বাংলাদেশের ‘বৃক্ষ মানবের’ করুণ কাহিনী

Published: 23 July 2023

পোস্ট ডেস্ক :


বিরল রোগে আক্রান্ত বাংলাদেশের বাসিন্দা আবুল বাজানদার। তার হাত ও পায়ে গজিয়ে ওঠা গাছের শেকড়ের মতো দেখতে বিশাল আকারের আঁচিলের জন্য তিনি পরিচিত ‘বৃক্ষ মানব’ হিসেবে। একসময় আবুল ভয় পেতেন সত্যিই কি কোনোদিনও নিজের আদরের মেয়ে জান্নাতুলকে কোলে নিতে পারবেন না ?

আবুল বাজানদার এপিডার্মোডিসপ্লাসিয়া ভেরুসিফর্মিস নামক একটি বিরল রোগে আক্রান্ত। বিশ্বব্যাপী এরকম ১০টিরও কম কেস নথিভুক্ত রয়েছে এবং যেহেতু কোনও পরিচিত চিকিৎসা নেই তাই ৩৫ বছর বয়সী বাজানদার একসময় সমস্ত আশা হারিয়ে ফেলেছিলেন। বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিম শহর খুলনায় ভিক্ষাবৃত্তির পথ বেছে নেন জীবন ধারণের জন্য। আবুল জানাচ্ছেন , ‘ মানুষ আমার সাথে তাদের ছবি তোলার জন্য আমাকে কিছু টাকা দিত। আমি অনেকটা চিড়িয়াখানার বানরের মতো ছিলাম দর্শনার্থীরা আমাকে দেখে চিনাবাদাম দিতো ।”

২০১৫ সালে একজন স্থানীয় সাংবাদিক বাজানদারের দুর্দশার বিষয়ে রিপোর্ট করেন। আরও কিছু মিডিয়া আউটলেট, যেমন ডেইলি মিরর, সিএনএন বাজানদারের করুণ কাহিনীটি তুলে ধরেছিল। হঠাৎ করেই, বাজানদার আন্তর্জাতিক সংবাদে জায়গা করে নেন ‘দ্য ট্রি ম্যান অব বাংলাদেশ’ হিসেবে । এমনকি দেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও বিষয়টি নিয়ে আগ্রহ দেখিয়েছিলেন, বাজানদারের হাত-পায়ে ঢেকে থাকা আঁচিল কার্সিনোমাস অপসারণের চেষ্টায় দেশের সেরা সার্জনদের জড়ো করেন।

২০১৬ সালের প্রথম দিকে, বাজানদার তার স্ত্রী হালিমা খাতুন এবং তিন বছর বয়সী জান্নাতুলকে নিয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চলে আসেন।

সেখানে, প্লাস্টিক সার্জন সামন্ত লাল সেনকে বাজানদারের হাত ও পায়ে একাধিক অস্ত্রোপচারের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল, যদিও তিনি সতর্ক করেছিলেন যে এরপরেও বাজানদার সেরে উঠবেন এমনটা নিশ্চিত নয়। অস্ত্রোপচারের কয়েক মাস পরে, বাজানদারের স্বপ্ন সত্যি হয়েছিল এবং তিনি প্রথমবারের মতো তার মেয়েকে কোলে তুলে নিয়ে বলেন ” আজ আমি বিশ্বের সবথেকে সুখী বাবা। ” খুপরির মতো স্যাঁতসেঁতে কামরায় কোনোরকমে মাথা গুঁজে থাকে পরিবারটি । যেখানে রয়েছে কয়েকটা শক্ত কাঠের বিছানা এবং একটি টেবিল। ঘরের একটি দেয়ালে শুকনো ধান ক্ষেতের ছবি, যা বাংলাদেশের পতাকার লাল এবং সবুজ রঙে রঙিন। জরাজীর্ণ বাড়ির মানুষটিই এখন দেশের একজন গর্বের উৎস হয়ে উঠেছেন।

২০১৮ সালে অস্ত্রোপচারগুলি শেষ হয়েছিল এবং প্রথমবারের মতো তিনি কোনো ব্যথা ছাড়াই হাঁটতে এবং দক্ষতার সাথে তার হাত ব্যবহার করতে পারতেন। তার ফোনের একাধিক ফটোগ্রাফ সেই সংক্ষিপ্ত সুখের প্রতিফলন । জান্নাতুলকে কোলে নেয়া, চামচ ধরে খাবার খাওয়া বা রাস্তায় দৌড়ানোর ছবিগুলি বাজানদার এমন একটি জীবনের ঝলক যা বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। কয়েক মাস পর, তার পুরনো রোগ আবারও বাড়তে শুরু করে। দম্পতির ভয়ানক আর্থিক পরিস্থিতি সত্ত্বেও, ২০১৬ এবং ২০১৮ এর মধ্যে বিনামূল্যে যে স্বাস্থ্য পরিষেবা পেয়েছেন তার জন্য ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের প্রতি চির কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন বাজানদার। প্রথমবার অস্ত্রোপচারের পর তিনি প্রায় ৬ কেজি আঁচিল থেকে মুক্তি পান। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল বিশ্বকে দেখিয়েছিল যে অস্ত্রোপচারেও সফলতা মেলে। কিন্তু চিকিৎসকরা বাজানদারকে সতর্ক করে দিয়েছিলেন যে তাঁকে আজীবন চিকিৎসা চালিয়ে যেতে হবে।

বাজানদার জানাচ্ছেন -”আমি সম্পূর্ণরূপে সচেতন ছিলাম যে এটি একটি জেনেটিক রোগ এবং এর কোন নিরাময় নেই। কিন্তু আমি সর্বদা আশা করেছিলাম যে এটি আর ফিরে আসবে না। কিন্তু আমি কখনই ভাবিনি যে, এটি আবার এত তাড়াতাড়ি এবং ভয়াবহতার সাথে আমাকে আঘাত করবে।”

কোভিড-১৯ মহামারীর কারণে বাজানদারকে তার জন্মস্থান খুলনায় ফিরে যেতে হয়, বন্ধ হয়ে যায় চিকিৎসা। মাত্র কয়েক মাস পরে, আঁচিলগুলি আবার দেখা দিতে শুরু করে এবং তিন বছরের মধ্যে সেগুলি বিশাল বড় হয়ে যায়। বিশেষ করে তার পায়ের আঁচিলগুলি। বাজানদারের স্ত্রী খাতুন বলছেন, স্বামীর কষ্ট দেখে প্রায়শই তিনি তার হাত ও পা আলতো করে কাপড় দিয়ে মুড়ে রাখতেন। সমস্যাটি হলো গাছের শেকড়ের মতো আঁচিলগুলি সমস্ত দিকে বৃদ্ধি পায়, যার ফলে পেশী এবং হাড়ের সমস্যা হয়। যতবার বাজানদার পা ফেলতেন তার চামড়া কেটে শিকড়গুলি বেরিয়ে আসতো । প্রতিদিনের অ্যান্টিবায়োটিক এবং ব্যথানাশক ওষুধের ডোজ নিতে নিতে তিনি ক্লান্ত হয়ে যেতেন। ওষুধের খরচ চালিয়ে যাওয়াও ছিলো বেশ ব্যয়বহুল।

যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত আসামির মতো অনুভব করতেন বাজানদার। পরিবারকে সাহায্য করতে না পারার জ্বালা তাঁকে কুঁড়ে কুঁড়ে খেতো। তিনি সম্পূর্ণরূপে তাঁর স্ত্রীর উপর নির্ভরশীল ছিলেন যিনি হাঁস পালন করে কিছু অর্থ উপার্জন করতেন। এই পরিস্থিতি আর সহ্য করতে না পেরে, যখনি স্থানীয় হাসপাতালে বা প্রাইভেট ক্লিনিকে ডাক্তারদের কাছে যেতেন তখনি তার হাত পা চিরতরে কেটে ফেলার অনুরোধ করতেন বাজানদার। তিনি বলছেন, ”আমি জানি এমন কিছু লোক আছে যারা একাধিক অঙ্গবিচ্ছেদ নিয়েই জীবন যাপন করে। ক্রমাগত ব্যথা নিয়ে বাঁচার চেয়ে এটি অনেক ভাল, কিন্তু আমার অনুরোধগুলি সর্বদা অস্বীকার করা হয়।” প্রতি এক বা দুই মাস পর, তাঁর স্ত্রী গাছের শেকড়ের মতো দেখতে আঁচিলগুলি একটু করে কেটে দিতেন, তাই মাঝে মাঝে একটু আধটু হাঁটতে এবং জামাকাপড় পরতে পারতেন এই অসহায় ব্যক্তিটি । তাঁর বয়সী যুবকরা যখন বিকেলের দিকে ক্যারাম খেলতো তখন বাজানদারের সময় কাটতো হয় বিছানায় শুয়ে নয়তো একটি লাল প্লাস্টিকের চেয়ারে বসে। এমনকি শহরে গিয়ে ভিক্ষাবৃত্তি করার সুযোগও ছিলো না মানুষটির। কারণ একদিন হাঁটলে তাঁকে তিনদিন শয্যাশায়ী থাকতে হতো।

খাতুনের জীবন খুব একটা সহজ ছিল না । এই দম্পতি সেরকম কোনও সামাজিক সুবিধা পাননি এবং তিনি তার কাঁধে পরিবারের ভার বহন করে চলেছেন যা মুসলিম দেশগুলিতে স্বাভাবিক বিষয় নয়। সেলাই করে মাসে মাত্র ১০০০ টাকা আয় করেন খাতুন। গত বছর কিছু মুরগি এবং একটি হাঁস বিক্রি করে ২৫০০ টাকা মতো হাতে এসেছে। মূলত বাগানের সবজি, পুকুরের মাছ এবং কিছু অনুদানের ওপর চলছে তাদের সংসার। এক দশক আগে স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কের শুরুটা সহজ ছিল না। বাজানদারের শারীরিক সমস্যার জন্য খাতুনের পরিবার বিবাহের বিরোধিতা করেছিল। খাতুন বলেন, ” আমাদের প্রথম মেয়ের জন্মের পর আমার বাবা-মা মত পরিবর্তন করতে বাধ্য হন ”। হতভাগ্য এই স্ত্রী জানাচ্ছেন, “আমি তাঁর করুণ অবস্থা দেখে তাঁকে ভালোবেসেছিলাম। আমি তাকে একজন ভাল ব্যক্তি হিসাবে দেখেছি যার যত্নের প্রয়োজন ছিল। তখনও তিনি রাস্তায় কিছু অর্থ উপার্জন করতেন । আমি ভাবিনি যে, একসময় সে আমার উপর পুরোপুরি নির্ভর করবে। এখন আমি লজ্জিত বোধ করি যখন আমি আমার বাবা-মায়ের কাছে যাই। কারণ তারা আমাকে বারবার সতর্ক করেছিলো ।” কিন্তু ইন্দোনেশিয়ায় দেদে কোসওয়ারার স্ত্রীর মতো বাজানদারকে ত্যাগ করার কথা কখনোই তার মনে আসেনি । তাঁর জীবন এখন তার স্বামীর যত্ন নেওয়া এবং কন্যাদের একটি উন্নত জীবন দেয়ার উদ্দেশে নিয়োজিত । তবে আশার কথা একটাই চিকিৎসকরা একাধিক পরীক্ষার পর জানিয়েছেন বাজানদারের মতো তাঁর কন্যারা এই রোগ থেকে মুক্ত।

খাতুন ও বাজানদার দুজনেই নিরক্ষর। দারিদ্র্যের চক্র ভাঙতে হলে জান্নাতুল ও শায়রাকে শিক্ষিত হতে হবে। বাবা-মায়ের কাছে বড় মেয়ের জন্য মাসিক ১,০০০ টাকা স্কুল ফি জোগাড় করা সহজ নয়, তবে তার ভবিষ্যতের সাফল্যই তাদের একমাত্র আশা। পরিবারকে সাহায্য করতে চান সার্জন লাল সেন। তিনি বলেন, “এর জন্য বাজানদারকে ঢাকায় থাকতে হবে এবং অপারেটিং রুমে মাঝে মাঝেই আঁচিল অপসারণ করতে হবে। তবেই তিনি একটি সুন্দর স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে সক্ষম হবেন। বাজানদারের বীমা না থাকা সত্ত্বেও সরকার সর্বদা বিনামূল্যে তাঁকে পরিষেবা প্রদান করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে ”। কিন্তু বাজানদার প্রথম অস্ত্রোপচারের মতো দুঃস্বপ্নের শিকার হতে চান না । তাঁর মতে, ”অস্ত্রোপচারের জন্য আমাদের ঢাকায় থাকতে হবে এবং আমি মনে করি না যে আমি সেখানে আমার স্ত্রী এবং কন্যাদের একটি ভাল জীবন দিতে পারব। শহুরে দুর্দশার চেয়ে গ্রামাঞ্চলের দারিদ্র্য সবসময় পছন্দের। ”

এক বছর আগে, বাজানদার একজন ব্যক্তির কাছ থেকে দুবাই ভ্রমণের প্রস্তাব পেয়েছিলেন। যিনি বাজানদারকে স্পর্শ করে এবং তাঁর গায়ে পবিত্র পানি ছিটিয়ে তাঁকে সুস্থ করে দেবার আশ্বাস দিয়েছিলেন। কিন্তু সেই আশ্বাসে কোনো কাজ হয়নি। বাজানদার বলছেন এখন একমাত্র আশার আলো বিদেশে গিয়ে চিকিৎসা করা। তিনি জেনেটিক থেরাপির নাম শুনেছেন। যদি কোনো বিশেষজ্ঞ সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন এখন সেই আশাতেই বুক বাঁধছেন এই বৃক্ষ মানব। কিন্তু ডাক্তার লাল সেনের মতে, “বিদেশে গেলে কোনো পার্থক্য হবে না, কারণ এটি একটি জেনেটিক রোগ যার কোনো চিকিৎসা নেই।” ডাক্তার লাল এবং বাজানদার উভয়েই নিশ্চিত করেছেন যে হাসপাতালটি তাঁকে এবং খাতুনকে চাকরির প্রস্তাব দিয়েছে, যাতে তারা ঢাকায় থাকতে পারে। কিন্তু জীবনের প্রতি আর কোনো আশা-আকাঙ্খা রাখছেন না এই হতভাগ্য দম্পতি।

সূত্র : সাউথ চাইনা মর্নিং পোস্ট