পান দান: বিলেতের বিয়েতে বাংলা সংস্কৃতির বর্ণিল বিনদোন পর্ব

Published: 15 February 2024

আমরা অনেকটা তাড়াহুড়ো করেই স্বপরিবারে পৌঁছে গেলাম তোফায়েল আহমেদ ভাইয়ের আরিয়ানা হলে। আমার একমাত্র মামা, মামাতো ভাইয়ের প্রথম ছেলে শরীফ উদ্দিনের বিয়ে। এদিকে আমার বোন জাকিয়া সুলতানা ও স্বপরিবারে এসে যোগ দিলেন। খানা দানা অত্যন্ত সুস্বাদু তা সেরে নিলাম আসরের নামাজের আগে। অতঃপর আসলো খাদ্যের বিনদোন পর্ব।

ভাবছেন খাদ্যের বিনদোন আবার কি? হা, আমাদের সংস্কৃতিতে এটা খুব ভালো ভাবেই বিদ্যমান। বিশেষ করে বিয়ের অনুষ্ঠানে এটা না হলেই নয়। হয়তো আঁচ করে নিয়েছেন তা কি। আমাদের টেবিলে থাক লাগিয়ে দেয়া হলো এক ভারী উঁচু পান-দান। আহ, পান খেতে সে কি ভিড়। একটা ফটো খিচে তা শেয়ার করলাম আমার চাটগ্রুপ গুলিতে। দেখলাম আগ্রহের শেষ নেই। তাই ভাবলাম আবহমান বাংলার এই পান কথাটা সবার সাথে শেয়ার করে নেই। এই পান কথার গল্পচ্ছলে আসুন আমরা এর ইতিহাসের পাতা একসাথে খুলে দেখি।

বাংলার মাটি ও মানুষের জীবনে পানের এক অনন্য স্থান রয়েছে, যা ঢাকা শহর ও গ্রামীণ জীবনের মিলনমেলায় এক বিশেষ আবেদন তৈরি করে। পান, একটি সামাজিক প্রতীক হিসেবে, ঢাকার জীবনে এমন এক অভিন্ন অংশ যা অতিথি আপ্যায়ন, বিবাহ, উৎসব এবং সামাজিক অনুষ্ঠানের সঙ্গে গভীরভাবে জড়িত। এই প্রবন্ধে, ঢাকার পান সংস্কৃতির এক বর্ণাঢ্য চিত্র অঙ্কিত হয়েছে, যেখানে পানের বিভিন্ন প্রকার, তার প্রস্তুতি ও পরিবেশনের রীতি, সঙ্গে সঙ্গে পান বিক্রেতাদের জীবনযাত্রা ও সাজসজ্জার বর্ণনা সমাজের এক বিচিত্র ও বৈচিত্র্যময় দিক তুলে ধরে।

ঢাকার পান সংস্কৃতি শহরের গণ্ডি পেরিয়ে গ্রামীণ বাংলার সঙ্গেও এক অদৃশ্য সেতু বেঁধেছে। সুলতানি আমল থেকে সোনারগাঁও এর কাফুরি পান, ঘোড়াশাল ও ময়মনসিংহের নান্দাইলের পানের চাষ এবং ঢাকার বাদামতলির সাঁচি পানের বাজার এই সংস্কৃতির বৈচিত্র্য ও গভীরতা তুলে ধরে। পান প্রস্তুতির নানা পদ্ধতি, যেমন খয়েরের বিশেষ প্রক্রিয়া, চুন ও সুপারির ব্যবহার, এবং পান পরিবেশনের অনুষঙ্গ যেমন খাশদান, ডাবর, পিকদান ইত্যাদির বর্ণনা এক সমৃদ্ধ ঐতিহ্যের কথা বলে।

পান বিক্রেতাদের জীবনযাত্রা, তাদের বিশেষ সাজসজ্জা, চুলের বাবরি ও রঙিন পোশাক, চোখে সুরমা এবং চালচলনের বিশেষত্ব এক অনন্য সামাজিক চরিত্রের প্রতিফলন। এই বিশেষ চরিত্রগুলি ঢাকার সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জীবনে পানের অবদান ও প্রভাবের এক জীবন্ত দলিল।

পানের এই সংস্কৃতি শুধুমাত্র খাদ্য সংস্কৃতির একটি অংশ নয়, বরং এটি বাঙালির সামাজিক অনুষ্ঠান, আচার-অনুষ্ঠান, এবং মানবিক সম্পর্কের এক অভিন্ন অংশ। পান-চিনির মাধ্যমে বিবাহের পাকা কথা থেকে শুরু করে যুদ্ধের ময়দানে যাওয়ার আগে পানের বিড়া হাতে নিয়ে বিদায়ের রীতি পর্যন্ত পানের ব্যবহার বাঙালির জীবনের নানা দিক স্পর্শ করে। এই প্রবন্ধে উঠে আসা বিবরণ ও চিত্রকল্প ঢাকার পান সংস্কৃতির এক বিস্তৃত ও বর্ণিল ক্যানভাস তৈরি করে, যা বাংলার ঐতিহ্য ও সাংস্কৃতিক ধারার এক অমূল্য অংশ।

এই পান সংস্কৃতির বর্ণিল ক্যানভাস যা বাংলার ঐতিহ্য ও সাংস্কৃতিক ধারার এক অমূল্য অংশ। এই ঐতিহ্যের মহিমা শুধু বাংলাদেশের মাটিতেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে বাঙালি সম্প্রদায়ের মধ্যে এর প্রভাব বিস্তার লাভ করেছে। বিশেষ করে, ব্রিটেনে বসবাসরত বাঙালিরা তাদের বিবাহ অনুষ্ঠানে পানের এই সংস্কৃতিকে বজায় রেখেছেন, যা বাংলা বিবাহের এক অপরিহার্য অংশ হিসেবে গণ্য হয়। ব্রিটেনের মতো এক দূর দেশে এই প্রথা ও প্রচলনের মাধ্যমে পানের গ্র্যান্ডিওর অব্যাহত রয়েছে, যা প্রমাণ করে যে সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য কোনো ভৌগোলিক সীমানায় বাঁধা নয়, বরং এটি হৃদয়ে ও আত্মায় বহন করা এক অনুভূতির নাম। ব্রিটেনে বাংলা বিবাহে পানের এই প্রচলন বাঙালির ঐতিহ্য ও সাংস্কৃতিক পরিচয়ের এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে, যা প্রবাসে বাঙালির সাংস্কৃতিক ঐক্য ও ঐতিহ্যের ধারাকে অক্ষুণ্ন রাখার এক জীবন্ত প্রমাণ।