কোন দিকে যাচ্ছে ন্যাটো

Published: 21 July 2023

গাজীউল হাসান খান

 

প্রায় এক দশক ধরে ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাখোঁ পশ্চিমা সামরিক জোট ন্যাটো সম্পর্কে তাঁর অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ বিভিন্ন অভিজ্ঞতা ও প্রতিক্রিয়ার কথা ব্যক্ত করে এসেছেন। তিনি প্রথমবারের মতো ফ্রান্সের রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার কিছুদিন পর থেকে প্রকাশ্যে বলতে শুরু করেছিলেন, ‘ন্যাটো একটি দূরদৃষ্টিহীন ও অকার্যকর মস্তিষ্কসম্পন্ন (ব্রেন ডেড) প্রতিষ্ঠান, যা কোনো মতেই ইউরোপের স্বার্থ বা নিরাপত্তা বিধানের উপযোগী নয়। ইউরোপকে তার নিজস্ব নিরাপত্তাব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে।’ যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে ১২টি পশ্চিমা দেশ নিয়ে ১৯৪৯ সালে ন্যাটো নামে যে সামরিক জোট গঠন করা হয়েছে তা বৃহত্তর অর্থে শুধু বিশ্বের অন্যতম প্রধান সামরিক পরাশক্তি মার্কিনদের স্বার্থেরই প্রতিনিধিত্ব করে।

এ কথা মুখে না বললেও ম্যাখোঁ পূর্ব ইউরোপীয় ন্যাটো সদস্যভুক্ত দেশগুলোর সামরিক দিক থেকে নিরাপত্তার ক্ষেত্রে অপ্রতুলতার কথা তুলে ধরেছেন। বলেছেন, ন্যাটোভুক্ত নব্য ইউরোপীয় দেশগুলোর সামরিক নিরাপত্তার বিষয়টি অত্যন্ত ভঙ্গুর। সে অবস্থায় ২০১৬ সালে অনুষ্ঠিত যুক্তরাষ্ট্রের ৪৫তম প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত হয়েছিলেন রিপাবলিকান দল মনোনীত ব্যবসায়ী ডোনাল্ড ট্রাম্প। নির্বাচিত হয়েই ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রের ব্যাবসায়িক স্বার্থ খোঁজা শুরু করেছিলেন।
তিনি বলেছিলেন, ইউরোপকে তাঁর নিজস্ব প্রতিরক্ষাব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে ইউরোপের তথাকথিত নিরাপত্তার প্রশ্নে ৭০ থেকে ৭৫ শতাংশ খরচ বহন করা আর সম্ভব নয়। ন্যাটোকে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে টিকিয়ে রাখতে হলে সদস্যপ্রতি ইউরোপীয় দেশগুলোকে আরো ২ শতাংশ প্রতিরক্ষা ব্যয় বাড়াতে হবে। এর অর্থ হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র থেকে আরো বেশি হারে সমরাস্ত্র কিনতে হবে।
এ বিষয়টি নিয়ে তাত্ক্ষণিকভাবে অত্যন্ত দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়েছিলেন ফরাসি প্রেসিডেন্ট ম্যাখোঁ এবং বিশেষ করে তৎকালীন জার্মান চ্যান্সেলর অ্যাঙ্গেলা মার্কেল। কারণ প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প তখন ইউরোপের সঙ্গে বাণিজ্যের ক্ষেত্রে করব্যবস্থা পুনর্বিবেচনা এবং বৃদ্ধির কথাও সক্রিয়ভাবে বিবেচনা করছিলেন। যুক্তরাষ্ট্রে যানবাহনসহ বিভিন্ন রপ্তানিসামগ্রী উৎপাদনের জন্য কলকারখানা সরিয়ে নেওয়ার ওপর সবিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেছিলেন।
কোন দিকে যাচ্ছে ন্যাটোসাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের ব্যক্তিগত সম্পর্ক কিংবা বন্ধুত্বের কথা তথ্যাভিজ্ঞ মহল ভালো করেই জানতেন। এ ছাড়া রাশিয়ার প্রতিবেশী ইউক্রেনের সঙ্গে তৎকালীন সিনেটর ও ডেমোক্রেটিক দলের প্রভাবশালী নেতা জো বাইডেনের ছেলে হান্টার বাইডেনের ব্যাবসায়িক সম্পর্কের কথা অনেকেই অবগত ছিলেন।

ব্যক্তিগত বন্ধুত্বের কারণে ২০১৬ সালে অনুষ্ঠিত প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ট্রাম্পকে বিভিন্নভাবে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন সাহায্য-সহযোগিতা দিচ্ছিলেন বলে গুরুতরভাবে অভিযোগ উত্থাপন করেছিলেন ট্রাম্পের প্রতিপক্ষ ডেমোক্রেটিকদলীয় প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী হিলারি ক্লিনটন। সেসব বহু কারণে ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েই পশ্চিমা সামরিক জোট ন্যাটোর আবশ্যকতা নিয়ে বহু কথা বলেছেন এবং এক পর্যায়ে ইউরোপকে যুক্তরাষ্ট্রনির্ভর না হয়ে বরং ইউরোপের নিজস্ব প্রতিরক্ষাব্যবস্থা গড়ে তোলার পরামর্শ দিতে শুরু করেন। তখন যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম প্রধান ইউরোপীয় মিত্র ও বিশেষ সহযোগী যুক্তরাজ্যের (ব্রিটেন) পরামর্শে ট্রাম্প তাঁর বক্তব্য কিছুটা পরিবর্তন করেন। সিরিয়া সীমান্তে বৈরী কুর্দিদের মোকাবেলার লক্ষ্যে তখন ইরান এবং বিশেষ করে রাশিয়ার ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক স্থাপনের প্রয়াস পেয়েছিলেন তুরস্কের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়িপ এরদোয়ান। সে কারণে এক পর্যায়ে তখন প্রশ্ন উঠেছিল পশ্চিমা সামরিক জোট ন্যাটোর আবশ্যকতা নিয়ে।
ওপরে উল্লিখিত অবস্থা বা পরিস্থিতির পরিবর্তন ঘটতে শুরু করে জো বাইডেনের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের পর থেকে। সিরিয়া ও মধ্যপ্রাচ্যে নিজেদের কৌশলগত অবস্থান পাকাপোক্ত করা এবং বিশেষ করে এ ক্ষেত্রে ইরান ও রাশিয়ার সম্পৃক্ততার বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র পশ্চিমা সামরিক জোট ন্যাটোর সদস্য ব্রিটেন ও ফ্রান্সকে কাজে লাগানোর চেষ্টা করে। এ প্রক্রিয়া আফগানিস্তানের ক্ষেত্রে পরবর্তী পর্যায়ে অত্যন্ত কার্যকর ভূমিকা পালন করে। যুক্তরাষ্ট্রের সিদ্ধান্ত ও পরামর্শের ফলে আফগানিস্তানের গনি সরকারের অস্তিত্ব রক্ষা ও তালেবানকে ঠেকানোর জন্যই মূলত আফগানিস্তানে ন্যাটো সেনাদের নিয়োগ করা হয়েছিল। রক্ষা করার চেষ্টা করা হয়েছিল পরাশক্তিগতভাবে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান, ইউরোপের নয়। তাহলে যুক্তরাষ্ট্রের নির্দেশে ইউরোপ কেন ইরাক, সিরিয়া, আফগানিস্তান ও অন্যান্য স্থানে যুদ্ধ করতে যায়, যেখানে তাদের প্রতিরক্ষাগত দিকটিই এখনো রয়ে গেছে অনিশ্চিত ও অমীমাংসিত। সাম্রাজ্যবাদী চিন্তার ধারক ও বাহক জো বাইডেনের পরবর্তী নির্বাচনে ভরাডুবি হলে সুযোগমতো তাঁর প্রতিপক্ষ ডোনাল্ড ট্রাম্প যদি কোনোক্রমে ক্ষমতাসীন হতে পারেন, তাহলে কোথায় যাবে বর্তমান পশ্চিমা সামরিক জোট ন্যাটোর ভূমিকা কিংবা আবশ্যকতা। ডোনাল্ড ট্রাম্প কিংবা তাঁর মতো কট্টর জাতীয়তাবাদী নেতা যুক্তরাষ্ট্রে ক্ষমতাসীন হলে গৌণ হয়ে যেতে পারে সামরিক জোটগতভাবে ন্যাটোর কার্যকারিতা। সে ক্ষেত্রে সাম্রাজ্যবাদী যুক্তরাষ্ট্রের পরাশক্তিগত আধিপত্য ধরে রাখার চেষ্টা না করে ইউরোপের নিজস্ব প্রতিরক্ষাগত ব্যবস্থা গড়ে তোলা নিয়ে ফ্রান্স ও জার্মানিতে এখন এক বিরাট বিতর্ক চলছে।

বর্তমান পশ্চিমা সামরিক জোট ন্যাটোতে এককালের নিরপেক্ষ দেশ ফিনল্যান্ড ও সুইডেনকে সদস্য করার তাগিদ কেন দেখা দিয়েছে? ইউক্রেনের বিপরীতে রুশ আগ্রাসনের বিরুদ্ধে টেনে আনা হচ্ছে ফিনল্যান্ড ও সুইডেনের মতো রাশিয়ার প্রতিবেশী দেশগুলোকে। যুক্তরাষ্ট্রের সাম্রাজ্যবাদী কিংবা কর্তৃত্ববাদের স্বার্থে ইউরোপকে করে তোলা হচ্ছে আরো অশান্ত ও অস্থির। আঞ্চলিক নিরাপত্তাগতভাবে করে তোলা হচ্ছে অত্যন্ত প্রতিযোগিতামূলক। রাশিয়ার বিরুদ্ধে ন্যাটোর যে বর্ধিত প্রতিরক্ষা বলয় গড়ে তোলা হচ্ছে কোনো কারণে রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিনের অপসারণ কিংবা পতন ঘটলে কী হবে রাশিয়ার অবস্থান? আজকের চীন কিংবা রাশিয়া কোথাও নেই মার্ক্সবাদী বা সমাজতান্ত্রিক সরকার। এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্র রয়েছে আটলান্টিকের অপর পারে, ভিন্ন এক মহাদেশে। সুতরাং কেন এই তথাকথিত মতাদর্শগত দ্বন্দ্ব-সংঘাত? সেটি কী নেহাতই সাম্রাজ্যবাদ কিংবা কর্তৃত্ববাদকে টিকিয়ে রাখার জন্য নয়? ন্যাটোর কোনো প্রতিষ্ঠানগত শক্তিশালী নিয়ম-নীতি এখনো প্রতিষ্ঠিত হয়নি। ন্যাটোকে সত্যিকার অর্থে একটি শক্তিশালী আইনি কিংবা পদ্ধতিগত ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠা করতে হলে প্রশাসনিকভাবে ১০ থেকে ১৫ বছর ধারাবাহিকভাবে কাজ করতে হবে। সে কারণে ইউক্রেনকে এক্ষুনি সদস্য পদ দেওয়া যাচ্ছে না এবং ইউক্রেনকে ন্যাটোর পরিবর্তে ‘প্রতিরক্ষাগত নিশ্চয়তা’ দিতে হচ্ছে জি৭ ভুক্ত দেশগুলোকে। এ ক্ষেত্রে ন্যাটোর সদস্যভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে রয়েছে তীব্র মতবিরোধ। কারণ ন্যাটোর সদস্যভুক্ত জার্মানি কিংবা ফ্রান্সের মতো অনেক দেশ ভবিষ্যতে রাশিয়ার তেল, গ্যাস, খাদ্যশস্য ও বিভিন্ন ক্ষেত্রে টেকসই সম্পর্কের প্রত্যাশী।

সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডাব্লিউ বুশ একসময় রাশিয়ার বিরুদ্ধে একটি শক্তিশালী প্রতিরক্ষা ব্যূহ তৈরি করার জন্য কৃষ্ণ সাগরের তীরবর্তী ইউক্রেন ও জর্জিয়াকে ন্যাটোতে অন্তর্ভুক্ত করার প্রস্তাব করেছিলেন। রুমানিয়ার রাজধানী বুখারেস্টে ২০০৮ সালে অনুষ্ঠিত ন্যাটো সম্মেলনে উত্থাপিত সেই প্রস্তাবের সমালোচনা করেছিলেন ফ্রান্সের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট নিকোলাস সারকোজি এবং জার্মানির তৎকালীন চ্যান্সেলর অ্যাঙ্গেলা মার্কেল। তাঁদের মতে, বুশের সে প্রস্তাব মেনে নেবেন না রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন এবং যদি তেমনটা হয়, তাহলে অর্থনৈতিক দিক থেকে ফ্রান্স, জার্মানি ও ইউরোপের অন্যান্য দেশ তেল, গ্যাস, খাদ্যশস্য ও অন্যান্য পণ্য সরবরাহের দিক থেকে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এ ছাড়া রাশিয়ার সঙ্গে ইউরোপের আঞ্চলিক নিরাপত্তা ও শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের ধ্যান-ধারণাও বিঘ্নিত হবে। পশ্চিম ইউরোপের নেতৃস্থানীয় ও শিল্পসমৃদ্ধ দেশগুলোর নীতিগত বাধা অগ্রাহ্য করে যুক্তরাষ্ট্র সেদিন যে পদক্ষেপ নিয়েছিল তারই পরিণতিতে সংঘটিত হচ্ছে আজকের রাশিয়া-ইউক্রেন সংঘর্ষ। তাতে জড়িয়ে পড়তে পারে ইউরোপের অন্য দেশগুলো, অক্ষত থাকবে আটলান্টিকের অপর পারের যুক্তরাষ্ট্র। সে কারণেই ন্যাটোর পরিবর্তে তাঁরা ইউরোপীয় নিজস্ব প্রতিরক্ষাব্যবস্থা গড়ে তোলার কথা চিন্তা-ভাবনা করেছিলেন। এ ক্ষেত্রে ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার অনেক পরে রুশ নেতা ভ্লাদিমির পুতিনও ইউরোপীয় ইউনিয়নে যোগ দেওয়ার বাসনা প্রকাশ করেছিলেন। ওয়াকিফহাল মহলের মতে, এখন যদিও সোভিয়েত পদ্ধতি কিংবা সেই শিবিরে আর মার্ক্সবাদী কিংবা সমাজতান্ত্রিক সরকার নেই, তবু যুক্তরাষ্ট্র তার সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থের কারণে প্রতিপক্ষ হিসেবে রাশিয়া কিংবা চীনকে মডেল হিসেবে দাঁড় করিয়ে রেখেছে। কখনো আসন্ন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন, সামরিক পরাক্রম কিংবা আধিপত্য বজায় রাখার কৌশল হিসেবে তাদের ব্যবহার করছে। তাতে ভুক্তভোগী হচ্ছে ইউরোপ ও বিশ্ববাসী।

তথ্যাভিজ্ঞ মহলের মতে, বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক দিক থেকে ইউরোপ, এশিয়া ও আফ্রিকার বিভিন্ন দেশ এখন সামগ্রিকভাবে এক মন্দার কবলে পড়েছে। মূল্যস্ফীতির কারণে নাভিশ্বাস উঠেছে এসব অঞ্চলের মানুষের। যুক্তরাষ্ট্রের সাম্রাজ্যবাদী কিংবা আধিপত্যবাদী নীতির কারণে একদিন হয়তো ইউরোপে পশ্চিমা সামরিক জোট ন্যাটো ভেঙে পড়তে পারে। ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ম্যাখোঁর ব্রিকসে যোগদানের পরিকল্পনা কিংবা ক্ষমতার এককেন্দ্রিকতা ও ডলারের একাধিপত্য ভেঙে দেওয়ার প্রত্যাশা কি সেই ইঙ্গিত বহন করে না?

লেখক : বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার (বাসস) সাবেক প্রধান সম্পাদক ও