মুক্তিযুদ্ধে নারীর অবদান: অলঙ্কৃত নাকি কলঙ্কিত

Published: 7 December 2023

Dr Zaki Rezwana Anwar FRSA 

 ‘The German Ideology’ বইতে কার্ল মার্কস বলেছিলেন, ‘The ideas of ruling class are in every epoch the ruling ideas’ অর্থাৎ আধিপত্যশীল শ্রেণীর ধারণাই যুগে যুগে আধিপত্যশীল ধারণা হিসাবে বিরাজ করে। সে কারণেই ৭ই মার্চের উত্তাল জনসমূদ্রে ঐ সময়কার ছবিতে দেখতে পাওয়া নারীরা যারা ‘মা-বোনেরা অস্ত্র ধর, বাংলাদেশ স্বাধীন কর’ পোষ্টার হাতে জনসভায় যোগ দিতে আসেন, সেইসব নারীর যোদ্ধা ইমেজ-টি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে পাল্টে যায় বৃটেনের ‘দ্যা গার্ডিয়ান’ পত্রিকায় প্রকাশিত নাইব উদ্দিন আহমেদের তোলা ধর্ষিতা নারীর ছবি দিয়ে। সেই সাথে আধিপত্যশীলদের দ্বারা স্বাধীন বাংলাদেশেও নারীর এই ধর্ষিতা ইমেজটিই যেন পাকাপোক্ত হয়ে যায়। । আর প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায় এই বয়ান – ‘‘ত্রিশ লক্ষ শহীদ আর দুই লক্ষ মা-বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে আমরা স্বাধীনতা অর্জন করেছি।”

ভাষা বা বয়ান যার দখলে সত্য তার দখলে! ফলে মুক্তিযুদ্ধের দলিলপত্রের ১৫ খন্ডের কোন খন্ডেই মুক্তিযোদ্ধা নারীর বিবরণ বিশেষ পাওয়া যায় না। বরং যুদ্ধকালে নারীর উপর নেমে আসা শারীরিক নির্যাতন সম্ভ্রমহানিত্বের প্রতীক হয়ে ওঠার কারণে সমাজ তাঁদের এই পরিচয়কে লুকিয়ে রাখতে তৎপর হয়ে উঠে আর ধীরে ধীরে তাঁরা অদৃশ্য হয়ে যায়। ফলে তাঁদের অবদানকে এ দেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের গর্বিত অংশীদারিত্বের সাথে এক করে দেখা সম্ভব হয় নি। এমন কি যেসব নারী মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন এবং নির্যাতিতা হয়েছিলেন, তাঁদেরও মুক্তিযোদ্ধা পরিচয়টি ছাপিয়ে ধর্ষিতা ইমেজটিকেই সামনে নিয়ে আসা হয়। তাই যুদ্ধকালীন শারীরিক নির্যাতনের স্বাক্ষর বাংলাদেশের পুরুষদের দেয় মুক্তিযোদ্ধার সম্মান আর নারীদের দেয় ‘সম্ভ্রমহানি’র সার্টিফিকেট।

১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ পর্যন্ত এদেশের রাজনৈতিক ভাষা নির্মাণ করেছিল বহু সংগ্রামে, বহু বেদনায়, বহু যাতনায় নিষ্পেষিত সাধারণ জনগণ। তাদের নির্মিত ভাষায় তাদের কাংঙ্খিত রাষ্ট্র যে প্রতীক ও শ্লোগানগুলো তৈরী করেছিল, তা নির্দেশ করেছিল একটি নারী-পুরুষ, ধনী-দরিদ্র নির্বিশেষে সমতাভিত্তিক, অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক, মুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠার প্রত্যয়। এসব ভাষা, শ্লোগান – এক কথায় এসব প্রতীক আমাদের সামনে যে সত্য তুলে ধরে তা হলো, বৈপ্লবিক ঘটনাধারায় অনিবার্যভাবে বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রাম যে গড়িয়েছিল মুক্তিযুদ্ধে, তা সর্বস্তরের নিপীড়িত ও বঞ্চিত মানুষের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা ও অংশগ্রহণের মাধ্যমেই ঘটেছিল।

বিষয়টা আরো স্পষ্ট হয় ইতিহাস ঘেঁটে তখনকার রাজনৈতিক ভাষা, শ্লোগানগুলোকে দেখলে। আমরা দেখি, ‘জয় বাংলা’ র পাশাপাশি, ‘তোমার আমার ঠিকানা, পদ্মা মেঘনা যমুনা’, ‘শ্রমিক কৃষক ছাত্র জনতা – এক হও এক হও’, ‘মা বোনেরা অস্ত্র ধর, বাংলাদেশ স্বাধীন কর’। পরিস্কারভাবে দেখা যায় বাংলার নারী সমাজ মুক্তিযোদ্ধা। এই যোদ্ধা ইমেজটিও একদিনে গড়ে ওঠেনি। স্বদেশী আন্দোলন হয়ে প্রাক-মুক্তিযুদ্ধকালীন সব আন্দোলন সংগ্রামেই নারীর অংশগ্রহণ এবং অবদান থেকেই এই পোস্টারের জন্ম। বলা যেতে পারে বাংলাদেশের জন্মের‌ সাথে নারীর অংশগ্রহণের প্রতীক হলো ঐসব পোস্টার এবং শ্লোগান। দুঃখজনক যে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত নানা প্রতীক ও শ্লোগানের মধ্যে প্রথম যেটি আমরা বিসর্জন দেই সেটি হলো, নারীর মুক্তিযোদ্ধা ইমেজ।

নারীরা মুক্তিযুদ্ধে প্রশিক্ষণ নিয়ে রাইফেল হাতে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে গেরিলাযুদ্ধ থেকে শুরু করে সম্মুখযুদ্ধে অংশ নিয়েছেন, মুক্তিযোদ্ধাদের খাবার দিয়েছেন, আশ্রয় দিয়েছেন, স্বামী-সন্তানকে যুদ্ধে পাঠিয়েছেন, ক্যাম্পে শুশ্রষা করেছেন, মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্পে রান্নার কাজ করেছেন, মুক্তিযোদ্ধাদের প্রহরী হিসেবে কাজ করেছেন, যুদ্ধের সময় পাকিস্তানী হানাদারের হাত থেকে রক্ষা করতে নিজেদের ঘরে আশ্রয় দিয়েছেন মুক্তিযোদ্ধাদের, শরণার্থী শিবিরে ডাক্তার, নার্স ও স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে অনেক নারী যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা ও শরণার্থীদের সেবা করেছেন। একাত্তরে নারীদের এই সক্রিয় ভূমিকা আমাদের অনেক বড় সহায়ক শক্তি ছিল- একথা অনেকেই ভুলে গেছেন। নারীরা যদি জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় না দিতেন তাহলে কোনো মুক্তিযোদ্ধা কোনো গ্রামে গিয়ে অপারেশন চালাতে পারতো না। দুর্ভাগ্যবশত আমাদের ইতিহাস চর্চ্চায় এ বিষয়গুলো উঠে আসেনি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও ছাত্রর ইউনিয়ন কর্মী রোকেয়া কবীরের মত অনেকে গেরিলা যুদ্ধ আর সশস্ত্র যুদ্ধের ট্রেনিং নিয়েছিলেন। অস্ত্র হাতে তুলে ‌নিয়েছিলেন কাঁকন বিবি, সিতারা বেগম, তারামন বিবি, শিরিন বানু মিতিল, সুধারানী কর, পূর্ণিমা রানী দাস ও  রওশন আরা ছাড়াও অনেকে। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শিল্পী হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন অনেক নারী শিল্পী যাদের অজস্র গানের সুর শুনে মানুষ শিহরিত হয়েছিল আর ঝাঁপিয়ে পড়েছিল দেশরক্ষার সংগ্রামে। সেলিনা বানু স্বশরীরে উপস্থিত হয়ে যোদ্ধাদের মনোবল অটুট রাখা এবং শরণার্থীদের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা জাগাতে তৎপর ছিলেন। পুরুষের পোশাকে যুদ্ধে পাকিস্তানীদের প্রতিরোধ করেছিলেন শিরিন বানু মিতি আর আলেয়া বেগমের মত অনেকে। অবশেষে দেশ স্বাধীন হবার পর পুরুষ মুক্তিযোদ্ধাদের যুদ্ধ শেষ হলেও নারীর যুদ্ধ শেষ হয়নি আজো নিজের দেশে মাথা উঁচু করে বাঁচবার।

কথা হচ্ছে, এতে কি শুধু নারীরই ক্ষতি হয়েছে? ক্ষতি হয়েছে দেশেরও। এসব নারীদের আমরা নীরবে নিভৃতে হারিয়ে যেতে না দিলে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার কাজের সময় অনেক সাক্ষ্য প্রমাণ পেতে সুবিধে হত।

আমাদের কবিতায়, উপন্যাসে, গল্পে, নাটকে, চলচ্চিত্রে মুক্তিযুদ্ধের নারীকে কিভাবে তুলে ধরা হয়েছে? মোটা দাগে গণমাধ্যমের বিভিন্ন শাখায় নারীর এই ধর্ষিতা ইমেজটিই উঠে আসে প্রধান উপজীব্য হয়ে। তারা ইতিহাসের রেপ্রেজেন্টেশনে মুক্তিযুদ্ধের গ্র্যান্ড-ন্যারেটিভের বাইরে যেতে পারনি। যদি চলচ্চিত্রের কথাই ধরি, তাহলে প্রশ্ন হচ্ছে, এই গ্র্যান্ড ন্যারেটিভটা কী? গ্র্যান্ড-ন্যারেটিভটি দাঁড়িয়েছে এমন যে, মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক চলচ্চিত্র মানেই শুরু ৭ই মার্চের ভাষণ দিয়ে, তারপর ২৫শে মার্চের কালো রাতের দৃশ্য, পাক হানাদার বাহিনীর বর্বর নির্যাতন, ধর্ষণ, কিছু দাঁড়ি-টুপিওয়ালা রাজাকার, মুক্তিযোদ্ধাদের সশস্ত্র যুদ্ধ এবং শেষে পতাকা হাতে ‘জয়বাংলা শ্লোগান। এর বাইরে মুক্তিযুদ্ধের আর কোনো ধারা বা দিক দু’একটি চলচ্চিত্র ছাড়া বেশিরভাগ চলচ্চিত্রে দেখা যায়নি।

গণমাধ্যমে যে বিষয়টি বিশেষভাবে সঙ্কটের সৃষ্টি করেছে তা হলো মুক্তিযুদ্ধে নারীর উপস্থাপন। মুক্তিযুদ্ধে নারীর অবদান বহুমাত্রিক হলেও বাংলাদেশের মূল ধারার ইতিহাসে নারীর মুক্তিযোদ্ধা ইমেজের পরিবর্তে তার ধর্ষিত ইমেজটিকেই কেবল প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে। গণমাধ্যমে নারীর যোদ্ধা ইমেজের পরিবর্তে তাকে দুর্বল ও বেশিরভাগ সময়ে ধর্ষণসহ বিভিন্ন অবমাননাকর ভূমিকায় দেখা গেছে। সব চাইতে বিব্রতকর ও আপত্তিকর বিষয় হচ্ছে, নারী নির্যাতন, হত্যা, নারীধর্ষণ, ইত্যাদি ঘটনা মানবতার লাঞ্ছনার জন্যে কতোটা দায়ী তাকে গুরুত্ব দেওয়ার চাইতে এসব দৃশ্য চিত্রায়ণের ক্ষেত্রে বীভৎসতা আরোপ করে দর্শক টানার চেষ্টা করা হয়েছে। অল্প কিছু চলচ্চিত্রে অবশ্য নারীকে শুশ্রূষা প্রদানকারী, কিংবা সহযোগীর ভূমিকায় দেখা গেছে। অর্থাৎ জাতীয় ইতিহাসের সমান্তরালেই এসব ধর্ষিত নারীকে সম্ভ্রমহীন দেখানো হয়েছে, ধর্ষণদৃশ্যকে বাণিজ্যিক প্রয়োজনে ব্যবহার করা হয়েছে এবং ধর্ষণ অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে যাওয়া এসব নারীকে হয় মরে যেতে হয়েছে নয়তো মানসিক ভারসাম্যহীন হয়ে পড়তে হয়েছে অথবা অদৃশ্য হয়ে যেতে হয়েছে। ইদানিং আরেকটি ফরমেট দেখা যাচ্ছে যেখানে মূল নারী চরিত্রকে ধর্ষণ অভিজ্ঞতার বাইরে রেখে তার শারীরিক সৌন্দর্যকে মূলধন করে মুনাফা নিশ্চিত করা হচ্ছে এবং অপ্রধান নারী চরিত্রকে ধর্ষিতা দেখিয়ে মেরে ফেলা হচ্ছে।

শেষ পর্যন্ত মুক্তিযুদ্ধে নারী বীর হয় নি, সমাজেও হয় নি, ইতিহাসেও হয় নি, চলচ্চিত্রেও হয় নি। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রাতিষ্ঠানিক ইতিহাস নারীর বহুমাত্রিক অবদানকে স্বীকৃতি দেয়নি বরং তার ওপর নেমে আসা ইতিহাসের সব নির্যাতনকে তার ‘সম্ভ্রমহানিত্ব’ হিসেবে দলিলবদ্ধ করেছে। মাতৃভূমিকে মায়ের সঙ্গে তুলনা করে আক্রান্ত দেশমাতৃকার জন্য পুত্র সন্তানের যুদ্ধে যাওয়া ‘মাতা-পুত্র’র যুদ্ধ ফ্রেমওয়ার্কে নারী চিত্রায়িত হয়েছে কেবলই যুদ্ধের ‘ক্ষয়ক্ষতি’ হিসেবে, যেন damaged caused by war. তাই নারীর আর মুক্তিযোদ্ধা হয়ে উঠা হয়নি।

বিজয়ের ৫২ বছর পর আমরা বলতে চাই, কেবল দু’লাখ মা বোনের সম্ভ্রম হারানোর গল্প আর নয়, নারীর অবদানকে আরো বড় পরিসরে দেখার মনোভাব তৈরী হতে হবে বা তৈরী করতে হবে। আমাদের বয়ানটা যদি পরিবর্তিত না হয় তাহলে আমাদের প্রজন্ম এবং আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের কাছে ইতিহাসের এ অংশটুকু অজানাই থেকে যাবে। এখন তথাকথিত ন্যারেটিভ থেকে বের হয়ে আমাদের ডিসকোর্স হবে, ‘৩০ লাখ শহীদ ও দু’লাখ মা-বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে স্বাধীনতা অর্জিত হয় নি, স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছে লাখো নরনারীর আত্মত্যাগের বিনিময়ে।’

লেখক: একজন চিকিৎসক, জনপ্রিয় সংবাদ পাঠক ও‌ কলামিষ্ট