বাংলাদেশের জ্বালানির উৎস প্রসঙ্গে

Published: 9 April 2023

প্রফেসর ড. ম তামিম

বর্তমানে আমরা জ্বালানির যেসব উৎস বা সূত্র প্রত্যক্ষ করি, তার মধ্যে একটি হচ্ছে দেশীয় বা অভ্যন্তরীণ সূত্র এবং অন্যটি বিদেশি সূত্র। বিদেশি সূত্র মানে হচ্ছে, আমদানিকৃত জ্বালানি শক্তি। দেশীয় সূত্রে আমাদের দুটিমাত্র জ্বালানি উৎস আছে। এর মধ্যে একটি হচ্ছে, প্রাকৃতিক গ্যাস এবং অন্যটি কয়লা। গ্যাসের ক্ষেত্রে আমরা লক্ষ করছি, গত প্রায় ২০ বছর ধরে কোনো বড় ধরনের অনুসন্ধান ও উত্তোলনের কাজ করা হয়নি। গ্যাসের ক্ষেত্রে যা কিছু হয়েছে, সেগুলো মূলত ডেভেলপমেন্ট বা উন্নয়নের কাজ। গ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলনের ক্ষেত্রে তেমন কিছুই করা হয়নি। গত ১০/১২ বছরে গ্যাসের যে উত্তোলন বৃদ্ধি হয়েছে, তা মূলত আইওসি ফিল্ড থেকে। আইওসি তাদের বিবিয়ানা গ্যাস ক্ষেত্রে থেকে উত্তোলন অনেক বৃদ্ধি করেছে। তারা ৬০০/৭০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস উত্তোলন বৃদ্ধি করেছে। দেশীয় গ্যাস ফিল্ড থেকেও প্রায় ৩০০/৪০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস উত্তোলন বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০১৬ সালে সর্বোচ্চ ২ হাজার ৭৫০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস উত্তোলিত হয়েছে। তারপর থেকে গ্যাস উত্তোলন কমতে শুরু করেছে। এখন গ্যাস উত্তোলনের পরিমাণ ২ হাজার ৩০০ মিলিয়ন ঘনফুটের নিচে নেমে গেছে। ২০১৬-২০১৭ সালের তুলনায় বর্তমানে আমাদের গ্যাসের ঘাটতি হচ্ছে প্রায় ৪০০ মিলিয়ন ঘনফুট। ২০১৮ সাল থেকে গ্যাসের এই ঘাটতি পূরণের জন্য এলএনজি (লিকুইফাইড ন্যাচারাল গ্যাস) আমদানি করা হচ্ছে। এই হচ্ছে আমাদের দেশের গ্যাসের পরিস্থিতি। আমি মনে করি, বর্তমানে দেশীয় প্রতিষ্ঠানের অধীনে যেসব গ্যাস ফিল্ডগুলো আছে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করা হলে, সেখান থেকে আরো অতিরিক্ত গ্যাস উত্তোলন করা সম্ভব। সেই উত্তোলন কার্য সম্পাদনের জন্য যে অনুসন্ধান, টেকনোলজি, এক্সপার্টিজ এবং বিনিয়োগে প্রয়োজন তার কোনোটাই আমাদের দেশীয় প্রতিষ্ঠানের নেই। আমরা যদি গ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলনের জন্য উপযুক্ত কোনো তৃতীয় পক্ষকে দায়িত্ব দেওয়া হয়, তাহলে তারা তাদের সামর্থ্য অনুযায়ী অনুসন্ধান ও উত্তোলন কাজ করতে পারবেন। এ কাজের জন্য বিপুল পরিমাণ বিনিয়োগ করতে হবে। এই বিনিয়োগ তারা করতে পারবেন। কারণ তাদের সেই সামর্থ্য আছে। আমরা যদি গ্যাসে অনুসন্ধান ও উত্তোলনের জন্য এক বিলিয়ন মার্কিন ডলারও বিনিয়োগ করি এবং তাতে ৩০০/৪০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস উত্তোলন করা সম্ভব হবে। এটা আমাদের জন্য আনুপাতিক হারে অত্যন্ত লাভজনক বলে বিবেচিত হবে। একই সঙ্গে নতুন নতুন গ্যাস ক্ষেত্রে অনুসন্ধানের বিষয়টিও গুরুত্ব দিতে হবে। অফশোর, অনশোর দুই স্থানেই আমরা বিডিং করতে পারি। বর্তমানে আন্তর্জাতিক বাজারে গ্যাসের যে মূল্য আছে, সেই তুলনায় আমরা যদি অফশোরে ৭/৮ মার্কিন ডলার দেই, তাহলেও আমাদের গড় খরচ পড়বে ৪/৫ মার্কিন ডলার। কারণ উত্তোলিত গ্যাসের কিছু অংশ আমরা ফ্রি পাব। প্রোডাকশন শেয়ারিং কন্ট্রাক্টের (পিএসসি) মাধ্যমে বিদেশি কোম্পানিকে এই কাজে নিয়োজিত করা যেতে পারে। অফশোরে গ্যাস পাওয়া যাবে কি যাবে না, তা নিশ্চিত হওয়ার জন্য ব্যাপকভিত্তিক অনুসন্ধান চালাতে হবে। অনুসন্ধানের জন্য যে সার্ভে করার কথা ছিল, তা আমরা করতে পারিনি। কেন পারিনি তা আমি নিশ্চিত করে বলতে পারব না। ২০১৪ সালে ভারত ও মিয়ানমারের সঙ্গে আমাদের আন্তর্জাতিক সমুদ্রসীমা চিহ্নিত হয়েছে। এরপর সমুদ্র অঞ্চলে গ্যাস সার্ভের জন্য দুইবার টেন্ডার আহ্বান করা হয়েছে। দুই বারই একই কোম্পানি সার্ভের কাজের জন্য সিলেক্টেড হয়েছে। কিন্তু রহস্যজনক কারণে শেষ পর্যন্ত টেন্ডার বাতিল করা হয়েছে। বাংলাদেশের সমুদ্রসীমায় সার্ভের জন্য জরুরি ভিত্তিতে উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন। কারণ আমাদের সমুদ্রসীমায় আসলেই কোনো গ্যাস আছে কিনা, তা নিশ্চিত হওয়া প্রয়োজন। বাংলাদেশের সমুদ্রসীমায় গ্যাস আছে কিনা, তা জানার জন্য আমাদের তথ্য দরকার। যত বেশি তথ্য পাওয়া যাবে ততই অনুধাবন করা যাবে, আসলে গ্যাস আছে কিনা। আর থাকলেও কি পরিমাণ আছে। গ্যাস পাওয়ার সম্ভাবনার ওপর নির্ভর করবে আমরা বিদেশি কোম্পানির সঙ্গে ভালো পিএসসি করতে পারব কিনা। গ্যাসপ্রাপ্তির সম্ভাবনার ওপর চুক্তি স্বাক্ষর করার ক্ষেত্রে আমাদের শক্তি নির্ভর করবে। যদি পর্যাপ্ত পরিমাণে গ্যাস পাওয়ার সম্ভাবনা থাকে, তাহলে আমরা চুক্তিভুক্ত বিদেশি কোম্পানির সঙ্গে দরকষাকষি করতে পারব। আর যদি গ্যাসের পরিমাণ কম থাকে, তাহলে আমাদের শক্তি কমে যাবে। বিদেশি কোম্পানিকে বেশি সুবিধা দিতে হবে। কাজেই সমুদ্রসীমায় গ্যাস আছে কিনা এবং থাকলে তা কত পরিমাণে আছে, এটা সবার আগে নিশ্চিত হওয়া প্রয়োজন। ঝুঁকি এবং পুরস্কারের ভারসাম্যের মাধ্যমেই পিএসসি স্বাক্ষরিত হয়। ঝুঁকিটা বোঝার জন্য সঠিক তথ্য দরকার। কিন্তু ঝুঁকির মাত্রা বোঝার জন্য যে অনুসন্ধান কার্য সম্পাদন করার কথা ছিল, তা করা হয়নি। করা হয়নি তার মানে কখনোই করা হবে না, তা নয়। আমরা এলএনজি আমদানি করছি। এর পাশাপাশি সমুদ্রসীমায় গ্যাসপ্রাপ্তির সম্ভাবনা অনুসন্ধান করা প্রয়োজন।

বাংলাদেশের জ্বালানির দ্বিতীয় উৎস হচ্ছে কয়লা। প্রধানমন্ত্রী প্রথম থেকেই বলে রেখেছেন আমরা কয়লা উত্তোলন করব না। এই যে আমরা জাতীয় পর্যায়ে একটি সিদ্ধান্ত নিয়ে রেখেছি, আমি মনে করি তা পর্যালোচনা করার প্রয়োজন রয়েছে। বর্তমানে আমরা কয়লাভিত্তিক বিদ্যুত্ উৎপাদন করছি। এই প্রকল্পের জন্য প্রয়োজনীয় কয়লা বিদেশ থেকে আমদানি করতে হচ্ছে। কয়লা আমদানির ক্ষেত্রেও আমাদের অনেক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হচ্ছে। বাংলাদেশে কয়েকটি বড় কয়লা খনি আছে, যেমন, বড় পুকুরিয়া এবং ফুলবাড়িয়া কয়লা খনি। এই দুটি কয়লা খনিতেই ‘ওপেন কাট’ মাইনিং করা সম্ভব। ওপেন কাট মাইনিং করতে গেলে বেশ কিছু কঠিন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে। ওপেন কাট মাইনিং করতে গেলে পরিবেশের ওপর তার বিরূপ প্রভাব পড়বে। বিশেষ করে পানির ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে সমস্যা সৃষ্টি হবে। আমাদের আন্ডার গ্রাউন্ডে একটি বড় জলাধার আছে, সেটা কয়লাখনির ওপরে অবস্থিত। সেই পানি কীভাবে ম্যানেজ করব, সেটাই একটি বড় চ্যালেঞ্জ। এশিয়া এনার্জি এ ব্যাপারে একটি প্রস্তাব দিয়ে রেখেছে। তারা টেকনিক্যালি দেখিয়েছিল, কীভাবে সেই পানিটাকে ম্যানেজ করবে। কিন্তু বাংলাদেশের পক্ষ থেকে তাদের সেই প্রস্তাব নিয়ে কোনো পরীক্ষানিরীক্ষা করা হয়নি। এই পরীক্ষানিরীক্ষা না করার কারণে আমরা জানতে পারছি না কয়লা উত্তোলনের ঝুঁকি কতটুকু। তৃতীয় পক্ষ, যাদের এখানে কোনো স্বার্থ নেই, এমন প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে সমীক্ষা চালানো প্রয়োজন। যদি দেখা যায়, ঝুঁকির মাত্রা সহনীয় পর্যায়ে থাকবে, তাহলে আমাদের কয়লা উত্তোলনের উদ্যোগ নেওয়া দরকার। আর যদি ঝুঁকির মাত্রা অসহনীয় মাত্রায় থাকে, তাহলে কয়লা উত্তোলনের পরিকল্পনা বাদ দিতে হবে। কারণ জ্বালানি খাতে আমাদের আত্মনির্ভরশীলতা অর্জন করা খুবই প্রয়োজন। যদিও শেষ পর্যন্ত এই ফসিল ফুয়েল শেষ হয়ে যাবে। কিন্তু যতদিন চালানো যায়, সেই উদ্যোগ নিতে হবে। আমাদের এক সময় রিনিউয়েবল এনার্জির দিকে আরো এগোতে হবে। অথবা নতুন ধরনের কোনো জ্বালানি শক্তির ওপর নির্ভর করতে হবে। নিউক্লিয়ার এনার্জির ওপর জোর দিতে হবে। জ্বালানির নতুন নতুন আরো অনেক সূত্র আবিষ্কৃত হতে পারে। আমি মনে করি, আগামী ২০ অথবা ৩০ বছর আমাদের ফসিল ফুয়েলের ওপর নির্ভরতা থাকবে। রিনিউয়েবল এনার্জি আমরা অনেক বেশি উৎপাদন করতে পারব, এমনটা নয়। যদিও এক্ষেত্রে অনেকেই আশার বাণী শোনাচ্ছেন। কিন্তু রিনিউয়েবল এনার্জি উৎপাদন করা বাস্তবে অনেক কঠিন। রিনিউয়েবল এনার্জির ক্ষেত্রে আরো সমস্যা আছে। দিনের বেলা যখন সূর্যের কিরণ থাকে, তখন রিনিউয়েবল এনার্জি উৎপাদন করা সম্ভব। রাতের বেলা উৎপাদন করা সম্ভব হবে না। আবার বায়ু বিদ্যুতের ক্ষেত্রেও সমস্যা আছে। বাতাসের গতিবেগ কেমন থাকবে তার ওপর এটা নির্ভর করছে। আমাদের একটি প্রকল্প চলমান আছে। এই প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে আমরা বুঝতে পারব কি পরিমাণ বিদ্যুত্ পাওয়া সম্ভব হবে। তারপর পরবর্তী সময়ে আরো প্রকল্প গৃহীত হতে পারে। বায়ু বিদ্যুত্ প্রকল্পে রেজাল্ট যদি ইতিবাচক হয়, তাহলে ভালো। আর নেতিবাচক হলে আমাদের বিকল্প কোনো উৎস নিয়ে ভাবতে হবে। বায়ু বিদ্যুত্ ও সোলার এনার্জি যদি এক সঙ্গে থাকে তাহলে হয়তো আমরা কিছু একটা পাবো। রিনিউয়েবল এনার্জি থেকে ফুয়েল সাশ্রয় করা যাবে। কিন্তু আমরা যে বিপুল পরিমাণ বিদ্যুত্ চাই, তা হয়তো এখান থেকে পাওয়া যাবে না। এজন্য আমাদের স্টোরেজ করতে হবে। পৃথিবীতে নানাভাবে স্টোরেজ করা হয়। স্টোরেজ খুবই ব্যয় বহুল একটি প্রক্রিয়া। গ্যাস,বিদ্যুতের চাহিদা যে অবস্থায় আছে, তা যদি বহাল থাকে, তাহলে আমাদের কয়লা উত্তোলনের দিকে যেতেই হবে। (নিবন্ধের বাকি অংশ পরবর্তী সময়ে প্রকাশ করা হবে)

লেখক : ডিপার্টমেন্ট অব পেট্রোলিয়াম অ্যান্ড মিনারেল রিসোর্সেস ইঞ্জিনিয়ারিং, বাংলাদেশ ইউনির্ভাসিটি অব ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড টেকনোলজি (বুয়েট)
অনুলিখন : এম এ খালেক