যারা ছোট কিংবা পরবর্তী সময়ে যাদের জন্ম, তাদের পক্ষে অনেক কিছুই সচক্ষে দেখা সম্ভব হয়নি। তাদের ভরসা বিভিন্ন বইপত্র, প্রমাণ্যচিত্র ও বড়দের কাছ থেকে শুনে বুঝতে পারা। আজকের তরুণ যুবকদের জন্ম যুদ্ধের অনেক পরে। তাদের চেতনার জায়গায় নিয়ে আসতে হলে সঠিক বিষয়টি জানাতে হবে। জানানোর জন্য যেমন দরকার সঠিক কৌশল ও পদক্ষেপ, আর জানার জন্য প্রয়োজন তাদের আগ্রহ। আমাদের কাছে মনে হয় দুটি জায়গায়ই ঘাটতি রয়েছে। কাউকে এককভাবে দোষ দেওয়া ঠিক নয়। কী রাজনীতিবিদ, শিক্ষক, পেশাজীবী, ব্যক্তি, সমাজ ও পরিবার—কেউই এ দায় এড়াতে পারেন না। আমরা আমাদের তরুণসমাজকে সঠিক নিদের্শনা দিতে পারছি না। ফলে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সঙ্গে সম্পর্কিত বিষয়ে তাদের মধ্যে বিভ্রান্তি কাজ করছে। যে দেশ গঠনে জাতির পিতার পুরো অবদান, যিনি স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছেন, তাঁকে বাদ দিয়ে একজন ঘোষণা পাঠককে স্বাধীনতার ঘোষক বলা হয়। আবার অনেকে তা বিশ্বাসও করে।

অথচ আমাদের প্রতিটি অর্জন ও সাফল্যের পেছনে প্রেরণা হিসেবে কাজ করে চেতনা ও মূলমন্ত্র। তাইতো আমাদের মুক্তিযুদ্ধকে পরাজিত শক্তি যখন বিকৃত করে এবং হুংকার দেয়, তখন তরুণ আমরাও চুপসে যাই। প্রতিবাদ করার সাহস হারিয়ে ফেলি। মুক্তিযোদ্ধা, প্রজন্ম ৭১ ও দু-একটি সংগঠন ও রাজনৈতিক দলকে প্রতিবাদ করতে দেখা যায়। বাকিরা একেবারে চুপ। এমন তো হওয়ার কথা নয়। কাদের মোল্লার ফাঁসির দাবিতে ২০১৩ সালে আমরা ফুঁসে উঠেছিলাম। কিন্তু আজ যখন একজন যুদ্ধাপরাধীর ছেলে বড় হুংকার দেন তখন শাহবাগের মতো আমরা ঝলসে উঠিতে পারি না। সময়ের ব্যবধান বেশি নয়, ২০১৩ থেকে ২০২২ মাত্র। এ জন্য বলছি এ দায় আমার, আপনার, সবার। আজকে আমাদের রাজনীতিবিদদের শপথ নিতে হবে যে তাঁরা মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী কোনো রাজনীতি করবেন না। আজকে শিক্ষকসমাজকে বলতে হবে তাঁরা শিক্ষার্থীদের সামনে মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস তুলে ধরবেন। বিভিন্ন পেশজীবী গোষ্ঠীকে যার যার অবস্থান থেকে দায়িত্ব পালন করতে হবে। পরিবারের বড়দের শিশুসন্তানদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় গড়ে তুলতে হবে।

উন্নয়ন একটি দেশের জন্য খুব দরকার। একই সঙ্গে চেতনাসম্পন্ন মানুষ তৈরি করতে হবে। তাহলে এমনিতেই দেশ অনেক এগিয়ে যাবে। আমরা এমন মানুষ তৈরি করব, যে অন্যায়ের প্রতিবাদ করবে, থাকবে ন্যায়ের পক্ষে। যে চেতনাকে ধারণ করে জীবন দিয়েছিলেন লাখ লাখ মানুষ, তাঁদের চেতনা আমাদের মাঝে বিরাজ করবে। বিজয়ের মাসে আমরা এমনটিই প্রত্যাশা করছি।

লেখক : অধ্যাপক, সমাজকর্ম বিভাগ, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়