ব্রিকস শীর্ষ সম্মেলন এবং বাংলাদেশের কৌশল

Published: 22 August 2023

নিরঞ্জন রায়

২২ থেকে ২৪ আগস্ট দক্ষিণ আফ্রিকার জোহানেসবার্গে অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত, চীন ও সাউথ আফ্রিকার সমন্বয়ে গড়ে ওঠা নতুন জোট ব্রিকসের (BRICS) শীর্ষ সম্মেলন। এবার ব্রিকস শীর্ষ সম্মেলন আয়োজনের স্বাগতিক দেশ দক্ষিণ আফ্রিকা আনুষ্ঠানিকভাবে ৬৯ দেশকে আমন্ত্রণ জানিয়েছে এই শীর্ষ সম্মেলনে অংশ নেওয়ার জন্য। আগে থেকেই আলোচনা আছে যে সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, আর্জেন্টিনাসহ বেশ কয়েকটি দেশ এই ব্রিকস জোটে যোগ দিতে পারে। ধারণা করা হচ্ছে, সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও আর্জেন্টিনা এই শীর্ষ সম্মেলনে যোগদানের মাধ্যমে ব্রিকস জোটের আনুষ্ঠানিক সদস্য হতে পারে।

বাংলাদেশও ব্রিকস শীর্ষ সম্মেলনে যোগদানের জন্য আনুষ্ঠানিক আমন্ত্রণপত্র পেয়েছে এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই শীর্ষ সম্মেলনে অংশগ্রহণ করবেন।
ব্রিকস শীর্ষ সম্মেলন এবং বাংলাদেশের কৌশলব্রিকসের আনুষ্ঠানিক যাত্রার এক যুগেরও বেশি সময় অতিক্রম করলেও এবারই এই নতুন জোটের শীর্ষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে সবচেয়ে বৃহত্তর পরিসরে। এই জোট নিয়ে অনেক আগে থেকে আলোচনা হয়েছে ঠিকই, কিন্তু এই জোট আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সেভাবে সাড়া ফেলতে পারেনি, বিশেষ করে যে পশ্চিমা বিশ্বের বিপরীতে এই জোট গঠিত, সেই পশ্চিমা বিশ্বকে এই জোটের পথচলা মোটেও নাড়া দিতে পারেনি। গত বছর রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে আমেরিকার নেতৃত্বে পশ্চিমা বিশ্ব রাশিয়ার বিরুদ্ধে এক ধরনের অর্থনৈতিক যুদ্ধ ঘোষণা করে।

ফলে অনেক দেশ, বিশেষ করে যারা আন্তর্জাতিক লেনদেনের ক্ষেত্রে অতিমাত্রায় ডলারনির্ভর, তারা সমস্যায় পড়ে যায়। অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা, ডলার হিসাব জব্দ এবং সুইফট থেকে বহিষ্কার করার মতো অর্থনৈতিক অস্ত্র আমেরিকা ও পশ্চিমা বিশ্ব যেভাবে রাশিয়ার বিরুদ্ধে ব্যবহার করেছে, তা দেখে অনেক দেশই ভাবতে শুরু করে যে এসব অস্ত্র তাদের বিরুদ্ধেও ব্যবহৃত হতে পারে। এ রকম অনিশ্চয়তার কারণেই ব্রিকসের অগ্রযাত্রা নতুন মাত্রা পায় এবং এই জোটকে কার্যকর করে তোলার প্রচেষ্টা শুরু হয়। আসন্ন ব্রিকস শীর্ষ সম্মেলন প্রথমবারের মতো পশ্চিমা বিশ্ব, বিশেষ করে আমেরিকাকে কিছুটা হলেও ভাবিয়ে তুলেছে।

আর এ কারণেই আমেরিকা হয়তো যথাসাধ্য চেষ্টা করবে যাতে ব্রিকস পূর্ণমাত্রায় যাত্রা শুরু করতে না পারে। ভারত শুরু থেকে এই জোটের সঙ্গে থাকলেও আসন্ন শীর্ষ সম্মেলন নিয়ে সে রকম উৎসাহ বা আগ্রহ দেখা যাচ্ছে না। আবার বাংলাদেশ যে বর্তমানে আমেরিকার নানামুখী চাপের মধ্যে আছে, তারও অনেক কারণের মধ্যে একটি অন্যতম কারণ বাংলাদেশ যেন ব্রিকস জোটে যোগদান না করে।
ব্রিকস জোটের আসন্ন শীর্ষ সম্মেলনে বিশ্বরাজনীতি, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে সৃষ্ট বিশ্বব্যাপী অর্থনীতিক সংকট, পশ্চিমা বিশ্বের আধিপত্য, ডি-ডলারাইজেশন, ডলারনির্ভর অর্থব্যবস্থার অপব্যবহারসহ অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আলোচনা হবে বলেই জানা গেছে। তবে ব্রিকসের একক মুদ্রা প্রচলন এবং ডলারনির্ভর অর্থব্যবস্থার বিকল্প বাণিজ্য ব্যবস্থা গড়ে তোলার বিষয়টি সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব পাবে।

আমেরিকা যেভাবে ডলারকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছে, তাতে বিশ্বের বেশির ভাগ দেশই বিকল্প একটি ব্যবস্থার প্রত্যাশায় আছে। এ কারণেই ব্রিকস জোট ও তাদের ঘোষিত একক মুদ্রা অনেক দেশেরই দৃষ্টি কেড়েছে এবং অনেকেই অধীর আগ্রহে এই জোটের দিকে তাকিয়ে আছে। জানা গেছে, ৪৪টি দেশ এরই মধ্যে এই ব্রিকস জোটে যোগদানের জন্য আগ্রহ প্রকাশ করেছে এবং ২২টি দেশ আনুষ্ঠানিকভাবে আবেদনও করেছে। সেদিক থেকে এবারের ব্রিকস শীর্ষ সম্মেলন যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ।
ব্রিকস যে লক্ষ্য ও পরিকল্পনা নিয়ে অগ্রসর হতে শুরু করেছে এবং তারা যদি সফল হয়, তাহলে ব্রিকস জোট হবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী ন্যাটোর বিপরীতে সবচেয়ে বড় ও গুরুত্বপূর্ণ জোট। ন্যাটোর প্রতিপক্ষ হিসেবে ওয়ারসো প্যাক্ট এবং ন্যাম বা জোটনিরপেক্ষ আন্দোলন নামে একটি তৃতীয় জোট গড়ে উঠলেও সেসব জোটের কোনোটিও ন্যাটোর সমকক্ষ বা প্রতিপক্ষ ছিল না। অনেকে অবশ্য বলার চেষ্টা করে যে ব্রিকস মূলত ন্যামের নতুন সংস্করণ। মোটেই তা নয়। ন্যাম মূলত ন্যাটো ও ওয়ারসো প্যাক্ট নামের দুই সামরিক জোট থেকে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখার উদ্দেশ্যে গঠিত তৃতীয় বিশ্বের অনেক দেশের সংগঠন। সে ক্ষেত্রে ব্রিকস সরাসরি পশ্চিমা বিশ্বের বিপরীতে গড়ে ওঠা একটি সংস্থা। বলা যায়, ন্যাটোর পরেই সবচেয়ে বৃহত্তম জোট হতে যাচ্ছে এই ব্রিকস। তবে ন্যাটোর সঙ্গে ব্রিকসের কিছু সুস্পষ্ট পার্থক্য আছে। ন্যাটো প্রকাশ্যে ঘোষিত একটি সামরিক জোট, কিন্তু তাদের অন্তর্নিহিত উদ্দেশ্য হচ্ছে অর্থনৈতিক আধিপত্য বিস্তার করা। পক্ষান্তরে ব্রিকস হচ্ছে প্রকাশ্যে ঘোষিত অর্থনৈতিক জোট, যদিও অন্তর্নিহিত লক্ষ্য হতে পারে ন্যাটোর বিস্তার রোধ করা। ন্যাটোর সদস্য মূলত আমেরিকা, কানাডা ও ইউরোপের কিছু দেশ অর্থাৎ ন্যাটোর পরিধি উত্তর আমেরিকা ও ইউরোপের বৃহত্তম অংশের মধ্যে সীমাবদ্ধ। সেদিক থেকে ব্রিকস হতে যাচ্ছে বিশ্বব্যাপী এক সংস্থা, যেখানে লাতিন আমেরিকা, ইউরোপের কিছু অংশ, মধ্যপ্রাচ্য, আফ্রিকা, এশিয়ার অনেক দেশ থাকবে।

এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে বিশ্ববাণিজ্যে ভারসাম্য নিশ্চিত করতে হলে ডলারের একক প্রাধান্য এবং আমেরিকাকেন্দ্রিক অর্থব্যবস্থা থেকে বের হয়ে আসতেই হবে। সেই বিবেচনায় ব্রিকস জোটের অগ্রযাত্রা নিঃসন্দেহে ভালো উদ্যোগ। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, দীর্ঘ অর্ধশতাব্দীর বেশি সময় ধরে আন্তর্জাতিক লেনদেনের ক্ষেত্রে আমেরিকান ডলার যেভাবে প্রাধান্য বিস্তার করে আছে এবং আমেরিকাকেন্দ্রিক অর্থব্যবস্থা যেভাবে জেঁকে বসে আছে তার বিপরীতে কোনো মুদ্রা বা বিকল্প অর্থব্যবস্থা দাঁড় করাতে হলে ব্রিকস যেভাবে শুরু করা প্রয়োজন, তেমনটা এখনো দৃশ্যমান হয়নি। ব্রিকস যদি সত্যিকার অর্থে পশ্চিমা বিশ্বের বিপরীতে গড়ে ওঠা জোট হয়, তাহলে আমেরিকার মতো এক শক্তিশালী দেশকে নেতৃত্বের দায়িত্ব নিতে হবে। সেই প্রেক্ষাপটে চীন হয়তো এই দায়িত্ব নিতে পারে। কিন্তু চীনকে তো সে রকম দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে। চীনের সঙ্গে ভারতের কিছু দ্বিপক্ষীয় সমস্যা আছে। চীনের উচিত ছিল ভারতের সঙ্গে শীর্ষ পর্যায়ে ব্যাপক আলোচনা করে ভারতকে আশ্বস্ত করা বা নিশ্চয়তা দেওয়া যে চীনের দ্বারা ভারতের কোনো রকম ক্ষতি হবে না।

ভারতকে সক্রিয় ভূমিকায় না নিয়ে এই জোটের সফল হওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম। কেননা ভারত তখন নিজের স্বার্থেই আমেরিকাসহ পশ্চিমা বিশ্বের সঙ্গে থাকবে। আমেরিকা এবং পশ্চিমা বিশ্ব থেকে দূরে সরে ব্রিকস জোটে যোগ দেওয়ার কারণে সাইড লাইনে পড়ে নিজেদের গুরুত্বহীন করে তোলার মতো ঝুঁকি ভারত নিশ্চয়ই নেবে না। এসব কারণে ভারতের সক্রিয় ভূমিকা ও সহযোগিতা ছাড়া ব্রিকসের চলার পথ সহজ হবে না। মোটকথা ন্যাটোর আদলে চীন যদি ব্রিকস জোটে আমেরিকার মতো শক্তিশালী নেতৃত্বের ভূমিকায় থাকতে চায়, তাহলে রাশিয়া ও ভারতকে দিতে হবে ব্রিটেন ও জার্মানির মতো ভূমিকায়। একইভাবে বাংলাদেশসহ আরো অনেক দেশকে দিতে হবে ফ্রান্স, ইতালি ও কানাডার মতো ভূমিকা। আরো একটি বিষয় খুবই গুরুত্বপূর্ণ, তা হচ্ছে ব্রিকসের একক মুদ্রায় লেনদেন করার ক্ষেত্রে সৃষ্ট বিবাদ বা জটিলতা নিরসন হবে কিভাবে। আমেরিকায় যেমন আছে স্বাধীন বিচার ব্যবস্থা, যার অধীনে যেকোনো ক্ষতিগ্রস্ত দেশ বিচার চাইতে পারে এবং বিচার পেয়েও থাকে। উল্লেখ্য, আন্তর্জাতিক লেনদেনে ভুল-বোঝাবুঝি ও বিবাদ বেশ নিয়মিত ঘটনা। একক মুদ্রা চালু এবং বিকল্প বাণিজ্য ব্যবস্থা গড়ে তোলার আগে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য আঞ্চলিক আদালত বা বিবাদ নিষ্পত্তি কেন্দ্র গড়ে তোলা অপরিহার্য। নিশ্চয়ই এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো আসন্ন ব্রিকস শীর্ষ সম্মেলনে আলোচিত হবে এবং এ ব্যাপারে সিদ্ধান্তও গৃহীত হবে বলেই আশা করা যায়।

এই শীর্ষ সম্মেলনে যোগ দেওয়া বাংলাদেশের জন্য একদিকে যেমন সম্ভাবনার, অন্যদিকে তেমনি চ্যালেঞ্জের এবং সমস্যারও বটে। সম্ভাবনার এই জন্য যে বিশ্বে রাজনীতি যেভাবে জটিল আকার ধারণ করছে, তাতে ব্রিকস বিশ্বে শক্তিশালী বিকল্প ব্যবস্থা হিসেবে গড়ে ওঠার সম্ভাবনাই বেশি। এই জোটের আছে বিশ্বের বেশির ভাগ অর্থনৈতিক অঞ্চলের সম্পৃক্ততা। ফলে এটি একটি বিশাল বাজার এবং বিনিয়োগ ক্ষেত্র হবে। এ রকম একটি জোটের শুরুর দিকে যোগ দিতে পারলে অনেক সুবিধা পাওয়া যাবে। বাংলাদেশের অর্থনীতি যে অবস্থানে এসে দাঁড়িয়েছে এবং ভবিষ্যতে যে অবস্থানে পৌঁছাবে, তাতে ব্রিকসের শুরুর দিকে যোগ দিতে পারলে বেশ ভালো অবস্থানে, বলা যায় তিন-চারটি দেশের পরেই নিজের স্থান করে নিতে পারত। ব্রিকসের প্রস্তাবিত একক মুদ্রা চালুর ক্ষেত্রে সরাসরি বিনিময়যোগ্য কয়েকটি দেশের মুদ্রাকে যদি বাস্কেটবন্দি করা হয়, সেখানে বাংলাদেশের মুদ্রার অন্তর্ভুক্তি হতে পারে। তা ছাড়া আমেরিকা যেভাবে কথায় কথায় বাংলাদেশের ওপর নিষেধাজ্ঞার হুমকি দেয়, তাতে বিকল্প একটি সুযোগ চালু রাখা হবে সর্বোত্কৃষ্ট পন্থা। চ্যালেঞ্জের বিষয় হচ্ছে, এই মুহূর্তে আমেরিকা এবং পশ্চিমা বিশ্ব থেকে দূরে সরে গিয়ে পশ্চিমা বিশ্বের বিপরীতে গড়ে ওঠা জোটে যোগদানের মতো অবস্থানে বাংলাদেশ এখনো আসেনি। এ জন্য সার্বিক প্রস্তুতির প্রয়োজন আছে। প্রথমত, দেশের মধ্যে সব দল ও মতের মানুষের মধ্যে সম্মতি থাকতে হবে। দ্বিতীয়ত, নিজস্ব উদ্যোগে পর্যাপ্ত বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সংগ্রহ করতে হবে। তৃতীয়ত, আমেরিকা ও ইউরোপের বাইরে আমাদের রপ্তানি বাজার ধরতে হবে।

যতই চ্যালেঞ্জ ও প্রতিবন্ধকতা থাকুক না কেন, আসন্ন ব্রিকস শীর্ষ সম্মেলনকে সামনে রেখে যে সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে, তা গ্রহণ করতেই হবে। যেহেতু কিছু চ্যালেঞ্জ ও প্রতিবন্ধকতা আছে, তাই একটু ভেবেচিন্তে এবং কৌশলে অগ্রসর হতে হবে। সবচেয়ে ভালো হয় যদি ব্রিকস জোটে যোগদানসংক্রান্ত একটি কমিটি গঠন করা যায়। আমাদের দেশে অনেক প্রথিতযশা অর্থনীতিবিদ, ব্যাংকার ও ভূ-রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞ আছেন, যাঁরা বিষয়গুলো খুব ভালো জানেন। তাই তাঁদের সমন্বয়ে একটি কমিটি গঠন করে, সেই কমিটির সুবারিশ নিয়ে অগ্রসর হতে পারলে ভালো ফল পাওয়া যাবে বলেই আমাদের দৃঢ়বিশ্বাস।