বাংলা ভাষা আন্দোলনে ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের অবদান

Published: 17 February 2023

গাজীউল হাসান খান

তৎকালীন পূর্ব বাংলার সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের মুখের ভাষা বাংলাকে অগ্রাহ্য করে ‘একমাত্র উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা’, ১৯৪৮ সালের ২৪ মার্চ এ কথা বলেছিলেন মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলে এক বিশেষ কনভোকেশন উপলক্ষে আয়োজিত বর্ণাঢ্য অনুষ্ঠানে পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা জিন্নাহ সেই বাক্যটি উচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গেই ‘না, না’ বলে প্রতিবাদ জানিয়েছিল বাংলার জাগ্রত ছাত্রসমাজ। এর আগে জিন্নাহ ঢাকায় আগমন করেন ১৯৪৮ সালের ১৯ মার্চ এবং ২১ মার্চ তিনি ঢাকার তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে উপস্থিত জনতার উদ্দেশে এক ভাষণ দেন। তাতে তিনি নবগঠিত পাকিস্তান রাষ্ট্রের অস্তিত্বের বিরুদ্ধে এক ষড়যন্ত্রের পূর্বাভাস দিয়েছিলেন। পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা কী হওয়া উচিত, সেটা নিয়ে বলিষ্ঠভাবে কারো বক্তব্য উত্থাপন করাই কি ছিল জিন্নাহর উল্লিখিত ষড়যন্ত্রের পূর্বাভাস?

ঢাকার কার্জন হলে পাকিস্তানের ‘একমাত্র রাষ্ট্রভাষা’ প্রসঙ্গে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর বক্তব্য দেওয়ার প্রায় এক মাস আগে অর্থাৎ ১৯৪৮ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি পূর্ব বাংলার গণপরিষদ সদস্য ও কুমিল্লার বিশিষ্ট রাজনীতিক শ্রী ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ভাষা বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি উত্থাপন করেন। এ প্রসঙ্গে ‘মুক্তি সংগ্রামে কুমিল্লা’ গ্রন্থের লেখক আবুল কাশেম হৃদয় লিখেছেন, ‘বাংলা ভাষার কলকাকলীতে মুখরিত অঞ্চল ঢাকা কিংবা কলকাতায় নয়, খোদ পাকিস্তানের তৎকালীন রাজধানী করাচিতে গিয়ে পাকিস্তানের গণপরিষদের প্রথম অধিবেশনে (২৫ ফেব্রুয়ারি ১৯৪৮) তৎকালীন কংগ্রেস দলের প্রতিনিধি ও পূর্ব বাংলার গণপরিষদ সদস্য ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত (১৮৮৬-১৯৭১) উর্দু এবং ইংরেজির সঙ্গে বাংলা ভাষাকে গণপরিষদের অন্যতম ভাষা হিসেবে স্বীকৃতির দাবি পেশ করেন। ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত নিয়মিত কার্যবিধির ২৮ ধারার ওপর একটি সংশোধনী প্রস্তাব এনে তাঁর বক্তব্যে বলেন, ‘এই প্রস্তাব প্রাদেশিকতা মনোভাবপ্রসূত নয়। পাকিস্তানের জনসংখ্যা ছয় কোটি ৯০ লাখ, তার মধ্যে চার কোটি ৪০ লাখই বাংলা ভাষাভাষী। সেই যৌক্তিক ভিত্তির ওপরই তিনি তাঁর প্রস্তাবটি উত্থাপন করেছিলেন। তখন তিনি আরো বলেছিলেন, সংখ্যাগরিষ্ঠতার কথিত বা ব্যবহৃত ভাষাই রাষ্ট্রের ভাষা হওয়া বাঞ্ছনীয়। সেই বিবেচনায় বাংলাই পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হওয়া উচিত।’

স্বনামধন্য রাজনীতিক ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত সম্পর্কে বলতে গিয়ে লেখক, সাংবাদিক আবুল কাশেম হৃদয় আরো বলেছেন, ‘নবগঠিত পাকিস্তানে একজন বাঙালির পক্ষে এ সাহস প্রদর্শন ছিল এক অবিস্মরণীয় ঘটনা। গণপরিষদে ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত যে বক্তব্য রেখেছিলেন, তার কিয়দংশ এখানে উদ্ধৃত করা হলো : ‘I know, sir, that Bengali is a provincial language, but, so far our state is concerned, it is the language of the majority of the people of the state and it stands on a different footing. Out of six crores and ninety lakhs of people inhabiting this state, four crores and forty lakhs of people speak the Bengali language. So, sir what should be the state language of the state Pakistan? The state language of the state should be the state language which is used by the majority of the people of the state, and for that, sir, I consider that Bengali language is lingo franca of our state…. So we are to consider that in our state it is found that the majority of the people of the state do speak the Bengali language, then Bengali should have an honored place even in the central government.’

তথ্যসূত্র মতে আরো জানা যায়, ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের সেই ঐতিহাসিক প্রস্তাবের বিরোধিতা করে বক্তব্য রেখেছিলেন পাকিস্তানের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান, পূর্ব পাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দীন ও গণপরিষদের সহসভাপতি মৌলভি তমিজউদ্দিন খান। অন্যদিকে ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের প্রস্তাবের পক্ষ সমর্থন করেছিলেন দিনাজপুরের গণপরিষদ সদস্য শ্রীযুক্ত প্রেমহরি। এ ছাড়া প্রস্তাবের পক্ষে যুক্তিপূর্ণ বক্তব্য দিয়েছিলেন শ্রী ভূপেন্দ্রনাথ ও শ্রীশচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। লেখক, সাংবাদিক আবুল কাশেমের মতে, প্রস্তাবকারী ও সমর্থনকারী সবাই ছিলেন তৎকালীন কংগ্রেস দলের সদস্য এবং বাঙালি হিন্দু। তথ্য মতে, সেদিন গণপরিষদের ৭৯ সদস্যের মধ্যে পূর্ববঙ্গের ৪৪ জন উপস্থিত থাকা সত্ত্বেও মুসলিম ঐক্যের বিরোধ ও সাম্প্রদায়িকতার গন্ধ খুঁজে মুসলিম বাঙালি সদস্যরা প্রস্তাবের বিপক্ষে ভোট দেওয়ায় কণ্ঠভোটে প্রস্তাবটি বাতিল হয়ে যায়। এখানে উল্লেখ্য, ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট পাকিস্তান সৃষ্টির পর থেকেই ক্ষমতাসীন পশ্চিম পাকিস্তানিরা বাংলা ভাষার বিরুদ্ধাচরণ শুরু করেছিল। কিন্তু তার মধ্য দিয়েই পূর্ব বাংলাব্যাপী ব্যাপক বাংলাভাষী মানুষের মধ্যে বাংলা ভাষা আন্দোলনের আনুষ্ঠানিকভাবে সূত্রপাত ঘটে। আর সেই ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়েই ক্রমে ক্রমে বাঙালি জাতিসত্তার উন্মেষ ঘটেছিল বলে মনে করা হয়।

লেখক, সাংবাদিক আবুল কাশেমের তথ্য অনুযায়ী, পাকিস্তানের করাচি থেকে ফিরে ১৯৪৮-৪৯ সালে ভাষাসংগ্রামের রূপকার ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত তাঁর জেলা শহর কুমিল্লায় এসে আন্দোলন গড়ে তুলতে সহায়তা করেন। তাঁর প্রত্যক্ষ সাহায্য-সহযোগিতার কারণে মাতৃভাষা বাংলা প্রতিষ্ঠার দাবিতে আন্দোলন শুধু যে দানা বেঁধে উঠেছিল তা-ই নয়, কাঙ্ক্ষিতভাবে গতিও লাভ করেছিল। এ ছাড়া ঢাকায় কেন্দ্রীয়ভাবে তিনি ভাষার দাবিকে বাস্তবায়িত বা ফলপ্রসূ করার জন্য নিরলসভাবে প্রচেষ্টা চালিয়ে যান। জানা যায়, ভাষাসৈনিক আবদুল মতিন, অলি আহাদ ও গাজীউল হকসহ অন্য নেতৃস্থানীয় ছাত্রদের সঙ্গে একজন গণপরিষদ সদস্য হিসেবে তাঁর যথেষ্ট যোগাযোগ ছিল। তখন প্রাদেশিক পরিষদ ভবন ছিল বর্তমান জগন্নাথ হলের পাশের আঙিনায়। সেখান থেকে তৎকালীন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলা কিংবা মেডিক্যাল কলেজের সামনের চত্বরে যাওয়া-আসা করাটা তেমন কোনো দুঃসাধ্য ব্যাপার ছিল না। তবে ১৯৫২ থেকে ১৯৫৪-তে ঘটে যাওয়া অর্থাৎ ভাষা আন্দোলন থেকে যুক্তফ্রন্টের অধীনে নির্বাচনের সময় ঢাকা ও কুমিল্লার মধ্যে নিয়মিত যাওয়া-আসা করাটা ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের জন্য কিছুটা কঠিন হয়ে পড়েছিল সড়ক যোগাযোগ বিভ্রাটের কারণে। ওই সময় তিনি নিয়মিত রেলে ভ্রমণ করে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে যোগ দিতেন বলে জানা যায়।

আবুল কাশেম প্রণীত ‘মুক্তি সংগ্রামে কুমিল্লা’ গ্রন্থ ছাড়াও বিভিন্ন সূত্রে পাওয়া তথ্য থেকে জানা যায়, ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি দেশের অন্যান্য আন্দোলনমুখর স্থানের মতো কুমিল্লা শহর ও আশপাশের অঞ্চলে রাষ্ট্রভাষার দাবিতে পূর্ণ হরতাল পালিত হয়েছিল। সব স্কুল-কলেজের ছাত্র-ছাত্রীরা দলবদ্ধভাবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অনুপস্থিত থাকে। শহরে সব দোকানপাট ও যানবাহন চলাচল বন্ধ ছিল। ছাত্রদের এক বিরাট মিছিল ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ স্লোগান দিতে দিতে শহর প্রদক্ষিণ করেছিল। বিকেলে কুমিল্লা টাউন হলের সামনে উন্মুক্ত প্রান্তরে তাত্ক্ষণিকভাবে ঢাকায় ছাত্রহত্যার প্রতিবাদে বিশাল সভা অনুষ্ঠিত হয়েছিল। তাতে সভাপতিত্ব করেন তৎকালীন রাজনৈতিক নেতা আবদুর রহমান খান। সেই ধারায় ২৬ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সারা কুমিল্লা আন্দোলনমুখর ছিল। শহর থেকে গ্রামাঞ্চলে অর্থাৎ সর্বত্রই প্রতিবাদসভা ও মিছিলের আয়োজন করা হয়েছিল। এ ছাড়া ৩ মার্চ ছাত্রদের অনির্দিষ্টকালের হরতালকে কেন্দ্র করে আয়োজিত ‘শোক দিবস’ এবং বিশেষ করে ৫ মার্চ ‘শহীদ দিবস’ পালন উপলক্ষে টাউন হলে আয়োজিত সভাকে কেন্দ্র করে পুলিশ বাধার সৃষ্টি করে। দেখতে দেখতে ৫ মার্চ কুমিল্লার সার্বিক পরিস্থিতি অত্যন্ত উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। সেই অবস্থায় কয়েকজন ছাত্রনেতাকে পুলিশ গ্রেপ্তার করলে প্রায় ১০ হাজার ছাত্র-জনতা সঙ্গে সঙ্গে থানা ঘেরাও করতে যায়। আন্দোলনের সেই ধারাবাহিকতায় ৯ মার্চ পর্যন্ত কুমিল্লায় ১৭ জন নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল বলে জানা যায়। সেই আন্দোলনে কুমিল্লার বিশিষ্ট রাজনৈতিক নেতা ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত, তৎকালীন পৌরসভার চেয়ারম্যান অতীন্দ্রমোহন রায়, অধ্যাপক মফিজুল ইসলামসহ অনেকে উৎসাহ, পরামর্শ ও সহযোগিতা প্রদান করেন। বাঙালির মাতৃভাষা বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করার আন্দোলন বায়ান্নতেই থেমে যায়নি। ঢাকাসহ সারা দেশের মতো কুমিল্লার গণ-আন্দোলনও বিভিন্ন চড়াই-উতরাইয়ের মধ্য দিয়ে চুয়ান্নর যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন পর্যন্ত দীর্ঘায়িত হয়েছিল।

যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে বাঙালির অভূতপূর্ব প্রাদেশিক সাফল্যের ফসল শেষ পর্যন্ত ঘরে তোলা সম্ভব হলো না। পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারের ষড়যন্ত্রে দুই বছরের মাথায় সব শেষ হয়ে গেল। পশ্চিম পাকিস্তানি স্বৈরশাসকরা পূর্ব বাংলায় যুক্তফ্রন্ট সরকার ভেঙে দিয়েছিল। সে কারণে অনেক ভেবেচিন্তে এক নতুন রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে বাঙালি ছাত্র-জনতার অবিসংবাদিত নেতা শেখ মুজিবুর রহমান পূর্ব বাংলার পূর্ণ স্বায়ত্তশাসনসহ ছয় দফা দাবি নিয়ে আন্দোলনের মাঠে নেমেছিলেন ১৯৬৬ সালে। সেই আন্দোলন দানা বেঁধে ওঠার আগেই গ্রেপ্তার করা হয়েছিল তাঁকে। তাঁর বিরুদ্ধে ‘আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা’ নামে এক মিথ্যা অভিযোগ দায়ের করা হয়েছিল। প্রাজ্ঞ প্রবীণ রাজনীতিক ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে আনীত মিথ্যা মামলার প্রতিবাদ করে তাঁর ছয় দফা রাজনৈতিক কর্মসূচিকে সমর্থন দিয়েছিলেন। বয়সের ভারে ন্যুব্জ ধীরেনবাবু তখন সক্রিয় রাজনীতি থেকে অনেকটা দূরে সরে এসেছেন। কুমিল্লার ধর্মসাগরের পশ্চিম পারে টিন ও কাঠের নবনির্মিত এক প্রশস্ত বারান্দাওয়ালা বাড়িতে বাস করতেন তিনি। সকাল-বিকেল সামনের বারান্দায় এক ইজিচেয়ারে বসে পরিচিত পথচারীদের কাছে দেশের খবর, রাজনীতির খবর নিতেন উৎসাহভরে। ষাটের দশকের মাঝামাঝি তেমন একটি পরিবেশেই তাঁর সঙ্গে আমার কথোপকথন শুরু হয়েছিল। মণীন্দ্র নামে তাঁর বাড়িতেই একসময় আমার একজন স্কুলের সহপাঠী বাস করত। এ ছাড়া তাঁর নাতনি আরমা দত্ত (বর্তমানে জাতীয় সংসদে সংরক্ষিত আসনের একজন সদস্য) আমার সঙ্গে কুমিল্লা কনভেন্ট স্কুলে পড়তেন। তবে আমার নিচের ক্লাসে পড়তেন বলে তাঁর সঙ্গে আমার তেমন ঘনিষ্ঠতা গড়ে ওঠেনি। ভিক্টোরিয়া কলেজে পড়াশোনাকালীন আমি পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নে একজন নেতৃস্থানীয় সংগঠক ছিলাম। সেই কারণে নিভৃতচারী প্রাজ্ঞ প্রবীণ রাজনীতিক ধীরেনবাবুর সঙ্গে বিভিন্ন সময়ে আমার কিছু কথোপকথন হতো। এ ছাড়া তিনি ছিলেন আমার নানার একজন রাজনৈতিক বন্ধু। সে কারণে আমি আমার বন্ধু-বান্ধবকে তামাশা করে বলতাম, ধীরেনবাবু গ্রাম সুবাদে আমার নানা।

তারপর আমি ষাটের দশকের শেষ দিকে কুমিল্লা ছেড়ে চলে যাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। গভীরভাবে জড়িত হয়ে পড়ি বাম ছাত্ররাজনীতির সঙ্গে। দ্রুত একের পর এক ঘনিয়ে আসে উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান, সত্তরের নির্বাচন এবং শেষ পর্যন্ত পঁচিশে মার্চের কালরাত্রি। যোগ দিই মুক্তিযুদ্ধে। ওই সময়টায় একই পাড়ার এ-প্রান্তে ও-প্রান্তে থাকলেও কুমিল্লায় গেলে খুব কমই দেখা হয়েছে ধীরেনবাবুর সঙ্গে। ক্যান্টনমেন্ট শহর হিসেবে কুমিল্লার ওপর সামরিক বাহিনীর ইন্টেলিজেন্সের নজরদারি ছিল অত্যন্ত প্রখর। বাংলা ভাষা, স্বাধিকার আন্দোলন ও বিভিন্ন রাজনৈতিক ইস্যুতে ধীরেনবাবুর বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার কথা ভোলেনি সামরিক বাহিনীর ইন্টেলিজেন্স। তাই একাত্তরের ২৯ মার্চ তাঁর কুমিল্লার বাসভবন থেকে একসময়ের কৌশলী ধীরেন্দ্রনাথ দত্তকে (তাঁর কনিষ্ঠ পুত্র দিলীপ দত্তসহ) ময়নামতি সেনানিবাসে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে কাজ করা নাপিত বা ক্ষৌরকর্মী রমণী শীলের জবানিতে পরে জানা যায়, আমাদের ভাষা আন্দোলনের রূপকার ও বিশিষ্ট রাজনীতিক ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের ওপর নির্মম অত্যাচার চালায় পাকিস্তানি বাহিনী। তাঁর কাছ থেকে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ তথ্য বের করার জন্য নিষ্ঠুরভাবে দৈহিক নির্যাতন চালায় পাকিস্তানিরা। সর্বাঙ্গে জখম নিয়ে তাঁকে হামাগুড়ি দিয়ে টয়লেটে যেতে দেখেছেন রমণী শীল। শক্তিশালী আঘাতের কারণে তাঁর একটা চোখ প্রায় বেরিয়ে গিয়েছিল, ফুলে গিয়েছিল সারাটা মুখ এবং সম্ভবত মেরে ভেঙে ফেলা হয়েছিল তাঁর বাঁ পা। তিনি তখন কোনোমতেই দাঁড়াতে পারছিলেন না। এভাবে এক পর্যায়ে গুলি করে হত্যা করা হয়েছিল মনীষীতুল্য এই ব্যক্তিকে। একটি নিচু জায়গায় কিংবা গর্তের পারে নিয়ে দত্ত বাবুকে গুলি করা হয়েছে বলে উল্লেখ করেছেন রমণী শীল। কিন্তু সঠিকভাবে তারিখটি বলতে পারেননি তিনি। বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী কিংবা ৫০ বছর পেরিয়ে গেলেও আমাদের ভাষা আন্দোলনের এই পথিকৃৎ এবং বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলনের রূপকার ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের স্মৃতি অম্লান করে রাখার জন্য জাতীয় পর্যায়ে এখনো তেমন কিছু করেনি আমাদের সরকার। তাঁর নামে কুমিল্লা স্টেডিয়ামের নামকরণ হলেও স্থানীয় কিশোর কিংবা যুবা বয়সের অনেকেই এখনো জিজ্ঞেস করে—ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত কে? তিনি কিসের জন্য খ্যাতি লাভ করেছিলেন?

 

লেখক : বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার (বাসস) সাবেক প্রধান সম্পাদক ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক, শব্দসৈনিক স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র

gaziulhkhan@gmail.com