বিএনপি নেতাকর্মীদের প্রতিদিনই সাজা

Published: 12 December 2023

বিশেষ সংবাদদাতা :


ঢাকার আদালতে বিএনপি নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে বিচারাধীন পুরোনো মামলায় রায় হচ্ছে প্রায় প্রতিদিনই। সোমবারও নাশকতা ও গাড়িতে অগ্নিসংযোগের পৃথক ৫ মামলায় যুবদলের সাবেক সভাপতি সাইফুল আলম নিরব, ঢাকা সিটির সাবেক কাউন্সিলর আনোয়ারুজ্জামান, বিএনপির ঢাকা মহানগর দক্ষিণ শাখার সদস্য সচিব রফিকুল ইসলাম মজনু ও জামায়াতে ইসলামীর ঢাকা মহানগরী দক্ষিণের সেক্রেটারি শফিকুল ইসলাম মাসুদসহ ৫৯ নেতাকর্মীকে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেওয়া হয়েছে।

ঢাকা মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালত এসব রায় ঘোষণা করেন। এছাড়া অবৈধ সম্পদের মামলায় বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাসের বিরুদ্ধে দুদকের করা মামলার রায় ঘোষণা করা হবে আজ। এ মাসে বিএনপি নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে আরও অনেক মামলার রায় ঘোষণা হওয়ার কথা রয়েছে।

প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যায়, গত সাড়ে ৩ মাসে ৬২ মামলায় বিএনপির সিনিয়র কেন্দ্রীয় নেতা থেকে শুরু করে ওয়ার্ড পর্যায়ের ৯৫৯ নেতাকর্মীদের সাজা হয়েছে। এর মধ্যে আগস্টে ৩ মামলায় ২৭ জন, অক্টোবরে ৫ মামলায় ৫৪ জন, নভেম্বরে ৩৫ মামলায় ৬২৫ জন এবং ডিসেম্বরের ১১ তারিখ পর্যন্ত ১৮ মামলায় বিভিন্ন মেয়াদে ২৫৬ জনের সাজা হয়েছে। রায়ে তিনজন মৃত ব্যক্তিকেও সাজা দেওয়ার তথ্য মিলেছে। তবে অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় প্রায় তিন শতাধিক নেতাকর্মী খালাসও পেয়েছেন।

গত দুই মাসে দেওয়া বিভিন্ন মামলার রায় পর্যালোচনা করে দেখা যায়, শুক্র-শনিবার বাদে অন্য দিনগুলোতে বিএনপি নেতাকর্মীদের মামলার রায় ঘোষণা করা হচ্ছে। কোনোদিন ২টি, কোনোদিন ৪টি, কোনোদিন ৫টি মামলার রায়ও ঘোষণা হয়েছে। আদালত সূত্র ও আইনজীবীদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, গত দুই মাসে মামলার রায় ঘোষণার সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। এসব মামলায় বিএনপি নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে পুলিশের ওপর হামলা, কর্তব্য কাজে বাধা, ককটেল বিস্ফোরণ, ইটপাটকেল নিক্ষেপ, অগ্নিসংযোগসহ নাশকতার অভিযোগ আনা হয়েছে।

বিএনপির আইনজীবীরা জানান, বিচারকাজ এত দ্রুত চলছে যে, ডিসেম্বর মাসেই আরও অন্তত ৩০টি মামলার রায় হতে পারে। ঢাকার আদালতে বিচারাধীন রয়েছে আরও প্রায় ৫০০ মামলা। তারা বলেন, এসব মামলায় বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সাক্ষী নেওয়া হয়েছে কম। সাক্ষীদের অধিকাংশই পুলিশ সদস্য। যে মামলাগুলোর বিচারকাজ চলছে, তাতে আসামির তালিকায় দলটির ভাইস চেয়ারম্যান থেকে ওয়ার্ডের কর্মী পর্যন্ত প্রায় ১ হাজার নেতাকর্মীর নাম রয়েছে।

জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরামের মহাসচিব ও বিএনপির আইনবিষয়ক সম্পাদক ব্যারিস্টার কায়সার কামাল যুগান্তরকে বলেন, স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের ইতিহাসে আইন অঙ্গনে এ রকম ঘটনা কখনোই পরিলক্ষিত হয়নি। কোনো কোনো মামলায় চার্জশিটে যাদের সাক্ষী করা হয়েছে, তাদের সাক্ষ্যগ্রহণ ছাড়াও মামলার রায় দেওয়া হয়েছে। এখন যেটা হচ্ছে, শুধু দুই-চারজন পুলিশ সাক্ষী ও পুলিশ বাদীর সাক্ষ্যের ওপর ভিত্তি করে প্রতিদিনই কোনো না কোনো মামলার রায় হচ্ছে। এটা সম্পূর্ণভাবে আইনের অপব্যবহার। মন্ত্রণালয়ের চাপে পড়ে এসব রায় হচ্ছে কিনা প্রশ্ন তোলেন তিনি।

রাজধানীর তেজগাঁও থানায় ১০ বছর আগে দায়ের করা নাশকতা ও গাড়িতে অগ্নিসংযোগের মামলায় সোমবারও যুবদলের সাবেক সভাপতি সাইফুল আলম নিরব ও ঢাকা সিটির সাবেক কাউন্সিলর আনোয়ারুজ্জামানসহ বিএনপির ১০ নেতাকর্মীকে তিন বছরের সাজা দেন আদালত। ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট মেহেদী হাসানের আদালত এ রায় দেন।

১০ বছর আগে পল্টন থানার নাশকতার মামলায় সোমবার জামায়াতের ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সেক্রেটারি শফিকুল ইসলাম মাসুদ ও বিএনপি ঢাকা মহানগর দক্ষিণ শাখার সদস্য সচিব রফিকুল ইসলাম মজনুসহ ১০ জনকে ২ বছর ৬ মাসের সাজা দিয়েছেন আদালত। ঢাকা মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট মো. মইনুল ইসলাম এ রায় ঘোষণা করেন। মামলার সূত্রে জানা যায়, ২০১২ সালের ১ ডিসেম্বর বিএনপি-জামায়াতের নেতাকর্মীরা মিছিল বের করলে পুলিশ বাধা দেয়। এ সময় তারা পুলিশের ওপর চড়াও হয়ে ইটপাটকেল ও ককটেল নিক্ষেপ করে। এছাড়া ঘটনাস্থলে থাকা গাড়ি ভাঙচুর করে বলেও মামলায় অভিযোগ করা হয়।

পাঁচ বছর আগে গুলশান থানায় করা আরেক নাশকতা মামলায় বিএনপির ১১ নেতাকর্মীকে পৃথক তিন ধারায় এ দিন সাড়ে ৪ বছরের সাজা দেন ঢাকা মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট মো. মেহেদী হাসান। রায়ে দুই বছর করে চার বছরের সাজা দেন বিচারক।

এর আগে গত ১০ ডিসেম্বর রাজধানীর কলাবাগান, বংশাল ও কোতোয়ালি থানার তিনটি মামলায় ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবদলের সদস্য সচিব রবিউল ইসলাম নয়নসহ বিএনপির ৭৩ নেতাকর্মীকে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেন ঢাকা মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালত। এর মধ্যে বংশাল থানায় ২০১৮ সালে করা নাশকতার এক মামলায় বিএনপির ২৫ নেতাকর্মীকে পৃথক দুই ধারায় তিন বছরের সাজা দেওয়া হয়। এছাড়া কলাবাগান থানার মামলায় রবিউল ইসলাম নয়নসহ ৪০ জনকে পৃথক তিন ধারায় দেড় বছরের সাজা দেওয়া হয়। ২০১৩ সালের ১৩ নভেম্বর পুলিশের কাজে বাধা ও ককটেল বিস্ফোরণের অভিযোগে এ মামলাটি করে পুলিশ। মামলার বিচার চলাকালে ৬ জন আদালতে সাক্ষ্য দেন।

আদালত সূত্র ও আইনজীবীদের দেওয়া তথ্যে জানা যায়, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা হাবিবুর রহমান হাবিব, ভাইস চেয়ারম্যান মোহাম্মদ শাজাহান, যুগ্ম-মহাসচিব হাবিব উন নবী খান সোহেল, তথ্যবিষয়ক সম্পাদক আজিজুল বারী হেলাল, স্বেচ্ছাসেবকবিষয়ক সম্পাদক মীর সরাফত আলী সপু, গ্রাম সরকারবিষয়ক সহসম্পাদক বেলাল আহমেদ, সহপ্রচার সম্পাদক শামীমুর রহমান শামীম, নির্বাহী কমিটির সদস্য শেখ রবিউল আলম, হাবিবুর রশিদ, আকরামুল হাসান, যুবদলের সাবেক সভাপতি সাইফুল আলম নিরব, যুবদলের সভাপতি সুলতান সালাউদ্দিন টুকু, স্বেচ্ছাসেবক দলের সাধারণ সম্পাদক রাজিব আহসান, যুবদলের সিনিয়র সহসভাপতি মামুন হাসান, সাংগঠনিক সম্পাদক ইসহাক সরকার, রংপুর জেলা বিএনপির সদস্য সচিব আনিসুর রহমান লাকু ও মহানগর বিএনপির সদস্য সচিব অ্যাডভোকেট মাহফুজ উন নবী ডন, রাজশাহী জেলা বিএনপি সভাপতি আবু সাঈদ চাঁদসহ যুবদল, ছাত্রদল এবং অন্যান্য অঙ্গসংগঠনের অনেক নেতাকর্মীর কোনো মামলায় সাজা হয়েছে ছয় মাস করে। কোনো মামলায় হয়েছে সাত বছর পর্যন্ত। তবে বেশিরভাগ মামলায় সাজা হয়েছে দুই থেকে তিন বছর করে। এর মধ্যে বিএনপির ১৫ জনের মতো নেতাকর্মী একাধিক মামলায় সাজা পেয়েছেন বলে জানান আইনজীবীরা।

প্রতিদিনই রায় ঘোষণার বিষয়ে অধস্তন আদালতের সরকারি কৌঁসলি (পিপি) আবদুল্লাহ আবু যুগান্তরকে বলেন, প্রতিদিনই রায় হওয়া আদালতের স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। এটা আগেও হয়েছে। আদালতের মামলা নিষ্পত্তি করার জন্যই রায় হচ্ছে। কম সাক্ষীর সাক্ষ্য নিয়ে রায় দেওয়ার অভিযোগের বিষয়ে পিপি বলেন, এটা ঠিক নয়। সব প্রক্রিয়া অনুসরণ করেই রায় দেওয়া হয়। মামলায় যুক্তিতর্ক হয়। সেখানে আসামি পক্ষের আইনজীবীরাও অংশ নিচ্ছেন।

সুপ্রিমকোর্টের সিনিয়র আইনজীবী ড. শাহদীন মালিক যুগান্তরকে বলেন, সাধারণভাবে ফৌজদারি বিচারে দোষী সাব্যস্ত হওয়ার হার হলো শতকরা ২০ থেকে ২৫ ভাগ। এই প্রেক্ষাপটে ইদানীং বিএনপির নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে শতভাগ মামলায় অভিযুক্তদের কেউ না কেউ দোষী সাব্যস্ত হচ্ছে। এতে জনমনে বিচার বিভাগের ওপর আস্থা কমে যাচ্ছে। বিচার বিভাগের ওপর জনগণের আস্থা কমে গেলে অন্যান্য প্রতিষ্ঠান, রাজনৈতিক দল, রাজনীতিবিদ-সবাই কিন্তু এ আস্থাহীনতার শিকার হবেন। ফলে সমাজে অস্থিরতা বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা করছি।

তিনি বলেন, সাধারণ মামলায় বিশ্বাসযোগ্যতার জন্য পুলিশের সাক্ষী থেকে সাধারণ মানুষ বেশি সাক্ষী হয়। এ হিসাবে পুলিশের সাক্ষীর আধিক্য রাজনৈতিক উদ্দেশ্যের দিকেই ইঙ্গিত করে।

মৃত তিন ব্যক্তির সাজা : গত সাড়ে তিন মাসে দেওয়া ৫২টি রায়ের মধ্যে তিনটি মামলায় মৃত তিন ব্যক্তিকে রায় দেওয়ার তথ্য পাওয়া গেছে।