বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পরে ভারতীয় গোয়েন্দা দলিল

Published: 15 August 2023

গোপনীয়
––––––
কপি নং ১৫
ক্যাবিনেট সেক্রেটারিয়েট
(রিসার্চ অ্যান্ড অ্যানালাইসিস উইং)
বাংলাদেশ : সেনা অভ্যুত্থানের পরে উদ্ভূত পরিস্থিতি
১. এটা এখন বেশ পরিষ্কারভাবে প্রতিষ্ঠিত যে, বাংলাদেশে সংঘটিত ক্যুটি হলো প্রধানত ঢাকাভিত্তিক [সেনা] কর্মকর্তাদের কাজ, যাদের অধিকাংশ মেজর পদবির ধারক। সেনাবাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের এরা আস্থায় নেয়নি, যদিও সেনা নেতৃত্বভুক্ত শীর্ষ কর্মকর্তাদের কেউ কেউ সম্ভবত এর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ক্যু সংঘটনে প্রধানত ব্যবহৃত হয়েছে বেঙ্গল ল্যান্সার গ্রুপ এবং এর কমান্ডিং অফিসার বা সিও হলেন মেজর ফারুক রহমান, যিনি ক্যু সংঘটনকারী কর্মকর্তাদের প্রধান নেতা। ঢাকার বাইরের কোনো সৈনিক বা সরঞ্জাম এ ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়নি। অন্য বড় নগর ও শহরগুলোর ক্ষমতাকেন্দ্র দখলেরও কোনো পরিকল্পনা তাদের ছিল না। ঘটনাটিতে বিস্মিত ঢাকায় অবস্থানরত শীর্ষ সেনা কর্মকর্তারা অনিবার্য বাস্তবতা মেনে নতুন সরকারের প্রতি তাদের আনুগত্য স্বীকারে সম্মত হয়েছেন।

২. এটা মনে করার জোরালো কারণ আছে যে, খন্দকার মোশতাক ক্যু-এর পরিকল্পনা সম্পর্কে অবহিত ছিলেন। ক্যু-এর আরেক হোতা মেজর রশিদের মতো মেজর ফারুক রহমানও তাঁর ভাগনে ছিলেন। যেভাবে খন্দকার মোশতাক দ্রুত দেশের প্রশাসনের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হন এবং যতটা সহজে নিজের অবস্থান তিনি সংহত করেন, তা জোরালো সাক্ষ্য দেয় যে, তিনি বিষয়টা আগেভাগে জানতেন এবং নিজের কিছু পরিকল্পনাও তিনি গুছিয়ে নিয়েছিলেন। ক্যুর হোতারা যে তাঁর নেতৃত্ব মেনে নিতে আগে থেকেই প্রস্তুত ছিল, সেটাও এ থেকে বোঝা যায়।

৩. তত্ত্বাবধানকারী কর্তৃপক্ষরূপে বাইরের কোনো শক্তি ক্রিয়াশীল ছিল কিনা এবং ষড়যন্ত্রকারীদের সামরিক এবং বেসামরিক অংশসমূহের মধ্যে কোনো মধ্যস্থতাকারী ছিল কিনা, তা খুব স্পষ্ট নয়। খন্দকার মোশতাক নিজেই একজন মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকায় থাকতে পারেন। এ সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেওয়া যায় না যে, সেখানে আরেকটা সংস্থা কাজ করেছে যে ক্যুর বিষয়ে একটা কার্যকর পরিকল্পনা প্রণয়নে এবং অভিযানের পর ক্ষমতার নির্বিঘ্ন হস্তান্তরে দক্ষতা দিয়ে অবদান রেখেছে। এ বিষয়ে এরই মধ্যে কিছু আলামত ফুটে উঠেছে, যেগুলো খুব তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে হচ্ছে।

প্রথমত, ক্যু-এর পর সামরিক বা বেসামরিক ষড়যন্ত্রকারীদের মধ্যে যে বড় কোনো সমস্যা উদ্ভূত হলো না, সেটাই প্রমাণ করে যে মাস্টারমাইন্ড হিসেবে এতে কেউ জড়িত ছিল। দ্বিতীয়ত, ক্যু-এর পর কালবিলম্ব না করে একটা সামরিক উপদেষ্টা পরিষদ গঠিত হয়ে গেল; যেখানে রাষ্ট্রপতি হলেন সভাপতি এবং সদস্যদের মধ্যে ক্যু সংঘটনকারী ওই দুই মেজরকেও দেখা গেল। তৃতীয়ত, ক্যু সংঘটনকারী মেজরদের একজন প্রাণভয়ে ১৯৭৫ সালের ২০ আগস্ট ঢাকার মার্কিন দূতাবাসে আশ্রয় নেন; মার্কিন দূতাবাসও তাঁর হয়ে সেনা কর্তৃপক্ষের কাছে সাফল্যের সঙ্গে সুপারিশ করে এবং তাঁর নিরাপত্তার বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কিছু আশ্বাস পায়। অতীতে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের কোনো সম্পর্ক ছিল না। ঢাকার মার্কিন দূতাবাস এবং [বাংলাদেশের] সেনা কর্তৃপক্ষের মধ্যে এ আকস্মিক সংযোগ সৃষ্টির পাশাপাশি ষড়যন্ত্রকারীদের একজনের সমস্যা সমাধানে যুক্তরাষ্ট্রের সাবলীল সক্ষমতা নিশ্চিতভাবে এ সন্দেহের উদ্রেক করে যে মার্কিন দূতাবাসের ভূমিকা ছিল নিছক একজন সৎ মধ্যস্থতাকারীর চেয়েও বেশি কিছু।

ক্ষমতা সংহতকরণের প্রয়াস
৪. রাষ্ট্রপতি খন্দকার মোশতাক আহমেদ দেশে তাঁর ক্ষমতা এবং শাসন পাকাপোক্ত করার লক্ষ্যে বহুবিধ পদক্ষেপ নিয়েছেন। ক্যু-এর প্রায় পরপরই নতুন মন্ত্রিপরিষদ শপথ নেয় এবং স্বল্প সময়ের মধ্যে তার শক্তি আরও বাড়ানো হয়। মন্ত্রিপরিষদের সদস্য বাছাইয়ের ধরন দেখেও বোঝা যায় যে, এর পেছনে কাকে কাকে নেওয়া হবে, তার চেয়ে বরং কাকে নেওয়া হবে না– সে নীতি কাজ করেছে। মনে হচ্ছে, এর আশু লক্ষ্য ছিল নিছক ধারাবাহিকতা রক্ষা করা এবং প্রশাসনে কোনো শূন্যতা তৈরি হতে না দেওয়া। সেনা নেতৃত্বকে পুনর্বিন্যস্ত করা হয়। প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা নামে নতুন পদ তৈরি করে তাতে জেনারেল ওসমানীকে নিয়োগ দেওয়া হয়। সেনাবাহিনীতে কর্মরত সবচেয়ে সিনিয়র কর্মকর্তা মেজর জেনারেল খলিলুর রহমানকে করা হয় চিফ অব দ্য ডিফেন্স স্টাফ; এটিও নতুন একটি পদ। মুজিবপন্থি সেনাপ্রধান মেজর জেনারেল সফিউল্লাহর জায়গায় মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানকে বসানো হয়। চট্টগ্রামভিত্তিক ৬৫ সেনা ব্রিগেড কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার দস্তগীরকে মেজর জেনারেল পদে পদোন্নতি দিয়ে বাংলাদেশ রাইফেলসের প্রধান করা হয়। এসব কর্মকর্তার সবাই অতীতে ভারতবিরোধী মনোভাব প্রদর্শন করেছেন; এসব নিয়োগের মধ্য দিয়ে এটা স্পষ্ট হয় যে, রাষ্ট্রপতি খন্দকার মোশতাক আহমেদ গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোতে ভারতবিরোধী মনোভাবাপন্ন কর্মকর্তাদের বসিয়ে রাষ্ট্র চালাতে চান। একই নীতি বেসামরিক পদের ক্ষেত্রেও অনুসরণ করেন। মাহবুবুল আলম চাষীকে বসানো হয়েছে রাষ্ট্রপতির মুখ্য সচিব পদে এবং শফিউল আজমকে মন্ত্রিপরিষদ সচিব পদে; দুজনই– যে কোনো কারণে হোক– ভারতের প্রতি সুপ্রসন্ন না হওয়ার জন্য বিখ্যাত। সাবেক প্রধানমন্ত্রী মনসুর আলী, কামারুজ্জামান, [সৈয়দ] নজরুল ইসলাম ও আবদুস সামাদের মতো মুজিবের মন্ত্রিসভার যেসব সদস্যকে বাদ দেওয়া হয়, তাদের সবাইকেই ভারতের প্রতি সহানুভূতিশীল বলে মনে করা হয়। মন্ত্রিসভা থেকে তাদের অপসারণ স্পষ্ট ইঙ্গিত দেয় যে, নতুন সরকারের নীতি হলো– ভারতের প্রতি পক্ষপাত থাকতে পারে, এমন লোকদের পরিবর্তে ভারতের প্রতি পক্ষপাত দেখানোর কোনো সম্ভাবনা নাই, এমন লোকদের দিয়ে সরকার পরিচালনা করা।

৮. তবে নতুন সরকার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সক্ষম হলেও এ আলামতও দুর্লভ নয় যে বাংলাদেশের কিছু মানুষ প্রশাসনের এহেন পরিবর্তন এবং নতুন সরকারের চেহারা গ্রহণ করতে রাজি নয়। বহু জেলায় মুজিবপন্থি পোস্টার দেখা গেছে। কিছু জায়গায় জাসদের পোস্টারও দেখা গেছে, যেখানে ক্যু-এর জন্য সিআইএকে দায়ী করে জনগণকে বিপ্লবী গণবাহিনীতে যোগ দেওয়ার পাশাপাশি নতুন সরকারকে রুখে দেওয়ার আহ্বান জানানো হয়েছে। এ ধরনের কিছু পোস্টারে গণতান্ত্রিক জাতীয় সরকার গঠনেরও দাবি জানানো হয়েছে।

ইংরেজি থেকে অনূদিত ও সংক্ষেপিত
অনুবাদ করেছেন সাইফুর রহমান তপন

সূত্র: Notes from shri GS Misra (Cabinet Secretariat) and of papers on Bangladesh received from Secy. Mr. K.R. Narayanan; File No. PP(JS)4(4)/75; Identifier: PR_000004001235
https://www.abhilekh-patal.in/