শ্রাবণ শেষের অশ্রুধারা
গোলাম কবির
জীবনে চলার পথে কিছু কিছু দিন আছে, যা আমাদের বিশ্বাস আর অস্তিত্বের সঙ্গে একীভূত। কত দিন তারিখকে আমরা চারণ করে চলেছি, সেগুলোর সত্যতা খুঁজতে আমাদের ইতিহাসের স্মৃতিশালায় হানা দিতে হয়। আবার কিছু কিছু দিন আছে, যা এমনি মনের বন্দরে বাসা বাঁধে। ১৫ই আগস্ট তেমনি একটি দিন, যার জন্য আমাদের পঞ্জিকার পাতায় গড় হতে হয় না।
দৈনন্দিন কর্মধারায় যেন তা একাকার হয়ে আছে। তবে আগস্ট মাস এলেই প্রতিটি ক্ষণ আমাদের সজাগ করে শ্রাবণ শেষের অশ্রুধারা। এ এক অনমনীয় আবেগ, যা আমাদের টেনে নিয়ে যায় নিরন্তর বেদনার স্রোতোধারায়।
জোহা স্যারের অমানবীয় হত্যার পর (প্রক্টর ড. শামসুজ্জোহা, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়) গণ-অভ্যুত্থানে শেখ মুজিবুর রহমান জোহা স্যারের কবর জিয়ারতের জন্য রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে আসেন।
ওই সময় দেশের জনগণ স্বতঃস্ফূর্ত হয়ে শেখ মুজিবকে ‘বঙ্গবন্ধু’ পদকে ভূষিত করেন। এখনকার ১ নম্বর কলাভবনের সামনে যে অস্থায়ী শহীদ মিনার ছিল, সেখানে একটি সংক্ষিপ্ত সমাবেশের আয়োজন হয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের সঙ্গে। সেখানেই একেবারে কাছে থেকে পরম আত্মীয়ের মতো নিবিড় সাক্ষাৎ। কয়েক দিন পরই আমার এমএ ফাইনাল পরীক্ষা।
কথা প্রসঙ্গে তিনি তাঁর হাতখানা আমার পিঠে রেখে বলেছিলেন, ভালো করে পড়াশোনা করো। তাই বলে দেশের ভাবনা যেন হারিয়ে না যায়।
আজ আমার বয়স ৮২ বছর অতিক্রমের পর বুঝছি, দেশের প্রতি কতখানি দৃষ্টি দিয়েছি। মনে হয় শূন্য। ৭৫ আর ১৫ সংখ্যা দুটি মনশ্চক্ষে আবির্ভূত হলে নিজের কাছে জবাবদিহি হতে পারি না।
কারণ যে লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নিয়ে দেশমাতৃকার মুক্তির ভার তিনি নিয়েছিলেন, তা প্রতিষ্ঠার প্রথম সোপানে তাঁকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হলো প্রায় সপরিবারে। ওই দিন সারা দেশে ছিল পিনপতন নিস্তব্ধতা। এরই মধ্যে দেখা গেল পাকিস্তানিরা বেরিয়ে পড়েছে। এই শকুনরা ২১ বছর শাসনের নামে পাকিস্তানি ভাবধারা ফিরিয়ে আনার শতচেষ্টা করেও বঙ্গবন্ধুকে ভোলাতে পারেনি। আজও নানা কৌশলে সেখানে ফিরে যাওয়ার পাঁয়তারা। গণতন্ত্রের নামে দেশময় নৈরাজ্যের সৃষ্টি। আসলে আমরা যারা বাঙালি সংস্কৃতিকে অস্বীকার করে পরদেশি আচরণ লালন করতে অগ্রণী, তারাই নানা ছলে চটকদার কথা বলে বিভ্রান্তি ছড়াই। প্রকৃত প্রস্তাবে তা মানবমুক্তির জন্য নয় : পুরুষানুক্রমিক ভোগের মোহ আর মমতার দাপট পূর্ণ করতে আগ্রহী। বাঙালি এখনো বোঝে, বঙ্গবন্ধু এসব থেকে মানুষের মুক্তির সাধনায় ভাঙাকেল্লায় নিশান উড়িয়ে জীবন দিয়ে গেছেন। আমরা তা ভুলি কেমনে, আজও যে মনে বেদনা আনে। কথা ছিল সেদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষা ও সংস্কৃতির নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হবে। সেদিন বঙ্গবন্ধুপ্রেমীরা চোখ মেলে চাওয়ার সময় পায়নি। এমন আকস্মিক অঘটন ঘটতে পারে তা কারো চিন্তায় ছিল না। আমরা রাজশাহী কলেজের গুটিকয় শিক্ষক ম্রিয়মাণ হয়ে পড়লাম। আর চোখ মেলে দেখার সুযোগ হয়নি। প্রায় বন্দিদশায় চাকরি শেষে দেখা গেল, হায় সেই মোসাহেবরাই চূড়ায় বসে শোষকদের জয়গানে মত্ত। সবই ব্যক্তিস্বার্থের জন্য। কারণ ওরা বঙ্গবন্ধুর আদর্শকে স্বার্থের প্রয়োজনে জপমালা করে। আবার ব্যক্তিস্বার্থ সীমিত হয়ে এলে সহসা মিথ্যার কুহকে কোরাস গায়। দীর্ঘকাল এই ভুয়াদের নর্তনকুর্দন চলে আসছে। আমরা আজকের সচেতন মানুষ সেই ভ্রুকুটি বহন করব কেন! নিজের ত্যাগের ভেতর দিয়ে সর্বত্যাগী বঙ্গবন্ধুকে যথাযথ সম্মান দিয়ে নিজেদের জন্মকে নন্দিত করতে পারলেই বাংলাদেশ নামটি ‘সকল দেশের সেরা’ হয়েই থাকবে।